আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি
বলেছেন, বিএনপির আন্দোলনে দেশের মানুষ সাড়া দেয়নি। দেশের ভাগ্য নিয়ে আর
কাউকে খেলতে দেয়া হবে না। অপর দিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য দেশে শিগগিরই নির্বাচন প্রয়োজন’। বিবেকবান মানুষ মাত্রই স্বীকার করবেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহানের এ বক্তব্য
এ দেশের সাধারণ মানুষের মতেরই নিরেট প্রতিফলন। কারণ, দেশের মানুষ মনে করে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বীবিহীন
ও প্রহসনের এক নির্বাচন। তাতে দেশের মালিক তথা জনগণ তাদের ভোটের অধিকার হারিয়েছে। বরং
বলা ভালো, তাদের ভোটের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে ওই নির্বাচনের মাধ্যমে।
তাই জনগণ শিগগিরই সবার অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন চায়, যার মাধ্যমে দেশের মানুষ তাদের পছন্দের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সরকারকে
রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে পারে। সে নির্বাচনে থাকবে না ক্ষমতাসীনদের কোনো অনৈতিক ও অবৈধ
প্রভাব। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের আগে পরিচালিত বিভিন্ন মতামত জরিপে দেখা গেছেÑ দেশের বেশির ভাগ মানুষ চায় দেশে বিদ্যমান অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশে নির্দলীয়
একটি নির্বাচনী সরকারের অধীনে সব দলের জন্য সমসুযোগের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন
হোক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এ দলটির নেতৃত্বাধীন
জোটের শরিক দলগুলো। তাদের বক্তব্য আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু সম্প্রতি কয়েক দফায়
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দুই দফায় কতটুকু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, তা আওয়ামী লীগের নীতি-সমর্থক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছিটেফোঁটা খবরে এর প্রমাণ
মেলে।
সে যা-ই
হোক, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতৃত্বাধীন জোটের
শরিক দলগুলোর নেতারা বলেছেন জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে যেহেতু বিএনপি নেতৃত্বাধীন
বিরোধী জোটের সাথে কোনো সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হয়নি, অতএব ৫ জানুয়ারি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায়
নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর সম্ভাব্য দ্রুত সময়ে সব দলের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে আরেকটি
নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এ নির্বাচনে বিরোধী আন্দোলন র্যাব-পুলিশ-বিজিবি
ও সেনাবাহিনী নামিয়ে কঠোর দমন-পীড়নের মাধ্যমে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পন্ন করার পর
এসব নেতা-নেত্রীদের এখন ভিন্ন সুর। তাদের কথা পাঁচ বছরের আগে আর কোনো নির্বাচন নয়।
বিরোধী দলের সাথে কোনো সংলাপও নয়। বিএনপি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনী ট্রেন ফেল করেছে।
অতএব খালেদা জিয়াকে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।
আর ২০১৯ সালের নির্বাচনও হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি
যে বললেন, দেশের ভাগ্য নিয়ে আর কাউকে খেলতে দেয়া হবে না সে বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ কিন্তু তাই। অর্থাৎ বিরোধী দলের নির্বাচন সম্পর্কিত
দাবি কোনো মতেই মেনে নেয়া হবে না। বিএনপি আবারো আন্দোলনে গেলে কঠোর হাতে তা দমন করা
হবে। এতে সরকার কোনো ছাড় দেবে না। সে জন্যই তিনি বলছেন, বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন করেছে তাতে
জনগণ সাড়া দেয়নি। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চাইছেন, যে আন্দোলনে জনগণের সাড়া নেই, সে আন্দোলনের দাবি মানার প্রশ্নই আসে না।
প্রশ্ন
হচ্ছেÑ দেশের মানুষ বেগম খালেদা জিয়ার আন্দোলনে সাড়া দেয়নি। তা প্রমাণের
মাপকাঠি কী? দেশের মানুষ দেখেছে ৪১টির মতো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে সরকারদলীয়
জোটের গুটিকয়েক শরিক দলের বাইরে আর কোনো দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। অপর অর্থে ৫ জানুয়ারির
নির্বাচন এসব দল বর্জন করেছে। বিষয়টি কি এই প্রমাণ করে না যে, দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ বেশির ভাগ মানুষ বেগম
জিয়ার দাবির প্রতিই সমর্থন জানিয়েছে। জাতীয় সংসদের ৩০০ নির্বাচনী আসনের ১৫৩ আসনে সরকার
ও সরকারের মিত্রের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রার্থী দেয়নি। এর অর্থ কি এই নয় যে, জনগণ এ নির্বাচন বর্জন করে বেগম জিয়ার দাবিকে যৌক্তিক বলে সম্মতি জানিয়ে দিয়েছে।
তা ছাড়া কে অস্বীকার করতে পারে, সরকারি জোটে থাকা জাতীয় পার্টির বড় অংশ নির্বাচনে
অংশ নেয়নি। এর অর্থ কি এমনি কিছু নয় যে, সরকারি জোটের ভেতরেও ৫ জানুয়ারির
নির্বাচনকে মেনে নেয়নি, এমন দল আছে। জাতীয় পার্টিকে নিয়ে কত নাটক যে দেশের
মানুষের সামনেই মঞ্চস্থ হয়েছে তাও লুকানো-চাপানো কোনো বিষয় ছিল না। জনগণ তা বোঝেনিÑ এমনটি ভাবা ঠিক নয়। আর এই জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে
বানানো হয়েছে প্রহসনের আরেক বিরোধীদলীয় নেতা, জনসমর্থনের দিক থেকে জাতীয় পার্টি
এখন কার্যত জনবিচ্ছিন্ন একটি দল। প্রথম দুই দফা উপজেলা নির্বাচন থেকে জাতীয় পার্টির
জনপ্রিয়তার পারদমাত্রা যথার্থ পরিমাপ হয়ে গেছে। এমন একটি জনসমর্থনহীন দল আজ বিরোধী
দলের মসনদে আসীন। রাজনীতির দুষ্ট কৌশল খেলে আজ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলটিকে সংসদের
বাইরে ঠেলে দিয়ে জনবিচ্ছিন্ন একটি দলকে বিরোধী দলের মসনদে বসিয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচনের
মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণ করে আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখছে বর্তমান সরকার।
দেশের মানুষ বিবেকের তাড়নায় বলেন, কার্যত বর্তমান সরকারই দেশ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।
দমন-পীড়ন চালিয়ে বিরোধী দলকে অস্তিত্বহীন করে আজীবন ক্ষমতায় থাকার দুঃস্বপ্ন দেখে।
যখন অন্যদের দিকে আঙুল দেখিয়ে সরকারি দলের নেতানেত্রীরা বলেন, দেশ নিয়ে আর কাউকে খেলতে দেয়া হবে না, এরা আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন, দেশ চালাবেনÑ তখন সত্যিই বেমানান ঠেকে। স্বার্থান্বেষী অমূলক
প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে প্রতিপক্ষকে দিনে ১০ বার স্বাধীনতাবিরোধী বলে আখ্যায়িত করলেও
দেশের মানুষ তা আমলে নেয় না। প্রায় দুই দফা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল কিন্তু এ
সত্যটি দেশবাসীর সামনে বড় করে তুলে এনেছে। এর পরও থামছে না এদের ভিত্তিহীন প্রচার-প্রচারণা
দেশের মানুষকে বোকা বানানোর জন্য। হাসির খোরাক জোগায়, যখন একজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবী টকশোতে বলেন, জনগণ উপজেলা নির্বাচনে সরকারবিরোধী
প্রার্থীদের বেশি হারে ভোট দেয়ার কারণ হচ্ছে জনগণ বিভ্রান্ত। আসলে জনগণকে যারা বোকা
আর বিভ্রান্ত ভাবে, তারা নিজেরাই কার্যত শতভাগ বিভ্রান্ত।
আমাদের
সরকারি জোটের নেতানেত্রীরা একটি কথা খুব বেশি বলেন। এরা বড় গলায় বলেনÑ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশে আইনের শাসন পায়। কিন্তু তথ্যপ্রমাণ বলে ঠিক এর
উল্টো। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড জাস্টিস বিশ্বের ৯৯টি দেশের আইনের শাসন পরিস্থিতি পর্যালোচনা
করে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এটি আইনের শাসনের সূচকের তালিকা।
এই সূচক মতে, আইনের শাসনের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান একদম তলানিতে।
৯৯টি দেশের আইনের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২তম। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট যুক্তরাষ্ট্রের
ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি সংস্থা। ৯টি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ‘আইনের শাসন সূচক ২০১৪’ তালিকাটি এই সংস্থা প্রকাশ করেছে গত বুধবার। এই
সূচকে প্রথম দিকের গর্বিত দেশ পাঁচটি হচ্ছে যথাক্রমেÑ ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস।
আর আইনের শাসন সূচকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশ তিনটি হচ্ছেÑ ভেনিজুয়েলা (৯৯তম), আফগানিস্তান (৯৮তম) ও জিম্বাবুয়ে (৯৭তম)। অপর দিকে
এশিয়ায় বাংলাদেশ ৯২তম স্থানে, পাকিস্তান ৯৬তম স্থানে, ভারত ৬৬তম স্থানে এবং নেপাল ৫৭তম স্থানে।
যে ৯টি
বিষয় বিবেচনায় এনে এই আইনের শাসন সূচক তৈরি করা হয়, সেগুলো সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দেয়া
আছে। এগুলো হচ্ছেÑ ১. সরকারি ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ, ২. দুর্নীতিমুক্ত পরিস্থিতি, ৩. উন্মুক্ত সরকারব্যবস্থা, ৪. মৌলিক অধিকার, ৫. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ৬. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ, ৭. দেওয়ানি ব্যবস্থা, ৮. ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা এবং ৯. বিচারব্যবস্থার
পরিস্থিতি। এ সূচকে আমাদের বেহাল অবস্থার অপর অর্থ এই ৯ ক্ষেত্রে আমরা অন্যান্য দেশের
চেয়ে অনেক অনেক পিছিয়ে, গলাবাজিতে আমরা যতই এগিয়ে থাকি না কেন।
এই প্রতিবেদনে
ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নিরীক্ষা বিভাগসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর
কার্যকর ভূমিকা আমলে নেয়া হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের
উল্লিখিত সূচক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা আক্রান্ত। এতে করে বাংলাদেশে আইনের শাসন বাস্তবায়নে বেশির
ভাগ ক্ষেত্রেই রয়েছে ব্যর্থতা। পুলিশসহ নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যে দুর্নীতি উল্লেখ করার
মতো। সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে
ব্যর্থতা। সুদীর্ঘ এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটটি সূচকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ
স্কোর করেছে দুর্নীতি, দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা।
ওয়ার্ল্ড
জাস্টিস প্রজেক্ট আইনের শাসনব্যবস্থাকে কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে এ ধরনের আইনের শাসন
সূচক সৃষ্টি করে? সোজা কথায় এই সংস্থার কাছে ‘আইনের শাসন’ তথা ‘রুল অব ল’এর সংজ্ঞাটি কী? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, এই সংস্থা ‘আইনের শাসন’ সংজ্ঞায়িত করতে চারটি সার্বজনীন
নীতি তথা ইউনিভার্সেল প্রিন্সিপলকে সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। এগুলো হলোÑ 1. The government and its officials and agents as well as
individuals and private entities are accountable under law; 2. The laws are
clear, publicized, stable and just, are applied evenly, and protect fundamental
rights, including the security of persons and property; 3. The process by which
the laws are enacted, administered, and enforced as accessible, fair, and
efficient; 4. Justice is delivered timely by competent, ethical and independent
representatives and neutrals who are of sufficient number, have adequate
resources, and reflect the makeup of the communities they serve.
বলার অপেক্ষা
রাখে না, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য এসব সার্বজনীন নীতি মেনে
চলার জন্য একইভাবে অপরিহার্য একটি উন্মুক্ত সরকার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতিমুক্ত
থাকা, দেশের মানুষের জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, নিরাপত্তা বিধান করা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করানো, দল-মত নির্বিশেষে মানুষকে সমান সুযোগ ও অধিকার দেয়া এবং সর্বোপরি দুষ্টের
দমন ও শিষ্টের লালন। এসব ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু এগিয়েছি কিংবা কতটুকু পিছিয়ে গেছি, তা সবার আগে ভেবে দেখা দরকার। এ ক্ষেত্রে আত্মসমালোচনাই হতে পারে যথার্থ হাতিয়ার।
সেখানে যদি অন্যের প্রতি আঙুল দেখানোর ব্যাপারে আগে থেকেই আবেশিত থাকি তবেই সমূহ বিপদ।
আইনের
শাসন রাজনীতি-বিজ্ঞানে একটি বহুল আলোচিত পদবাচ্য। ইংরেজিতে এটি ‘রুল অব ল’ নামে অভিহিত, যা nomocracy
নামেও
পরিচিত। ষোড়শ শতাব্দীতেও ‘রুল অব ল’ পদবাচ্যটির ব্যবহার লক্ষ করা
যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে ব্রিটিশ জুরিস্ট এ ভি ডিসে এই পদবাচ্যটিকে
জনপ্রিয় করে তোলেন। আইনের শাসনের ধারণাটি প্রাচীন দার্শনিকদের কাছে, যেমন অ্যারিস্টটলের কাছেও পরিচিত ছিল। অ্যারিস্টটল লিখে গেছেন : Law should govern, তাই আইনের শাসনের তাগিদ হচ্ছেÑ প্রত্যেক নাগরিক আইনের অধীন, এমনকি তারাও যারা আইন প্রণয়ন
করেন। আইনের শাসনে কারো জন্য ‘ডিভাইন রাইটের’ স্থান নেই। সোজা কথায় এখানে ‘রুলার ইজ এভাব দ্য ল’ নীতির স্থান নেই। বরং আইনের শাসন বলে : ‘রুলার ইজ অলসো আন্ডার দ্য ল অ্যাজ উইথ আদার সিটিজেন্স।’ কিন্তু আমরা দেখি আমাদের দেশের ক্ষমতাসীনেরা সকাল-বিকেল বলেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার
কথা, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ক্ষমতাসীনদের জন্য সাত খুন মাফ। ক্ষমতাসীনেরা
আদালতে ফাঁসির দণ্ড পেলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় এরা মাফ পেয়ে যায়। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে
পুলিশ মামলা পর্যন্ত নিতে চায় না। আর তাদের ব্যাপারে পান থেকে চুন খসলে, থানা আক্রমণ হয়, পুলিশ আক্রান্ত হন। তার পরও নেতানেত্রীদের প্রতিদিনের
উচ্চারণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনেরা অবাদ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি তোলেন অহরহ। অথচ এরাই ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালটপেপার ও ব্যালটবাক্স ছিনতাই, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্র
থেকে বের করে দেয়া, প্রশাসনকে নির্বাচনী ফলাফল পাল্টে দিতে বাধ্য করা
ইত্যাদি এখন আর লুকিয়ে-ছাপিয়ে চলে না। মৌলিক অধিকার হরণ, রাজনৈতিক হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার নামে নানা উপসর্গ এখানে
প্রবল। এর পরও আমরা কী করে দাবি করি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে মাঝে মধ্যেই যেসব মানবাধিকার প্রতিবেদন
প্রকাশ করা হচ্ছে, সেগুলোকে অস্বীকার করাই হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের রুটিনকর্ম।
আমরা ভুলে
যাচ্ছি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কেবল একটি দেশ সামনের দিকে এগিয়ে
যেতে পারে। বিষয়টি শুধু রাজনৈতিক শৃঙ্খলাই ফিরে আনে না, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অপর অর্থ দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়ার পথকেই খুলে
দেয়। কারণ, অর্থনীতির সাথে আইনের শাসনের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। সমীক্ষা
ও বিশ্লেষণ চালিয়ে দেখা গেছে, আইনের শাসনের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে অর্থনীতির ওপর।
কনস্টিটিউশনাল ইকোনমিকস বলে একটা কথা আছে। এর মাধ্যমে ইকোনমিকস ও ফিন্যান্সিয়াল ডিসিশনগুলোর
সাথে বিদ্যমান সাংবিধানিক আইনকাঠামো কতটুকু সাযুজ্যপূর্ণ তার সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ চালানো
হয়। আর এই কাঠোমোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে জুডিশিয়ারিতে সরকারি ব্যয় কী হারে চলছে
তার বিশ্লেষণ। কারণ, বেশির ভাগ ট্রানজিশনাল ও উন্নয়নশীল দেশে তা পুরোপুরি
চলে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। জুডিশিয়ারিতে দুই ধরনের দুর্নীতির মধ্যে
পার্থক্য বিধান খুবই দরকার। অর্থাৎ বিচার বিভাগে নির্বাহী শাখার দুর্নীতি ও বিচার বিভাগে
বেসরকারি খাতের দুর্নীতি এই দুই ভাবেই দুর্নীতি চলতে পারে। একটি প্রমিত মানের
কনস্টিটিউশনাল ইকোনমিকসের ব্যবহার চলতে পারে বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের সময়। আর বাজেট
প্রণয়ন স্বচ্ছ হলে আইনের শাসন উপকৃত হয়।
সে যা-ই
হোক আইনের শাসনের সাথে অর্থনীতি সম্পর্কের বিষয়টিও খুবই সুগভীর। কনস্টিটিউশনাল ইকোনমিকসে
এরই অধ্যয়ন চলে। অর্থনীতির বাইরে সব ক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠা করা। আইনের শাসন মানুষের জানমালের নিরাপত্তা
নিশ্চিত করে তোলে। মানুষকে অর্থনৈতিক উদ্যোগে প্রণোদিত করে। আইনের শাসন মানুষকে দেয়
ফান্ডামেন্টাল রাইট। অস্বীকার করে ডিভাইন রাইট। সে পথেই আপনার, আমার, সবার মুক্তি। কারণ, আইনের শাসন ছাড়া দেশে রাজনৈতিক
ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায় না। দেশে সহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয় না
গোলাপ মুনীর
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন