‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- কিছুতেই থামছে না’ এটি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান সংবাদ শিরোনাম। খবরটিতে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- উদ্বেগজনকহারে বেড়ে গেছে। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে চলছে কড়া সমালোচনা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে। কিন্তু তাতে ভ্রƒক্ষেপ নেই কারো। উল্টো ক্ষমতাসীনরা এর পক্ষে সাফাই গাইছেন। প্রতিটি হত্যাকা-ের পর প্রায় একই রকম গল্প ফাঁদছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকা-কে মানবাধিকার কর্মীরা দেখছেন রাষ্ট্রীয় হত্যা হিসেবে। তারা বলছেন, রাষ্ট্রের মদদ না থাকলে ধারাবাহিকভাবে এমন হত্যাকা- সম্ভব হতো না। দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের হত্যাকা- বন্ধ করে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, কথা বলার সময় সবাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। আর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তো বলেছিলেন, তাদের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- কোনোভাবেই প্রশ্রয় পাবে না। তাহলে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলছে কিভাবে, কাদের প্রশ্রয়ে? এমন হত্যাকা-ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রশ্রয় দেয়ার সক্ষমতা তো বিরোধী দলসমূহের নেই। তাহলে তো অভিযোগের অঙ্গুলী নির্দেশিত হয় সরকার ও সরকারি দলের দিকে। আসলে কাদের প্রশ্রয়ে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলছে তা জনগণ জানে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্তেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন রজব আলী। অভিযান পরিচালনা করে যশোরের কেশবপুর থানার পুলিশ। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত এ ঘটনাকে হত্যাকা- বলেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। প্রথমবারের মতো কমিশন এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের তদন্ত করে। পুলিশের বর্ণিত ঘটনায় নানা অসঙ্গতি চিহ্নিত করে কমিশন তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে, এই কথিত বন্দুক যুদ্ধের কোনো সত্যতা নেই। কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, এটি একটি হত্যাকা-। যারা আসামীকে গ্রেফতার করেছিল তাদেরই এর দায় নিতে হবে। তিনি এদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোরও দাবি জানান। এরপরও কি আমাদের সরকারের টনক নড়বে না?
দেশের অভ্যন্তরে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকারকে চিঠি দিয়ে র্যাব সদস্যদের মার্কিন সহায়তায় কোনো প্রশিক্ষণে না পাঠানোর জন্য বলা হয়। চিঠির অনুলিপি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব ও র্যাবের ডিজির কাছেও পাঠানো হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের সমালোচনা দেশে-বিদেশে চললেও সরকার যেন বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছে না, বরং তারা সাফাই গাইছেন। গত মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, দেশে কোনো ক্রসফায়ার হয় না, যা হয় তা বন্দুকযুদ্ধ। কিন্তু এই বন্দুকযুদ্ধের গোমর তো ফাঁস করে দিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বলেছেন, এটি হত্যাকা-। কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত রজব আলীর ঘটনা তদন্ত করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, কথিত বন্দুকযুদ্ধের কোনো সত্যতা নেই। আমরা মনে করি- ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধ’, ‘ক্রসফায়ার’ কিংবা অন্যকোনো নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের কোনো সুযোগ নেই। কোনো দেশে গণতন্ত্র থাকলে, আইনের শাসন থাকলে সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলতে পারে না। কারণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- সুশাসনকে প্রতিষ্ঠিত করে না, বরং হিংসা ও অরাজকতাকে প্রশ্রয় দেয়। বিষয়টি আমাদের সরকার উপলব্ধি করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন