শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৪

সরকারের ‘বিশাল অর্জন’ এবং ‘দশম’ সংসদের প্রথম অধিবেশন


দশম নামের সংসদের ‘নির্বাচন’ করার এবং পাঁচ শতাংশেরও কম মানুষের ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়ে সরকার গঠনের পরপর ওই সংসদের অধিবেশনও শুরু করেছেন ক্ষমতাসীনরা। গত ২৯ জানুয়ারি দশম নামে বর্ণিত জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী তথা প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন করার এবং সদস্যদের আসন বণ্টনের বাইরে এ অধিবেশনে উল্লে¬খযোগ্য আর কিছুই করতে দেখা যায়নি। ‘সেঞ্চুরি’ হাঁকানো সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতো স্পীকার পদে ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পীকার পদে এডভোকেট ফজলে রাব্বি চৌধুরীও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন। এর মাত্র একদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর ছেড়ে দেয়া রংপুর-৬ আসন থেকে ‘নির্বাচিত’ হয়ে এসেছিলেন মাননীয় স্পীকার। সেটাও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই! তাকে নিয়ে এবারের সংসদে তাই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’দের সংখ্যা ১৬০-এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী সব মহলে ব্যাপকভাবে নিন্দিত-সমালোচিত এত বড় একটি লজ্জাকর বিষয়েও সংসদে উপস্থিত কাউকে সামান্য লজ্জিত বোধ করতে দেখা যায়নি। প্রত্যেকে বরং মাথা উঁচিয়ে এবং বুক ফুলিয়ে থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নতুন নেত্রী রওশন এরশাদসহ যে কয়েকজন মাত্র বক্তব্য রেখেছেন তারাও গর্বিতভাবেই বলেছেন। অহঙ্কারেরও স্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়েছেন তারাÑ যেন হাজার নয়, লাখ লাখ ভোটের বিশাল ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে সংসদে এসেছেন প্রত্যেকে!
সংসদের প্রচলিত রীতি ও রেওয়াজও যথেচ্ছভাবে ভেঙেছেন তারা।  যেমন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রেওয়াজ হলো, নতুন স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচনের পর প্রথমে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্যসহ দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের উদ্দেশে সম্মান জানিয়ে শোক প্রকাশ ও শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে এবারের প্রথম অধিবেশনে গুণকীর্তন করা হয়েছে স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরীর। বিস্ময়করভাবে স্পীকার নিজেও সরকারি দলের চিফ হুইপের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন। এই সুযোগে চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বুঝিয়ে দিয়েছেন, চাটুকারিতা কাকে বলে। সবাইকে হতবাক করে চিফ হুইপ বলেছেন, এতদিনকার ‘অনভিজ্ঞ’ স্পীকার নাকি প্রমাণ করেছেন, যারা বিজ্ঞ স্পীকার তিনি তাদের চেয়েও ‘বিজ্ঞ’! প্রশ্ন উঠেছে, মাত্র কয়েক মিনিট আগে নির্বাচিত হয়েই শিরিন শারমিন চৌধুরী কিভাবে ‘প্রমাণ’ করলেন যে, তিনি আসলেও অতীতের সব বিজ্ঞ স্পীকারের চেয়ে বিজ্ঞ স্পীকার? তেমন কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগই তো তখন পর্যন্ত তিনি পাননি। তিনি তো বরং রেওয়াজ ভেঙে ‘প্রমাণ’ করেছেন, স্পীকার পদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতাই তার ছিল না। তাছাড়া সত্যিকারের যোগ্য ও বিজ্ঞ স্পীকাররা সাধারত চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দেন না যেটা সবচেয়ে ‘বিজ্ঞ’ বলে বর্ণিত স্পীকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী প্রথম অধিবেশনের প্রথম উপলক্ষেই দিয়েছেন। দায়িত্ব যেখানে ছিল অতি সম্প্রতি মৃত্যুবরণকারী টাঙ্গাইল আসনের সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহানের জন্য শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা স্পীকার সেখানে সরকারি দলের চিফ হুইপকে নিজের গুণকীর্তনের জন্য সুযোগ দিয়েছেন।
দশম নামের সংসদের প্রথম অধিবেশনে অন্য দু’-একজনও কম দেখাননি। বিশেষ করে ‘নবনির্বাচিত’ বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের কথা বলতেই হবে। কারণ একদিকে তিনি নিজের স্বামী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বাঁ পাশে নীরবে বসিয়ে রেখে নিজে বসেছেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের স্টাইলে ধোয়ামোছা করেছেন বিএনপি এবং বেগম খালেদা জিয়াকে। একই নিঃশ্বাসে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি ভক্তি উজাড় করে দিয়েও অবাক করেছেন তিনি। সবশেষে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে এরশাদের নেতৃত্বে উন্নয়নের যে সূচনা হয়েছিল সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পূর্ণতা পাবে’ এবং এ ব্যাপারে তারা সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবেন। মন্ত্রিত্ব নিয়েও কিভাবে বিরোধী দল হওয়া যায় সে প্রশ্নের উত্তরে রওশন বলছেন, এটা নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতোই নতুন একটি ‘কনসেপ্ট’! উল্লেখ্য, রওশনের পাশে বসে থাকা এরশাদকে সেদিন নিতান্ত এক বেচারা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়ানি। একটি কথাও বলেননি তিনি। তাকে এমনকি নিজের দল জাতীয় পার্টির এমপি ও নেতাদের সঙ্গেও হেসে কথা বলতে বা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে দেখা যায়নি। ওদিকে প্রথম অধিবেশনে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট। রীতি ও প্রথা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংসদের প্রথম অধিবেশনে তাকে ভাষণ দিতে হয়েছে। মূলত আওয়ামী লীগের নেতা এবং ‘বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ রাষ্ট্রপতি বলে অন্যরকম সম্ভাবনা ছিল না সত্য, কিন্তু তা সত্ত্বেও ধারণা করা হয়েছিল, তিনি অন্তত কথায় সংযমী হবেন। বক্তব্য রাখবেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত মহামান্য ব্যক্তি এবং জাতির অভিভাবকের মতো। অন্যদিকে ঠিক একজন অওয়ামী লীগের মেঠো নেতার মতো ভাষণ দিয়েছেন আবদুল হামিদ এডভোকেট। এমন একজন নেতার মতো, নেত্রীর সন্তুষ্টি, প্রশংসা এবং অনুগ্রহ অর্জনই যার প্রধান উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রপতির এই ভাষণ নিয়ে আলোচনার আগে অন্য কিছু কথা সেরে নেয়া যাক।
ভাষণসহ নানা নাটকীয়তার মাধ্যমে চমক দেখানোর চেষ্টা করা হলেও প্রথম অধিবেশনের কোনো কার্যক্রমই জনগণকে সামান্য আকর্ষণ করতে পারেনি। তাদের সমর্থন পাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। এর কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর দরকার নেই। আসল কারণ হলো, গলদ রয়েছে গোড়াতেই। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে যে হাস্যকর মহড়া করা হয়েছে সে মহড়ায় দু’-তিনটি মাত্র নামসর্বস্ব দলকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ একাই শুধু অংশ নিয়েছে। এজন্যই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়ার ধুম পড়ে গিয়েছিল। একটি ‘ফুল’ এবং একটি ‘হাফ’ সেঞ্চুরিও হাঁকানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৫৩ জন নির্বাচন না করেই ‘নির্বাচিত’ হয়ে গেছেন। এর ফলে প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়ার সুযোগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বাকি ১৪৭টি আসনের নির্বাচনও হাস্য-কৌতুকের সৃষ্টি করেছিল। কারণ, যে ৩৯০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের। কয়েকজন ছিলেন আওয়ামী মহাজোটের। যারা দলের মনোনয়ন পাননি তারা দাঁড়িয়েছিলেন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে। জিতে যাওয়ার পর বিদ্রোহীদের কয়েকজনকে ঘরের ছেলের মতো দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। তারাও নেত্রীর কাছে ফিরে যেতে পেরে ধন্য ও কৃতার্থ হয়ে গেছেন। এভাবে সংসদে আওয়ামী লীগ আবারও দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি, ২৩৫টি আসন দখল করেছে।
এত কিছুর মধ্যেও লক্ষণীয় প্রধান বিষয় ছিল জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টি। প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ভোটার ভোট দিয়েছে বলে দাবি করা হলেও মাঠ পর্যায়ের কোনো রিপোর্টেই পাঁচ শতংশের বেশি ভোট দেয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক কিছু কথা বলেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। নির্বাচন পরবর্তী এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, পরীক্ষায় মাত্র পাঁচ মার্ক পেলে যেখানে ফেল করার কথা সেখানে ফেল করা ব্যক্তিরা শুধু পাসই করেননি, ক্ষমতায়ও বসেছেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অধ্যাপক চৌধুরী বলেছেন, প্রায় নয় কোটি ভোটারের মধ্যে খুব বেশি হলে ভোট দিয়েছেন মাত্র ২০ লাখের মতো ভোটার। এদের শতকরা হার পাঁচ ভাগের বেশি নয়। কিন্তু এই ভোট পেয়েই ফেল করা ব্যক্তিরা সরকার গঠন করেছেন। এটা সম্ভব হওয়ার কারণ, তারা নিজেরাই খেলোয়াড়, রেফারি এবং লাইনসম্যান ছিলেন। একই ধরনের কথা বলেছেন আরো অনেকে। ক্ষমতাসীনরা তাই বলে পিছিয়ে যাননি, লজ্জিতও বোধ করেননি। প্রধানমন্ত্রী উল্টো বরং ৪০ শতাংশের এক উদ্ভট তত্ত্ব হাজির করেছেন। বলেছেন, দেশের ৪০ শতাংশ ভোটার নাকি তাদের ভোট দিয়েছে! কথাটা বলার সময় আহামরি ধরনের সাফল্যের পুলক অনুভব করলেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু লক্ষ্যই করেননি যে, ৪০ শতাংশ ভোটার যদি ভোট দিয়েও থাকে তারপরও সত্য হলো, ৬০ শতাংশ ভোটার ভোট দেয়নি। আর ৬০ শতাংশ নিশ্চয়ই ৪০ শতাংশের চাইতে অনেক বেশি! প্রকৃতপক্ষে জনগণ ক্ষমতাসীনদের সোজা ‘না’ বলে দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের আসলে পরাজয়ই ঘটেছে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেটও প্রধানমন্ত্রীর সুরে ও ভাষায় কথা বলেছেন। প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলে বসেছেন, বর্তমান সরকারকে দ্বিতীয়বার ‘নির্বাচিত’ করে জনগণ নাকি ‘ম্যান্ডেট’ দিয়েছে! রাষ্ট্রপতির কথাটাকে সত্য বলতে হলে বাস্তবে ‘ম্যান্ডেট’ শব্দের অর্থই কিন্তু পাল্টে ফেলতে হবে। কারণ, এরই মধ্যে প্রমাণিত সত্য হলো, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পাঁচ শতাংশের বেশি মানুষ ভোটই দেয়নি! তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি দিব্যি বলেছেন, নির্বাচন নাকি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে! অনেকাংশে অনুগ্রহ করে ‘বিভিন্ন প্রতিকূলতা’র কথা উল্লে¬খ করলেও তিনি এই সত্যের ধারেকাছেই যাননি যে, ওই নির্বাচনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলই অংশ নেয়নি। রাষ্ট্রপতির লক্ষ্য রাখা উচিত ছিল যে, তার নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও স্বীকার করেছেন, ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশ। যার অর্থ, বেশির ভাগ তথা ৬০ শতাংশ ভোটারই ভোট দিতে যাননি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর হিসাবকেও সচেতন সকল মহল প্রথম উপলক্ষেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। সে কারণে রাষ্ট্রপতির অবশ্যই সতর্ক থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি শুধু ‘ম্যান্ডেট’ পাওয়ার কথাই শোনাননি, একথা পর্যন্ত বলে বসেছেন যে, এক নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে আরেক নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নাকি এক ‘বিশাল অর্জন’! যেহেতু ‘বিশাল অর্জন’ করেই ফেলেছেন সেহেতু এরপর নির্বাচন নিয়ে আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না।
এ পর্যন্ত এসেও অবশ্য থেমে পড়েননি রাষ্ট্রপতি। গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা থেকে কথিত সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং পঞ্চদশ সংশোধনী ও কথিত যুদ্ধাপরাধীদের ‘নিরপেক্ষ’ বিচার প্রক্রিয়া পর্যন্ত এমন প্রতিটি বিষয়েও তিনি বলেছেন, যেগুলো প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সব সময় বলে থাকেন। শুধু বলেননি, বলেছেনও আবার ক্ষমতাসীনদের সুরে ও ভাষাতেই। একটি বিষয়ে তিনি এমনকি তার নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকেও ছাড়িয়ে গেছেন। বিগত পাঁচ বছরে তারা নাকি শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে হেঁটেছেন জানিয়ে রাষ্ট্রপতি নিজেদের দৃষ্টিকে ২০২১ সাল ছাড়িয়ে ২০৫০ সালের দিকে প্রসারিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। লক্ষণীয় যে, এতদিন নিজের সব স্বপ্নকে ২০২১ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে আসার পর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাত্র ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ ২০৪১ সাল পর্যন্ত স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির তার প্রথম ভাষণেই ‘হাফ সেঞ্চুরির’ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেনÑ দৃষ্টি প্রসারিত করতে বলেছেন ২০৫০ সাল পর্যন্ত। মানতেই হবে, জাতি অতি যোগ্য একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টাকে পেয়েছে বটে!
রাষ্ট্রপতি আহ্বান জানালেও জনগণের অবশ্য এত বেশি দূর পর্যন্ত দেখার সাধ্য নেই, ইচ্ছাও নেই। এর কারণ, আবারও ‘নির্বাচিত’ হয়ে আসার পর মুহূর্ত থেকেই সরকার গণতন্ত্রের যে ‘নমুনা’ দেখাতে শুরু করেছে, যে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি গণমাধ্যমেরও কণ্ঠ চেপে ধরতে শুরু করেছে এবং যেভাবে প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও নেতা-কর্মীদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে তারপর কোনো মানুষের পক্ষেই গণতন্ত্র বা সাংবিধানিক তথা আইনের শাসনের জন্য আশায় হা করে থাকা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। একই কারণে গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থে সরকারের সঙ্গে সংলাপ করার জন্য ‘নির্বাচন বর্জনকারী’ দলগুলোর প্রতি যে আহ্বান রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন সে আহ্বান অনুযায়ী সুফল পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে না। এমন বিশ্লে-ষণের ভিত্তিতেই বলা দরকার, রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাত অবসানের মাধ্যমে ‘সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান আসলে সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রতি জানালেই তিনি ভালো করতেন। এর মধ্য দিয়ে তার সদিচ্ছারও পরীক্ষা হয়ে যেতো। কিন্তু সেদিকে যাননি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট। এই না যাওয়ার কারণ, তাকে সব সময় মনে রাখতে হয়, তিনি কোন দল থেকে এসেছেন এবং ঠিক কোনজনার শুভেচ্ছা রয়েছে তার ‘বিশাল অর্জনের’ পেছনে!
সবশেষে বলা দরকার, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেটও জনগণকে নিরাশই করেছেন এবং মূলত ক্ষমতাসীনদের এই মনোভাবের কারণেই জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকা অনেক গভীর হয়েছে। নির্বাচনের নামে প্রহসনের যে কর্মকা- চালানো হয়েছে তার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে জনগণ। জনগণ একদলীয় এ নির্বাচনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। কথাটার তাৎপর্য অনুধাবন করা দরকার এজন্য যে, রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরাও একবাক্যে বলেছেন, ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হওয়ার এবং পাঁচ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশে প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটানো হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক সরকারের নামে ক্ষমতায় বসেছে স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী। নির্বাচনটিকে ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বড় কলঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত করে তারা আরো বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠূকে দিয়েছে। এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে, দেশের ভেতরে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থা নির্বাচনটিকে গ্রহণ করেনি। এমন প্রতিক্রিয়া সরকারের জন্য শুধু নয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্যও মোটেই শুভ নয়। কথাটা ক্ষমতাসীনরাও যে বোঝেননি তা নয়। কিন্তু মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেদ পূরণের উদ্দেশ্যেই তারা ভোটারবিহীন এ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। জেদও প্রধানমন্ত্রী বুঝে-শুনেই করেছিলেন। কারণ, সব জরিপ ও অনুসন্ধানেই জানা গিয়েছিল, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ কোনো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার পক্ষে ক্ষমতায় ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এজন্যই তারা সুচিন্তিভাবে উস্কানি দেয়ার মাধ্যমে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দিয়েছিলেন। তাছাড়া প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর পাশাপাশি তাদের পক্ষে দায়িত্ব পালন করেছে অথর্ব, মেরুদ-হীন ও সেবাদাস হিসেবে চিহ্নিত নির্বাচন কমিশন।
একই কারণে কথিত দশম সংসদ এবং নতুন সরকারও জনগণের চোখে কখনো বৈধতা অর্জন করতে পারবে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনসহ ঘটনাপ্রবাহে বরং আবারও প্রমাণিত হয়েছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। কথাটা ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্যরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই তাদের জন্য শুধু নয়, দেশের জন্যও মঙ্গল। মিষ্টি কথার আড়ালে চাটুকারিতাসহ সব কাজ ফেলে তাদের তাই সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার সংক্রান্ত একটি মাত্র বিধান যুক্ত করেই সরে পড়া উচিত। না হলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রচ- আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণই এ সংসদকে বিদায় করবে। মহামান্য কোনো রাষ্ট্রপতি কিংবা সবচেয়ে বিজ্ঞ কোনো স্পীকারও তখন কোনো কাজে আসতে পারবেন না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads