জুতা আভিজাত্যের প্রতীক। অতীতে
রাজা-বাদশা, জমিদার ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে দুষ্প্রাপ্য ও দামি অথচ আরামদায়ক
জুতা পরার প্রতিযোগিতা ছিল। অতীতে জুতা প্রস্তুতে শুধু চামড়ার ব্যবহার হতো। চামড়ার
জুতার মধ্যে গরুর চামড়ার জুতা তুলনামূলক অন্য চামড়ার জুতার চেয়ে সহজলভ্য ও মূল্যসাশ্রয়ী
হলেও তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে ছিল। রাজা-বাদশা, জমিদার ও অভিজাত শ্রেণী হরিণ অথবা সাপের চামড়া বিশেষত অজগর সাপের চামড়া দ্বারা
প্রস্তুতকৃত জুতা পরে গর্ববোধ করতেন। বিজ্ঞানের উন্নতি ও উৎকর্ষের সাথে চামড়ার বিভিন্ন
বিকল্প আবিষ্কারের ফলে এখন অতীতের মতো জুতা প্রস্তুতে শতভাগ চামড়া ব্যবার হয় না। আবার
এমন অনেক জুতা আছে যেগুলো প্রস্তুতে কোনো ধরনের চামড়ার ব্যবহার হয় না। অধুনা বাণিজ্যিক
উদ্দেশ্যে গরু ও ছাগল উভয় ধরনের চামড়া দ্বারা জুতা প্রস্তুত করা হলেও মূল্যের দিক থেকে
গরুর চামড়ার জুতা সাশ্রয়ী, যদিও ক্রেতার পক্ষে বোঝার উপায় নেই কোন্ জুতাটি
ছাগলের এবং কোন্ জুতাটি গরুর চামড়া দিয়ে তৈরী।
অতীতে
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকে ধর্ম বিশ্বাসের কারণে গরুর চামড়া দ্বারা তৈরী জুতা পরিধান
পরিহার করে চলতেন। অতীতের ধর্ম বিশ্বাসের সে দৃঢ়তা বর্তমানে অনেকটা শিথিল হওয়ায় এ প্রশ্নটি
এখন আর তেমন জোরালোভাবে উচ্চারিত হয় না। এ দেশে রাজা-বাদশা ও জমিদারদের শাসন চলাকালীন
প্রজাদের জুতা পরে তাদের সামনে উপস্থিত হওয়া নিষিদ্ধ ছিল এবং কেউ দুঃসাহস দেখালে ঔদ্ধত্য
বিবেচনায় শাস্তি ভোগ করতে হতো। এমনকি রাজা-বাদশা বা জমিদারের প্রাসাদ বা অট্টালিকার
সামনে দিয়ে হেঁটে চলার সময় জুতা খুলে বাহুর নিচে রেখে সম্মুখপানে চলতে হতো। অতীতের
সে দিন আর নেই। এখন মূল্যের তারতম্য থাকলেও ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার পায়ে থাকে জুতা।
জুতা পরিধানের
সামগ্রী হলেও জুতা নিয়ে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গবেষক এবং রাজনীতিতে পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে কখনো আগ্রহের কমতি ছিল না। তাই তো
নোবেল জয়ী বাঙালি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জুতা আবিষ্কার’ নামক কবিতা লিখে কিভাবে রাজা মশাইয়ের পা আবৃতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল তার বর্ণনা
দিয়েছিলেন। হিন্দি ছায়াছবির ৫০-এর দশকের সাড়া জাগানো নায়ক রাজ কাপুর ‘শ্রী ৪২০’ ছবিতে মুকেশের কণ্ঠের ‘মেরা জুতা হায় জাপানি’ গানটি গেয়ে লাখো-কোটি শ্রোতা-দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জুতার
প্রতি মানুষের মন থেকে যে আকর্ষণ এ কারণেই বোধ করি পুরনো দিনের গান হিসেবে এ গানটি
গাওয়ার পাঁচ দশক পরও এর আবেদন এতটুকু কমেনি।
বিশ্বব্যাপী
প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে জুতার ব্যবহার বিরল নয়। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বুশ ডিসেম্বর, ২০০৮ বিশ্ববাসীকে অন্ধকারে রেখে
চুপিসারে ইরাক সফরে গিয়েছিলেন। ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে যৌথ সংবাদ সম্মেলনের
সময় সভাস্থলে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের জনা পঞ্চাশেক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
এরই একজন হচ্ছেন কায়রোভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল বাগদাদিয়ার বাগদাদ প্রতিনিধি মোন্তাজার-আল-জায়িদি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হওয়ার কারণে সব
সময় তার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। ডিসেম্বর, ২০০৮ সংবাদ সম্মেলনে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও ছিল নিশ্ছিদ্র। সাংবাদিকদের সভাস্থলে
প্রবেশের আগে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মার্কিন বাহিনী দিয়ে দেহ তল্লাশি করানো হয়। মেটাল
ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে তারা সভাস্থলে প্রবেশ করেন। সংবাদ সম্মেলনে বুশ তার বক্তব্য শুরু
করলে হঠাৎ সাংবাদিক জায়িদি উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠেন ‘কুত্তা এই যে এটি তোর বিদায়ী চুম্বন’ এবং এ কথাটি বলার সাথে সাথে তিনি
প্রথমে তার ডান পায়ের জুতাটি ছুড়ে মারেন। অতঃপর বাম পায়ের জুতাটি ছুড়ে মারেন। উভয় জুতা
লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মঞ্চের পেছনে টাঙানো মার্কিন ও ইরাকি জাতীয় পতাকার ওপর গিয়ে পড়ে।
সাংবাদিক জায়িদি যদি বাক্য উচ্চারণ না করে জুতা ছুড়ে মারতেন তাহলে হয়তো প্রথমোক্ত জুতাটি
লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয়ে বুশের মুখের ওপর আঘাত হানতো। এর দ্বারা বুশের জীবনহানি না হলেও
মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বস্তুত বাক্য উচ্চারণ করে জুতা নিক্ষেপ করে সাংবাদিক
জায়িদি বুশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। টিভি ফুটেজে দেখা গেছে, বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে বুশ নিজেকে উভয় জুতার আক্রমণ থেকে নিরাপদ করেন। একজন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট চলাফেরার সময় বা বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদানের সময় সম্ভাব্য কোনো আক্রমণের
শিকার হলে তিনি কিভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন সে বিষয়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা তাকে নিয়মিত
অনুশীলন প্রদান করে থাকে। জুতা হামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করে বুশ প্রমাণ করতে সক্ষম
হয়েছেন যে তিনি সঠিকভাবে অনুশীলন গ্রহণ করেছিলেন।
এখানে
দেখার বিষয় বুশের প্রতি জুতা নিক্ষেপ করার পেছনে সাংবাদিক জায়েদির উদ্দেশ্য কী ছিল? তিনি কি নিক্ষিপ্ত জুতা দ্বারা বুশের মুখমণ্ডলে আঘাত করে তার ঘৃণার প্রকাশ
ঘটাতে চেয়েছিলেন নাকি বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে বুশকে সতর্ক করে দিয়ে তার জুতাটিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট
করে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। সাংবাদিক জায়িদির কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণে দ্বিতীয়
চাওয়াটি সমর্থিত হয়।
আমাদের
দেশেও প্রতিবাদের অংশ হিসেবে আদালত কক্ষে বিচারককে লক্ষ্য করে এবং সভা মঞ্চে কোনো বিশেষ
ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে জুতা ছুড়ে মারার বেশ কিছু ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর
দেশবাসী এ সব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারে। আদালত কক্ষে জুতা ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটে সাধারণত
কোনো অপরাধী বিচারকের আদেশ দ্বারা সংক্ষুব্ধ হলে। বিচারকের আদেশটি একটি বিষয়ে সংক্ষুব্ধতার
কারণের উদ্ভব ঘটতে পারে। তবে সভাস্থলে কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে জুতা ছুড়ে মারার অধিকাংশ
ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওই ব্যক্তির কৃতকর্ম ও আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজ দল
বা প্রতিপক্ষ দলের এক বা একাধিক ব্যক্তি জুতা ছুড়ে মারছে।
জুতা ছুড়ে
মারার এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ৭৫’ পরবর্তী ২১ বছর পর ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতা গ্রহণ পরবর্তী ওই সালের শেষের
দিকে। তখন রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্বরত ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। সে বছর
বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত ঈদে মিলাদুন্নবী সা:-এর অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বক্তব্য প্রদানকালীন
তার একটি বাক্য উপস্থিত শ্রোতাদের অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর পরক্ষণই দেখা গেল
কেউ কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই ভারী বৃষ্টিবর্ষণের মতো সভামঞ্চের দিকে জুতা ধেয়ে আসছে।
রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা কর্মীরা তাৎক্ষণিক তার চতুর্দিকে মানবব্যূহ সৃষ্টি করে তাকে
নিরাপদে গাড়িতে ওঠার ব্যবস্থা করে সে যাত্রা তাকে রক্ষা করেছিলেন। সে দিন নিরাপত্তারক্ষীদের
পিঠে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে জুতার আঘাত লাগলেও তারা সেটিকে আমলে নেননি বরং তাদের
আঘাতকে তুচ্ছ মনে করে তারা বলেছিলেন আমাদের রাষ্ট্রপতিকে আমরা রক্ষা করতে পেরেছি।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের
৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানপরবর্তী তিনটি পৃথক ঘটনায় বর্তমান ক্ষমতাসীন
দলের তিনজন সংসদ সদস্য জুতা হামলার শিকার হন। এ তিনটি হামলার প্রথমোক্তটির ঘটনাস্থল
ছিল চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানায়। এ ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য একটি ইসলামি জলসায় প্রধান
অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে মঞ্চে আরোহণ করে বক্তৃতা দেয়ার জন্য উদ্ধত হলে আকস্মিক সম্মুখে
উপবিষ্ট জনতা উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চের দিকে জুতা ছুড়তে শুরু করে। এ সময় তাদের মুখ থেকে প্রধান
অতিথিকে নিয়ে আপত্তিকর আওয়াজ উঠতে থাকে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পেরে অগত্যা
আয়োজকেরা প্রধান অতিথির প্রস্থানের ব্যবস্থা করে বিক্ষুব্ধ জনতাকে সামাল দিতে সচেষ্ট
হন।
দ্বিতীয়
ঘটনাটি প্রথম ঘটনাটির সপ্তাহখানেকের মধ্যেই চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত পটিয়া থানায় ঘটে।
এ ঘটনায় পার্শ্ববর্তী আনোয়ারা থানা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী
প্রথম ঘটনার অনুরূপ একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য
শুরুর পর পরই হঠাৎ চতুপার্শ্ব থেকে মঞ্চকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। উপস্থিত
বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা আয়োজকরা প্রধান অতিথির প্রস্থানের ব্যবস্থা
করে পরিস্থিতি শান্ত করার প্রয়াস নেন।
তৃতীয়
ঘটনাটিও একজন স্থানীয় সংসদ সদস্যের ইসলামি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিতির
আপত্তিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়। এ ঘটনাটিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য আগের দু’টি ঘটনার মতো বক্তব্য শুরুর পরই জুতা নিক্ষেপের কবলে পড়েন এবং এখানেও তাকে
পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় বক্তৃতা শুরুর পরক্ষণেই সভাস্থল ত্যাগ করতে হয়েছিল।
দশম সংসদ
নির্বাচনপরবর্তী এক মাস অতিবাহিত হওয়ার আগে ক্ষমতাসীন দলের তিনজন সংসদ সদস্য জুতা হামলার
মুখে পড়ে নাজেহাল হওয়ায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে হামলাকারীরা নিজ দলের সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি
নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ? দলীয় সমর্থকদের দাবি এরা নিজ দলের সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি
বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এ দু’টির কোনোটিই নয়। তাদের অভিমত এরা হলো জুতা কারখানা
মালিকদের ভাড়াটে লোক। তারা পর্যায়ক্রমিকভাবে সংঘটিত তিনটি ঘটনার বিশ্লেষণ করে যে ব্যাখ্যা
দিয়েছেন তার মর্মকথা হলো, বর্তমানে আমাদের দেশের জুতারবাজার বেশ প্রতিযোগী।
এ বাজারে দেশীয় কারখানার পাশাপাশি বিদেশী কারখানাও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আবার দেশীয়
ক্ষুদ্র কারখানার কাছে দেশের বড় ও বিদেশী কারখানাগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে
না। তাই জুতা বিক্রি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে এ পন্থার অবলম্বন। তবে হামলাকারীরা দেশীয়
নাকি বিদেশী না কারখানা মালিকদের ভাড়াটে লোক- এ বিষয়টি তারা নিশ্চিত করতে পারেননি।
ব্যাখ্যায় দাবি করা হয় সংসদ সদস্যরা সম্মানিত লোক। যে জনগণ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত
করেছেন তাদের পক্ষে কি সম্ভব নিজ সংসদ সদস্যকে এভাবে জুতা মেরে লাঞ্ছিত করা? তাই সংসদ সদস্যদের উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করে জুতা ব্যবসায়ীরা অভিনবরূপে তাদের
চরদের মাধ্যমে ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছেন।
আকর্ষণীয়
ও রুচিশীল পোশাক যেমন একজন ব্যক্তির আত্মতুষ্টি ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়ক ঠিক তেমন
আকর্ষণীয় ও রুচিশীল জুতা এ দু’টির অনুরূপ। জুতা অনেক সময় ক্ষমতা হারানোর কারণেরও
উদ্ভব ঘটায়। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসের ক্ষমতা হারানোর পেছনে স্ত্রী
ইমেলদার জুতার পেছনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের প্রশ্নটিও এসেছিল। সে দেশের অর্থনীতি যখন
বিপর্যস্ত তখনো তার স্ত্রী দেশের দিকে না তাকিয়ে শুধু একের পর এক অভিনব ধরনের জুতা
কেনার পেছনে ছুটে চলেছিলেন। তার স্বামী ক্ষমতা হারানোর পর তিনি বিষয়টি উপলব্ধি করতে
পারলেও তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক
কারণে একজন ব্যক্তির চলাফেরায় পায়ের অবলম্বন হিসেবে যখন একটি মাত্র জুতা থাকে তখন শত
জীর্ণতার মাঝেও জুতাটির গুরুত্বের কোনো হানি ঘটে না। এমনি একটি জুতা পরিধান করতেন আমার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন আবাসিক মহসীন হলের জনৈক অগ্রজ। অগ্রজ ভাইয়ের জুতাটি
দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে জীর্ণ ও মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। জুতাটিকে নিয়ে অগ্রজ
ভাইকে প্রায়ই হলের সামনে উপবিষ্ট জাতমুচি মেঘার শরণাপন্ন হতে হতো। অবশেষে জুতাটি এমন
অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছিল মেঘাকে বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছিল, স্যার আমার জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে
এ জুতা আর মেরামত করতে পারব না। এখন এটিকে মেরামত করতে হলে মুচিদের সম্মেলন ডেকে উপায়
উদ্ভাবন করতে হবে। একটি জুতা যতই জীর্ণ ও মেরামত অযোগ্য হোক না কেন, এটি যখন একমাত্র অবলম্বন তখন শত সংক্ষুব্ধতার মাঝেও প্রতিবাদের হাতিয়ার রূপে
এটির ব্যবহার সম্ভব হয় না। তাই জুতা গবেষকদের অভিমত, জুতা নিক্ষেপের ঘটনা এড়াতে হলে
এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে একজন ব্যক্তি একটি জুতা ক্রয়ের পর ন্যূনতম দুই বছর ব্যবহারের
পর সেটি জমা না দিয়ে যেন নতুন জুতা কিনতে না পারে। এ বিষয়টি জুতা কারখানা ও জুতা দোকান
মালিকদের ব্যবসায়িক স্বার্থের পরিপন্থী হলেও প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা অবসান আন্দোলনকারীদের
এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পরিবেশবাদীদের দাবির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার কারণে শেষোক্তরা
এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
এক মাসের
ব্যপ্তিতে পরপর জুতা ছোড়ার তিনটি ঘটনা সংঘটিত হলে এবং এসব ঘটনায় দলের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের
ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার কারণে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গোলটেবিল বৈঠক আহ্বানের
আবশ্যকতা দেখা দেয়। গোলটেবিল বৈঠকে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত ব্যক্ত করলেও একটি মত ঐতিহাসিক
দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়। আর তা হলো জুতা নিক্ষেপের সাথে প্রজারা জড়িত
বলে অতীতের মতো রাজা-বাদশা বা জমিদারদের অনুরূপ ক্ষমতাধরদের উপস্থিতি আছে এমন সভায়
প্রজাদের জুতা পরে যোগদান বারিত করতে হবে। তবে জুতা কারখানা ও জুতার দোকান মালিকদের
তীব্র আপত্তির কারণে এটি যে কার্যকর করা যাবে না সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকের মধ্যে সংশয়
রয়েছে। আর এ সংশয়টি আরো দৃঢ় হলো যখন জানা গেল জুতা কারখানা ও জুতা দোকান মালিকদের মধ্যে
দু-একজন সংসদ সদস্যও রয়েছেন। ঘটনাপ্রবাহদৃষ্টে অনুমিত হয়, জুতা ছোড়ার কারণে দলের ভাবমূর্তি যে ক্ষুণ্ন হয়েছে তাতে গরু মেরে জুতা দান
নয় বরং গরুকে বাঁচিয়ে রেখে পায়ের আচ্ছাদনের সামগ্রী ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে জুতার
ব্যবহার নয়- এ মন্ত্রেই দলের বিশাল কর্মীবাহিনী ও দেশবাসীকে দীক্ষিত করতে হবে। আর তাতেই
জুতা মেরে অপমানিত বা সম্মানিত নয়, এ বিতর্কের অবসানে জুতা যে নেহাত
পায়ের সুরক্ষার জন্য স্বচ্ছন্দে চলাফেরার সামগ্রী এ সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হবে।
ইকতেদার আহমেদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন