আজ বাংলাদেশে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম তামাশার নির্বাচন। এর আগেও দুইবার তামাশার নির্বাচন হয়েছে। সেগুলো হলো, প্রথমে ১৯৮৬ সালে। পরেরটি ১৯৯৬ সালে। কিন্তু এই দুটি প্রহসনের নির্বাচনেও ১৫৩টি কেন, ৫০টি আসনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হয়নি। কিন্তু এবার তাও হলো। এ ব্যাপারে একটি মজার কথা বলছি। গত শুক্রবার রাতে গ্রীন রোডে আমার বড় বোনের বাসায় কথা হচ্ছিল। আমার আরো কয়েক ভাই বোন এবং নিকট আত্মীয়রাও এসেছিল। এরা সকলেই মোটামুটি কাছাকাছি থাকে। একজন জিজ্ঞাসা করল, “৫ তারিখে ভোট কাকে দেবে?” আরেক জন একটি নাম বলল। তখন আমি বললাম, “তোমরা কেউ কাউকে ভোট দিতে পারবে না।” সকলে বিস্মিত মুখে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, “অবাক হচ্ছো কেন? তোমাদের কাউকেই ভোট দিতে হবে না। কারণ তোমাদের তরফ থেকে মিঃ এক্স (ছদ্ম নাম) ইতো মধ্যেই নির্বাচিত হয়ে গেছেন।” ওদের চোখে মুখে বিস্ময়, “ভোট দিলাম না, তারপরেও তিনি কেমন করে নির্বাচিত হলেন।” আমি বললাম, “সেটাই তো এবারের ইলেকশনের মাজেজা। এবারের ইলেকশনটা হলো একটি ম্যাজিক ইলেকশন। ভোট না দিলেও এমপি হওয়া যায়।” আমি আরো খোলাসা করে বললাম, “মিঃ এক্স বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সরকারকে এবং নির্বাচন কমিশনকে আমাদের এলাকায় ভোট দেয়ার এবং নেয়ার কোন তকলিফ করতে হয়নি। শুধু আমাদের মিঃ এক্স নয়, সারা বাংলাদেশে ১৫৩জন মিঃ এক্স বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।” উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে গেল। এটি তাদের কাছে অবিশ্বাস্য।
পত্রিকান্তরে গতকাল শনিবার প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক ৩০০টি আসনের মধ্যে যে ১৫৩টি আসনে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে সেখানে কেউ ভোট দেয়ার জন্য ভোট কেন্দ্রে যায়নি এবং কাউকে ভোট দিতেও হয়নি। তারপরেও আওয়ামী লীগ ১২৭টি এবং অবশিষ্ট সিটগুলোতে তার মিত্র দলগুলো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। ১৪৭টি আসনে এখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য নাকি চারদিকে সাজসাজ রব। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাম, ধাম এবং পরিচয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৪৭টি আসনের মধ্যে ১১৯টিতে নামকা-ওয়াস্তে ইলেকশন হচ্ছে। এই ১১৯টিতে আওয়ামী লীগ যে জিতবে সেটি তথাকথিত নির্বাচনের আগেই বলা যায়। ইতঃপূর্বে ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১২৭ জন আওয়ামী লীগের। এদের সাথে ৫ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন-নামক সাজানো নাটকে ১১৯ জন নির্বাচিত হলে তথাকথিত ১০ম জাতীয় সংসদে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সদস্য সংখ্যা হবে ২৪৬টি। অর্থাৎ মোট আসনের ৮২ শতাংশ। অন্য কথায় দুই তৃতীয়াংশ আসনের অনেক বেশি। এই সংখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে সূর্যকে পূর্ব দিকের পরিবর্তে পশ্চিম দিকে উদিত করাতে পারবে, আর পশ্চিম দিকের পরিবর্তে পূর্বদিকে অস্তমিত করাতে পারবে। এই বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ পুরুষকে নারী এবং নারীকে পুরুষ বানাতে পারবে।
আমি আগেই বলেছি যে, ১৪৭টির মধ্যে ১১৯টি আসনে আওয়ামী লীগের লোক দেখানো জয়লাভ আগেভাগেই ঠিক করা আছে। অবশিষ্ট রইলো মাত্র ২৮টি আসন। এই ২৮টি আসন আওয়ামী লীগ ইচ্ছা করলে আঙ্গুলের এক চুটকিতে দখল করতে পারে। কিন্তু সেটা লোকচক্ষে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু দেখায় বলে আওয়ামী লীগ ঐ ২৮টি আসন তার গৃহপালিত ৩টি দলের মধ্যে সিন্নি বিতরণের মতো বণ্টন করবে। এই ৩টি গৃহপালিত দল হলো, রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের একটি অংশ এবং সরকারি প্ররোচণায় গঠিত রওশন এরশাদ, আনিস মাহমুদ এবং বাবলুচক্রের জাতীয় পার্টি।
দেশের মোট ভোটার সংখ্যা ৯ কোটি ১৯ লাখ। গড়ে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ভোটার সংখ্যা হলো ৩ লাখ ৬ হাজার ৩৩৩। ইতোমধ্যেই ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ ১৫৩টি আসনের জন্য ৪ কোটি ৬৮ লাখ ৬৯ হাজার ভোটারকে ভোট দেয়া তো দূরের কথা, ভোটকেন্দ্রে যেতেও হয়নি। অথচ তাদের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে গেছেন। সোজা কথায়, আপসের মাধ্যমে যেভাবে আসন ভাগ বাটোয়ারা করা হয়েছে তার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার অর্থাৎ ৪ কোটি ৬৮ লাখ ৬৯ হাজার ভোটারের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। এখন ১৪৭টি আসনের জন্য ৪ কোটি ৫০ লাখ ৩১ হাজার ভোটারের ভোট দেয়ার কথা। এদের কত শতাংশ ভোটকেন্দ্রে যায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এসব কারণে এই নির্বাচন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ তামাশায় পরিণত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও এই তামাশার নজির মেলা ভার। অথচ তেমন একটি নির্বাচনের পেছনে খরচ হচ্ছে ৩শ’ কোটি টাকা। এমন একটি প্রহসনের নির্বাচনে রাখা হয়েছে ১৮ হাজার ১২৩টি ভোট কেন্দ্র। যে নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নাই, নাই কোনো উত্তেজনা, তেমন একটি নিরুত্তাপ নিরানন্দ নির্বাচনে সেনাবাহিনীসহ মোতায়েন করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৫০ হাজার সদস্য।
দুই
যে ১৫৩টি আসনে আসমান থেকে এমপি সাহেবানরা নাজেল হয়েছেন তাদের ব্যাপারে আর বেশি কিছু বলার নাই। কিন্তু যে ১৪৭টি আসনে নির্বাচন নামক একটি কৌতুক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে সেটির কি হবে? বিশ্ববাসীর নজর এখন কোন দিকে থাকবে? এই নির্বাচনে নির্বাচিত হবেন মোট ৩০০ সদস্য। এই ৩০০ সদস্য পরে ভোট দিয়ে সংরক্ষিত মহিলা আসনে আরো ৪৫ জন মহিলা সংসদ সদস্য নির্বাচন করবেন। বলা বাহুল্য, এই ৪৫ জনও সরকার দলীয় অথবা সরকারের গৃহপালিত বিরোধী দল থেকে হবে। মোট ৩৪৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে ১০ম পার্লামেন্ট। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ৩৪৫জন সংসদ সদস্যকে মোট ভোটারের কত শতাংশ ভোট দিয়ে এমপি বানাচ্ছেন।
আজকের নির্বাচনে অর্থাৎ ১৪৭ আসনের জন্য মোট ভোটার হলো ৪কোটি ৫০ লক্ষ ৩১ হাজার। এদের মধ্যে কত শতাংশ ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হবেন? এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন? দেশের শিক্ষিত মহল এবং পর্যবেক্ষক মহল এই প্রশ্নের দিকেই তাকিয়ে আছেন। বিশ্ব সম্প্রদায়ও এই প্রশ্নের দিকেই তাকিয়ে আছেন। গত তিন চার দিন হলো দেশে বিদেশে মিলে ২৫/৩০টি টেলিভিশন চ্যানেলে বলা হচ্ছে যে, এক তরফা এই নির্বাচনে সাধারণ মানুষদের কোনোই আগ্রহ নাই। কারণ তারা ভোটের ফলাফল জেনেই গেছেন। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা মনে করেন যে, ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতির সংখ্যা হবে অত্যন্ত নগণ্য। কারণ প্রথমত দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছেন। দ্বিতীয়ত সেই সব মানুষ মনে করেন যে, এটি হতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ পাতানো নির্বাচন। তাই তারা কেউ ভোট দিতে যাবেন না। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ জনগণের নাড়ির স্পন্দন শুনতে পাচ্ছেন। অর্থাৎ তারা জনগণের মনোভাব ঠিকই বুঝে গেছেন। সে কারণেই আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড এই ১৪৭টি আসনে সর্বাধিক সংখ্যক ভোটার হাজির করার জন্য তৃণমূল কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক কেন্দ্রের নির্দেশ পেয়ে তৃণমূল নেতারা যখন ভোটারদের দরজায় যাচ্ছেন তখন তারা একটি শীতল মনোভাব লক্ষ্য করছেন। তারা বুঝতে পারছেন যে, বিপুল সংখ্যক ভোটার আজ ভোট দিতে যাবেন না। ভোট দিতে না যাওয়ার কারণ দুইটি একটি হলো, এই নির্বাচনের ওপর থেকে তারা সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, দ্বিতীয়ত ভোট কেন্দ্রে যদি সহিংস ঘটনা ঘটে তাহলে তারা অযথা সেই সহিংস ঘটনার শিকার হতে চান না। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক ভোট কেন্দ্রে উপস্থিতির জন্য ভোটারদেরকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা নাকি টাকা সাধছেন। কিন্তু তাতেও কোন কাজ দিচ্ছে না।
টাকা ছড়ালেও ভোট কেন্দ্রে সর্বাধিক উপস্থিতির হার ৩৫% এর ওপরে হবেনা বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। যদি তাই হয় তাহলে সেটি মোট ভোটের মাত্র ১৭% হবে। অথচ সবচেয়ে ধিকৃত এবং নিন্দিত যে নির্বাচন, সেটি ছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। অথচ সেই নির্বাচনেও ভোট পড়েছিল ২৬.৫ শতাংশ। সেই নির্বাচন দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীর কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কয়েকদিন পরেই সেই সংসদ ভাঙ্গতে হয়েছিল এবং মাত্র চার মাস পর একই বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন নতুন করে নতুন সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল। আর আজকের নির্বাচনে যদি মোট ভোটের মাত্র ১৭ শতাংশ ভোট পড়ে তাহলে আইন গত এবং নৈতিক ভাবে এই নির্বাচন সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে এবং সেই সুবাদে বাতিল করতে হয়। আর বাতিল করলে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয়। পাঠক ভাইদের অবগতির জন্য বাংলাদেশের সবগুলো নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতির পরিসংখ্যান নি¤েœ উদ্ধৃত করছি। পরিসংখ্যানটি নির্বাচন কমিশন সূত্রে পাওয়া।
বছর উপস্থিতির শতকরা হার
১৯৭৩ ৫৫.৬
১৯৭৯ ৫১.৩
১৯৮৬ ৬৬.৩
১৯৮৮ ৫১.৮
১৯৯১ ৫৫.৫
১৯৯৬ (১৫ইফেব্রুয়ারী) ২৬.৫
১৯৯৬ (জুন ১২) ৭৫
২০০১ ৭৫.৬
২০০৮ ৮৭.১৩
এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি যে আরো কম হবে তার একটি বড় কারণ হলো এই যে, এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ চলছে। এছাড়াও গত শনিবার থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত ১৮ দল লাগাতার হরতাল ডেকেছে। নির্বাচনের দিন অর্থাৎ ৫ই জানুয়ারি হরতাল এবং অবরোধ উভয়ের আওতায় পড়বে। সহিংসতার ভয়ে অনেকেই ভোট দিতে যাবেন না। ইতোমধ্যেই অনেক জেলা উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদে ভোট কেন্দ্র ভিত্তিক প্রতিরোধ কমিটি বা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছে। এই সংগ্রাম কমিটি ভোটারদেরকে ভোট কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করছেন। তাদের এই নিষেধাজ্ঞারও একটি প্রভাব ভোটার উপস্থিতির ওপর পড়বে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন।
এছাড়া গতকাল অর্থাৎ শনিবার একসাথে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং সিনিয়ার ভাইস চেয়ারম্যান বেগম জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের দুটি বিবৃতি সংবাদ পত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। ঐ দুটি বিবৃতিতে জনগণকে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় এই প্রহসনের নির্বাচন সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ করার জন্য যিনি যেখানে আছেন তাকে সেখান থেকেই প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানানো হয়েছে। গতকাল বিকেলে মাতা এবং পুত্রের এই বিবৃতির দারুণ প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। অনেককেই বলতে শোনা গেছে যে, বেগম জিয়াকে গৃহ বন্দ রেখে এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরতে না দিয়ে এবং বিএনপি ও জামায়াতের সমস্ত শীর্ষ নেতাকে কারাগারে আটকে রেখে যে নির্বাচন হচ্ছে সেই নির্বাচনে বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠী মোটেই সায় দিতে পারে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন