গত ৫ জানুয়ারির তামাশা ও প্রহসনের একদলীয় নির্বাচন-পরবর্তী এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি প্রবল চাপ ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আকস্মিক ও সুপরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর-বসতভিটা-মন্দির ও তাদের জানমালের ওপর আবারও ‘সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা অতর্কিতে হামলা চালিয়েছে। বর্তমান সরকারের বিদায়ী শাসনকালে কয়েক দফায় অসংখ্যবার এই ধরনের সাম্প্রদায়িক ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটলেও সরকারের করিৎকর্মা প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করতে বরাবরই ব্যর্থতা ও অপারগতা দেখিয়েছে। এমনকি রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক হামলার সময় প্রশাসনের নীরব ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে সরকারকেও দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। কোনো সঠিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই এই বৃহৎ দাঙ্গার ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোটের ওপর একতরফা দোষ চাপানোর অপচেষ্টা চললেও উল্টো রামুর স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা জড়িত ছিল বলে জোরেশোরে অভিযোগ উঠেছিল।
বিদায়ী বছরে শহীদ মিনার ভাংচুর করতে গিয়ে এক যুবলীগ কর্মী আটক হলেও পরে তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বা পাগল সাব্যস্ত করে ছেড়ে দেয়া হয়। ঠিক ঐ ঘটনার দিনই মন্দিরে আগুন লাগাতে গিয়ে আরো তিনজন যুবলীগ কর্মীর গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ পত্র-পত্রিকায় এলেও আদৌ তাদের বিচার হয়েছে এমন খবর পাওয়া যায়নি। এই নতুন বছরে আবারও বিশেষত প্রহসনের নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবার দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে শুরু হলো সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ-নির্যাতন। বরাবরের মতো এবারও সরকারের প্রশাসন ও গোয়েন্দা বাহিনী সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের ধরতে যারপরনাই ব্যর্থ হচ্ছে। অধিকন্তু চ্যানেল-২৪ তাদের নিউজ বুলেটিনে রীতিমতো বোমা ফাটানো সচিত্র প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে, আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে নেত্রকোনার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অন্যদিকে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা জামায়াত ঘটিয়েছেÑ এই অভিযোগ এখন সেøাগানে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু অনেক জায়গায় হামলার সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।’
মজার ব্যাপার হলো, বর্তমান সরকার যখনই বেকায়দায় ও বিপদে থাকে, তখনই দেশের বিভিন্ন স্থানে আকস্মিকভাবে সংখ্যালঘুদের সহায়-সম্পত্তি ও উপাসনালয়গুলোতে একযোগে আক্রমণের ঘটনা ঘটতে থাকে আর প্রতিবারই আক্রমণকারী সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার আগেই এসবের দায়ভার সরকার ও মিডিয়ার তরফে বিএনপি-জামায়াত জোটের ওপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এভাবেই মিডিয়া ও দেশবাসীর নজর ভিন্ন দিকে অর্থাৎ সাবোট্যাজ করতে সক্ষম হয় সরকার। এই কথা এখন সবার জানা যে, ক্ষমতাসীন সরকার তার প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে প্রায় সময়ই এই সংখ্যালঘু ট্রাম্পকার্ড ব্যবহার করে রাজনৈতিক মচ্ছব চালিয়ে আসছে।
ভাবনার বিষয় হলো, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও আক্রমণের ঘটনা ঘটে আকস্মিকভাবে এবং সুপরিকল্পিতভাবে। ব্যাপারটি এমন নয় যে, আমাদের জাতীয় মজ্জাগত সাম্প্রদায়িক চরিত্রের কারণেই এমনটি নিয়মিত ঘটে থাকে। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা প্রতিবেশী সংখ্যালঘুদের প্রতি যথেষ্ট সহনশীল ও অসাম্প্রদায়িক মননের অধিকারী। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহিংস ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি জাতিগতভাবেই আমরা পোষণ করি না। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও বর্বর নির্যাতন একটি নিয়মিত জাতিগত ঘটনা (যদিও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই বেশিরভাগ দাঙ্গার সূত্রপাত)। জাতিগতভাবেই তাদের ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক চরিত্র রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারটি একেবারেই ব্যতিক্রম। এই জনপদে আবহমানকাল ধরে মাওলানা-পুরোহিত-যাজক-ভান্তে, মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা, পুরাণ-কোরান-বাইবেল একই সাথে পাশাপাশি নির্বিঘেœ দিন কাটিয়েছে। এটা আমাদের হাজার বছরের সামাজিক ও ধর্মীয় পরমতসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি। আমাদের প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ইমেজ ও চরিত্র সবচেয়ে ভালো। শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে বৌদ্ধ মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের কবলে মুসলমানরা অসহায় ও অনিরাপদ অবস্থায় রয়েছে। পাকিস্তানে বিশেষ করে সেখানকার সংখ্যালঘু খৃস্টানরা এখন টার্গেটে রয়েছে। ভারতে কট্টর হিন্দু মৌলবাদ ও জঙ্গিপনার কাছে সেদেশের মুসলমানরা আরো মারাত্মকভাবে বিপন্ন। গুজরাটের দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমান নিহত হওয়ার ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ও অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদি এখন ভারতের সবচেয়ে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত। সে দেশের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠন বিজেপি সামনের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হবে একপ্রকার নিশ্চিত অনুমান। সেক্যুলার ভারতের এটাই প্রকৃত চেহারা। অথচ আমাদের দেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর রাজনৈতিক উত্থান নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তার কোনো অন্ত নেই। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-ভারত উভয়ের প্রপাগান্ডা ও এজেন্ডা স্বার্থের প্রশ্নে একই। বাংলাদেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের জুজু দেখিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে আওয়ামী লীগ ও ভারত সমান্তরালে কাজ করে থাকে। এদেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থান দেখানোর জন্য কৌশলে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও জানমালের ওপর সাজানো হামলার ঘটনা ঘটানো হয়, আর এরই বরাতে এদেশীয় ও ভারতীয় মিডিয়া এসবের দায়ভার ও অভিযোগ বিএনপিসহ এদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিয়ে একযোগে ক্যাম্পেইন চালায় যে, বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদী ও জঙ্গিদের হামলায় সংখ্যালঘুরা বিপদগ্রস্ত। এভাবে বিএনপি-জামায়াত জোট এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা ও সমর্থন হ্রাস পায়। এক্ষেত্রে নগদ রাজনৈতিক লাভটা হলো আওয়ামী লীগের। আর স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ যতক্ষণ ক্ষমতায় থাকবে ততক্ষণ এদেশে ভারতের স্বার্থও সংরক্ষিত হবে। এছাড়া বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা ভারতের অভ্যন্তরীণ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জন্যও অত্যন্ত সহায়ক ও অনুকূল পরস্থিতি তৈরি করবে। এ প্রসঙ্গে আমার শ্রদ্ধেয় সঞ্জীব চৌধুরী দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় খুব সুন্দরভাবেই লিখেছেন, ‘আমাদের দেশের মতো ভারতেও জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। ভোটের রাজনীতি সে দেশে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে হিন্দুবিরোধী সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে, এই তত্ত্ব যদি ভারতের হিন্দু ভোটারদের গেলানো যায়, তবে ভোটের প্রয়োজনে যারা হিন্দুত্ববাদী সেজে অতীতে লাভবান হয়েছে, তাদের সুবিধা। এই সুবিধা চেটেপুটে আদায় করে নেয়ার জন্যই ত্রিপুরা থেকে বিজেপি’র পক্ষ থেকে হুঙ্কার শোনা গিয়েছিল, বাংলাদেশে ‘বিপন্ন হিন্দুদের রক্ষা’র জন্য তারা আগরতলা থেকে হাজারে হাজারে ঢাকার দিকে ধেয়ে আসবে। শেষপর্যন্ত তাদের হুঙ্কার অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে। তবে এদের পক্ষ থেকে ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশী হিন্দুদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জনের বিরাম নেই। এই প্রচার চলতেই থাকবে ভোটের আগ পর্যন্ত, ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিয়ে ভোটের বাক্স ভরার প্রয়োজনে।’ (২৮ মার্চ ২০১৩, কারা বেশি বিপন্ন)। বহিঃশক্তি ও এদেশীয় একটি রাজনৈতিক চক্রের যৌথ কারসাজিতে আমাদের এই আবহমান জনপদের ঐতিহ্যবাহী ও ঈর্ষণীয় সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির চরিত্রকে কালিমাযুক্ত করার ষড়যন্ত্র আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
সরকার ও সরকারপন্থী মিডিয়াগুলো এখন সংখ্যালঘুদের ওপর গত কয়েকদিনের আততায়ী সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের হামলা ও নির্যাতনের ঘটনাবলীর দায় অপকৌশলে নির্বাচনবিরোধী ও নির্বাচন প্রতিহতকারীদের ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছে। বলা হচ্ছে, হিন্দুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক, তাই ৫ তারিখের প্রহসনের নির্বাচনে হিন্দুরা যেহেতু ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগকে, তাই এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নাকি বিএনপি-জামায়াত জোট সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালাচ্ছে। এগুলো অতি সরলীকরণ বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথাবার্তা ছাড়া আর কিছু নয়। যদি তা-ই হতো, তাহলে এখন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোটের সাথে সম্পৃক্ত এমন কাউকে কেন গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি? সরকার বুলডোজার দিয়ে জামায়াতের এমপি-নেতাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিচ্ছে। তাদেরকে আবাসন থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসন বিএনপি নেতাদের সর্বক্ষণ দৌড়ের ওপর রাখছে। যাকে বাগে পাচ্ছে তাকেই গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। মোদ্দা কথা, বিরোধী দল দমনে সরকার শতভাগ সফল। এমতাবস্থায় বিরোধী দলের পক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থান বা অঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে এই ধরনের ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটানো আদৌ সম্ভব কিনাÑসে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়। আর বিএনপি-জামায়াত জোট কি এতটাই নির্বোধ যে, সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করে সরকারের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে দেবে? গত বছর দেখা গেছে, এই রকম পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক হামলার প্রেক্ষাপটে জামায়াত-শিবিরের ওপর যখন দায় চাপানোর অপচেষ্টা হচ্ছিল, তখন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরাই উল্টো হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির এবং জানমালের পাহারা দিয়েছে রাতভর। তবুও তারা সাম্প্রদায়িক আর বিশ্বজিতের হত্যাকারী ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবরাই হচ্ছে খাঁটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বাহক(!)। সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!
মানবজমিন-এর একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, জয়পুরহাটে বাড়িতে আগুন দেখে আতঙ্কে মারা যান সুজেন চন্দ্র, স্বজনদের আহাজারি দেশের বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের অবস্থা জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাচ্ছেন বিভিন্ন জেলা প্রশাসক (ডিসি)। এসব চিঠি পেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো রীতিমতো হতবাক। ওইসব চিঠিতে, সংখ্যালঘু নির্যাতনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের পরোক্ষভাবে দায়ী করা হচ্ছে (১০ জানুয়ারি)। সুতরাং সঙ্গত কারণেই সন্দেহের তীর এখন আওয়ামী লীগের দিকেই বেশি। কেননা আওয়ামী লীগ অতীতের মতো সংখ্যালঘু ট্রাম্পকার্ড নিয়ে এখনো রাজনীতি করে। তাই দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত ও হামলার শিকার হলে আওয়ামী লীগ একদিকে যেমন সংখ্যালঘুদের জন্য মায়াকান্না দেখিয়ে ভোট বৃদ্ধি করে, তেমনি অন্যদিকে বিরোধী বিএনপিসহ সকল ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলকে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির জন্য দায়ীকরণপূর্বক তাদেরকে মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী প্রতীয়মান করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। সম্প্রতি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের হামলার দায় শুধু জামায়াত-শিবিরের ওপর চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না। স্থানীয় পূজা উদযাপন পরিষদের দেয়া তা-বকারীদের তালিকা আমার কাছে আছে। আপনারা ওইসব সরকারি গল্প আমাকে শোনাবেন না।’ উনিও তাহলে এতদিনে মূল সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন জেনে ভালোই লাগছে। আর না বললেই নয় যে, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সুযোগে ইসলামবিদ্বেষী তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মহল মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের জিগির তুলে এদেশের ইসলামী রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে কোণঠাসা করার জন্য দারুণ মওকা পেয়ে যায়। তারাও সংখ্যালঘুদের জন্য আবেগমাখা দরদ দেখিয়ে যেমন কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী প্রচার করে, তেমনি ইসলামপন্থীদের ভিলেন বানানোর অপপ্রয়াসও নেয়। ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে জামায়াত কিম্বা হেফাজত যা-ই বলুন, এদেশে ইসলামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উত্থান ও বিকাশ যাতে না ঘটেÑসেই তৎপরতায় তারা সর্বদাই ব্যতিব্যস্ত থাকে। এক কথায় তারা ইসলামকে এদেশে কোনো প্রকার সুযোগই দিতে নারাজ।
জামায়াত-শিবিরের কর্মী বা সমর্থক ভেবে হিন্দু বিশ্বজিৎকে অত্যন্ত বর্বরভাবে খোলা রাজপথে দিনের আলোতে মিডিয়ার সামনে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগের কর্মীরা। যদিও তখন নির্লজ্জের মতো সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা ছিল জামাত-শিবিরেরই লোক। কিন্তু স্পষ্ট ভিডিও ফুটেজের সামনে তাদের মিথ্যাচার ধোপে টেকেনি। অবশেষে মিডিয়া ও সুশীল মহলের চাপে বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের গ্রেফতার না করে সরকারের উপায় ছিল না। গত বছরের শেষদিকে তাদেরকে দ- দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রায় কার্যকরের কোনো বালাই নেই, তাই সবাই এটাকে এখন নিছক লোক দেখানো জাজমেন্ট ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছে না। গণজাগরণ মঞ্চ সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদ জানাতে রোডমার্চ করছে। কিন্তু বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার কোনো দাবি নিয়ে তারা সোচ্চার নয় কেন? তারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে তুলকালাম করলেও বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের ফাঁসি কার্যকরের ব্যাপারে একদমই নীরব ভূমিকা পালন করছে। আজকে মনে হয় এদেশে সংখ্যালঘুদের চেয়েও বেশি বিপন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। সত্যি এটা এক অবিশ্বাস্য চরম বাস্তবতা বটে। পথে-ঘাটে যেখানেই হোক, দাড়ি-টুপিওয়ালা হলেই হলো, সন্দেহভাজন হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। নিরীহ রাজনৈতিক আলেম-ওলামাদের জঙ্গি হিসেবে চিত্রিত করা হয়। আলেম-ওলামারা রাজনীতি করলে সেটা জঙ্গি ও মৌলবাদী হয়ে যায়। সংখ্যালঘুদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠরাও আজকে ভীষণ আতঙ্কিত ও ভীতির মধ্যে দিনযাপন করছে। ঘরে বাইরে সবখানে ভয়, দাড়ি-টুপিওয়ালারা ঘরের বাইরে বের হতে দ্বিধাবোধ করছেন। কেউ কেউ দাড়ি কামিয়ে ক্লিন শেভড হয়ে অথবা কেউ দাঁড়ি-টুপি পরিহার করে মডার্ন লেবাস ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সঞ্জীব চৌধুরী তাঁর নিজের ছেলের ক্ষেত্রেও একই কথা বলেছেন, ‘আমার পরিচিত উঠতি বয়সী মুসলমান ছেলেদের মধ্যে অন্তত ৫০ জন কয়েক দিনের মধ্যে দাড়ি কামিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হয়েছে প্রাণের দায়ে। এ তো গেল বাইরের কথা, আমার একমাত্র ছেলে বেশ কয়েক মাস হয় শখ করে দাড়ি রেখেছে। তার মা বকাবকি করে, আমি মেজাজ খারাপ করি, কিছুতেই খোঁচা খোঁচা দাড়ির প্রতি তার প্রেম কমে না। কয়েক দিন আগে বাসায় গিয়ে দেখি নিটোল দাড়ি কামানো চেহারা নিয়ে ছেলে আমাকে দরজা খুলে দিচ্ছে। বুঝলাম, সে ‘বিশ্বজিৎ’ হতে চাইছে না।’ এটাই এখন সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের বিপন্ন অবস্থার চিত্র।
পরিকল্পিতভাবে ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো যারাই ঘটিয়ে থাকুক, এদেশের প্রতিটি নাগরিককে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করার পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আততায়ী সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের মোকাবেলায় আজ দেশের সর্বস্তরের নাগরিকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠদেরকে আজ সংখ্যালঘুদের ভরসা ও আস্থা অর্জন করতে হবেÑযাতে করে সংখ্যালঘুরা এদেশের নাগরিক হিসেবে তাদের মাতৃভূমিতে নির্বিঘেœ ও নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারে। মূল কথা হচ্ছে, জনগণের ও সংখ্যালঘুদের জানমাল এবং তাদের উপাসনালয়গুলোর নিরাপত্তা বিধানে সরকার যেহেতু বারংবার ব্যর্থ হচ্ছে, সেহেতু এক্ষেত্রে বিরোধী দলও তার কর্তব্য ও দায় এড়াতে পারে না। শুধু রাজনৈতিক ব্লেমগেম খেললেই চলবে না। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের করণীয় হলো, অতিসত্বর দেশের হিন্দুস্থানীয় জেলা ও উপজেলাগুলোতে ‘সংখ্যালঘু রক্ষা কমিটি’ গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্গত সংখ্যালঘুদের পাশে তাদেরকে দাঁড়াতে হবে। সংখ্যালঘুদের জানমাল ও সহায়-সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যাবতীয় সহায়তা দান এখন দেশবাসীর কাম্য।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন