রবিউল আউয়াল মাস এলে আমরা প্রিয় নবীর কথা বেশি করে স্মরণ করি। যদিও আমরা এ কথা জানি যে, নবী (সা.)-এর স্মরণ বিশেষ কোনো দিন বা মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নবী তো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন জীবনযাপনের বার্তা। এই বার্তা ছিল পরিপূর্ণ ও চিরায়ত। যার প্রমাণ পাওয়া যায় মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণ দেয়ার ঐতিহাসিক মুহূর্তে। সে সময় মহান আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে মহানবী (সা.)কে একথা জানিয়ে দিলেন যে, আজ তোমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দেয়া হলো। এ কারণে আমরা বলে থাকি যে, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। মানুষের ব্যক্তি জীবন থেকে আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত এমন কোনো দিক ও বিভাগ নেই যা পবিত্র কুরআন এবং রাসূলের হাদীসে বর্ণিত নেই। ইসলাম সম্পর্কে আজকাল অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন। ব্যক্তি যখন কোনো কথা বলেন, তখন তিনি তার সীমাবদ্ধতা নিয়েই কথা বলেন। ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা শুধু জ্ঞানে নয়, উপলব্ধি ও স্বার্থ চিন্তার সীমাবদ্ধতাও এখানে উল্লেখযোগ্য। আর মহান আল্লাহ তো পবিত্র কুরআনে একথা স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিল যে, আমি মানুষকে জ্ঞানের খুব অল্পই দিয়েছি। তাই মানুষ যখন জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজ নিজ তত্ত্ব জাহির করে বাক-বিত-ায় লিপ্ত হয়, তখন অল্প বিদ্যার ভয়ঙ্করী রূপ লক্ষ্য করা যায়। সেই ভয়ঙ্কর রূপে বিপর্যস্ত আজ বিশ্ব এবং প্রিয় স্বদেশ ভূমিও।
এই পৃথিবীতে আমরা রাজ-রাজরাদের যুদ্ধ দেখেছি, রাজনীতির বাতাবরণে জোটবদ্ধ শক্তির ছত্রছায়ায় প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ দেখেছি, ঐতিহাসিক দাম্ভিক বস্তুবাদের বাতাবরণে লক্ষ্য করেছি শ্রেণিসংগ্রামের রাজনীতি, আর পুঁজিবাদের প্রতাপ তো এখনও অব্যাহত রয়েছে। এত তত্ত্ব, এত দর্শন, এত রাজনীতি তারপরেও মানুষ পেলো না শান্তির সুবাতাস। এত কর্মযজ্ঞের পরেও একথাই প্রমাণিত হলো যে, অল্প জ্ঞানের মানুষ মহাজ্ঞানী আল্লাহর ‘ওহীজ্ঞানকে অগ্রাহ্য করার কারণে বিভ্রান্তির সাগরে শুধু হাবুডুবুই খাচ্ছে। গত শতাব্দীতে ¯œায়ুযুদ্ধের বাতাবরণে আমরা লক্ষ্য করেছি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রাণান্তকর অস্ত্র প্রতিযোগিতা। একদিকে তৃতীয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মানবেতর জীবনযাপন, অন্যদিকে লক্ষ্য করা গেছে বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে মারণাস্ত্র তৈরির নিত্যনতুন প্রতিযোগিতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন খ--বিখ- হওয়ার পর আমরা লক্ষ্য করলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক দানবীয় মূর্তি। ইসরাইলের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে তটস্থ করে রেখেছে আমেরিকা। এরপর দেখলাম ইরাক, আফগানিস্তান ও মিসর ট্র্যাজেডি। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এক সময় নিজেদেরকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে শরীক করেছিল। রাশিয়ার সাথেও বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করেছিল। এখন সেই ভারতই নিজেকে পরাশক্তি হিসেবে জাহির করতে চাইছে। দেশটির হুমকিÑধমকিতে প্রতিবেশী দেশগুলো অস্থির। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই সাধারণ নাগরিকরা নিহত হচ্ছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিএসএফ) হামলায়। আর কাঁটাতারের বেড়ায় কিশোরী ফেলানির ঝুলন্ত লাশ তো ভারতের আগ্রাসনের নিকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে রয়েছে। সিকিমকে গ্রাসের পর ভারতের আগ্রাসনে নেপাল পতিত হয়েছে এক করুণ অবস্থায়। জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াউর রহমানের যোগ্য নেতৃত্বে ঐক্য ও সংহতির চেতনায় বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, স্বাধীনতার ৪২ বছর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির আবর্তে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অহঙ্কার এখন বিবর্ণ হতে চলেছে। আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারত যেভাবে নাক গলিয়েছে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ নিয়েছে তাতে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছে দেশের মানুষ। বিরোধী দলবিহীন ও ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিজয়ের পর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন টেলিফোন বার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দৃঢ়ভাবে হাল ধরার পরামর্শ দেন। টেলিফোন বার্তায় তিনি আরও বলেন, দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মূল ¯্রােতে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের গুরুত্ব এবং জোরের জায়গা আরও বাড়বে। পায়ের তলায় লড়াইয়ের বাড়তি জমিটুকু পাবে হিন্দু সম্প্রদায়। তিনি আরও বলেন, ক্ষমতায় আসার পর আর কোনোরকম নরম মনোভাব না নিয়ে শক্ত হাতে বিরোধী দলের সবরকম আন্দোলন রুখতে হবে হাসিনা সরকারকে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার এমন বার্তায় উপলব্ধি করা যায়, ভারত প্রতিবেশী দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে কতটা মূল্য দেয়। আরো পরিতাপের বিষয় হলো এই যে, বাংলাদেশের জনগণের ৯০ শতাংশ মুসলমান হওয়ার পরেও এ দেশে চলছে ক্ষমতার দুর্বৃত্তায়ন। সরকার বিরোধী দলের ওপর চালাচ্ছে জুলুম-নির্যাতন। বিভিন্ন বাহিনীর বেপরোয়া গুলীবর্ষণে পাখির মতো নিহত হচ্ছে দেশের নাগরিকরা। বিক্ষুব্ধ বিরোধী দলের রাজপথের আন্দোলনে, হরতাল-অবরোধে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে মানুষকে। এ কেমন রাজনীতি, এ কেমন দেশ পরিচালনা? সুশাসন ও সুষ্ঠু রাজনীতির অভাবে দেশের মানুষ এক অস্বস্তিকর পরিবেশে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। এজন্য তো মানুষ সামজবদ্ধ হয়নি, রাষ্ট্র গঠন করেনি। মানুষ তো সমাজবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র গঠন করেছে উন্নত নীতি-নৈতিকতার মাধ্যমে সমৃদ্ধ জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে।
আমাদের বর্তমান শাসন-প্রশাসন ও রাজনীতির মাধ্যমে তেমন লক্ষ্য অর্জন যে সম্ভব নয় তা ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। এরপরও আমরা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করছি, সিরাতুন্নবী বা মিলাদুন্নবী পালন করছি। কথা-কাজের গরমিলের কারণে আমাদের রাজনীতিতে যেমন সুবাতাস বইছে না, তেমনি কথা-কাজের গরমিলের কারণে মুসলমানদের আচরণেও এখন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তেমন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এ কারণে রবিউল আউয়াল মাস যেন এখন আসা-যাওয়ার একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ মাসে যে নবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর বার্তা আমরা আমাদের জীবন-যাপনে অনুসরণ করছি না। তারপরও আমরা নিজেদের নবীর উম্মত হিসেবে দাবি করছি। এ দাবি যথার্থ হচ্ছে কি না তেমন আত্মসমালোচনা এখন খুবই জরুরি।
বর্তমান সময়ের আরেকটি ট্রাজেডি হলো, আমরা সীমিত জ্ঞানের মানব রচিত তত্ত্ব এবং ¯্রষ্টা প্রেরিত নির্ভুল ওহী জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি সঠিক মাত্রায় উপলব্ধি করতে পারছি না। এ কারণেই আজকাল মুসলমানরাও অর্থনৈতিক জ্ঞানের জন্য একদিকে দৌড়ায় তো রাজনীতির জ্ঞানের জন্য দৌড়ায় অন্যদিকে, সংস্কৃতির জ্ঞানের জন্য দৌড়ায় আবার অপরদিকে। এতে বিভ্রান্তি ও বিভেদের মাত্রাই শুধু বাড়ছে। অথচ মুসলমানরা নিজেদেরকে যার উম্মত হিসেবে দাবি করছে, সেই নবীর সমাজ ও রাষ্ট্র পরিগঠনের দিকে তাকালে নিজেদের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের দিকনির্দেশনা তারা পেয়ে যেতো। ইসলামের নবী আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সমাজকে একটি আলোকময় শান্তির সমাজে পরিণত করেছিল। আর বর্তমান সময়েও আমরা যেন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বাতাবরণে আলো ঝলমলে এক জাহেলিয়াতের যুগে প্রবেশ করছি। আমরা যখন নবী (সা.)-এর কথা উচ্চারণ করি তখন অনেকেই মনে করেন, তিনি শুধু মুসলমানদের নবী। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, নবী মুহাম্মদ (সা.) সমগ্র মানব জাতির নবী। এবং তিনি সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত স্বরূপ। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)এর আগমন বার্তা উল্লেখিত হয়েছে। তাঁর আবির্ভাবের সময় এ পৃথিবীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্ম প্রচলিত ছিল। হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ-পুরানে, বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক ও দিঘানিয়াতে রাসূল (সা.)Ñএর আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তওরাত ও খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ ইনজিলে রাসূল (সা.)-এর গুণাবলী এবং তার শুভাগমনের ভবিষ্যদ্বাণী সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। বেদ-পুরান এবং উপনিষদ হিন্দুদের বিশিষ্ট ধর্মগ্রন্থ। এসব প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে আল্লাহ্, রাসূল, মুহাম্মদ ইত্যাদি শব্দগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ভবিষ্যৎ পুরানে আছে :
এতল্লিন্নন্তরে স্লেছ আচার্যেন সমন্বিত
মহামদ ইতি খ্যাত মিষ্যশাকাসমন্বিত ॥৫॥
নমস্তে গিরিজানাথ মরুস্থল, নিবাসিনে
ত্রিপুরা, সুরনাশায় বহুমায়া প্রবর্তিনে ॥ ৭॥
অর্থাৎ ঠিক সে সময়ে মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি যার বাস মরুস্থলে (আরব দেশে) আপন দলবলসহ আবির্ভূত হবেন। হে আরবের প্রভু, হে জগৎ গুরু, তোমার প্রতি আমার স্তূতিবাদ। তুমি জগতের সমুদয় কলুষ দূর করার বহু উপায় জান, তোমাকে নমস্কার। হে পবিত্র পুরুষ! আমি তোমার দাস। আমাকে তোমার চরণ তলে স্থান দাও।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উদাহরণের সংখ্যা আরো বাড়ানো যায়, কিন্তু আজ আর অগ্রসর হতে চাচ্ছি না। আজ শুধু জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বক্তব্য উদ্ধৃত করে মুসলমানদের উদ্দেশে বলতে চাই
শুকনো রুটিরে সম্বল ক’রে
যে ঈমান আর যে প্রাণের জোরে
ফিরেছি জগৎ মন্থন ক’রে
সে শক্তি আজ ফিরিয়ে আন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন