রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৪

সময় এখন শোধরানোর

  জানুয়ারি ২০১৪ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ইতিহাসে দিনটি এ দেশের মানুষ স্মরণ করবে কিভাবে তা বলা মুশকিল। এই দিন আমাদের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দিন। ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন, বিরোধী দলবিহীন এ নির্বাচন নিয়ে নানা মহলে নানা কথা। কারণ বিস্ময়কর এমন নির্বাচন কেউ এর আগে দেখেননি। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে সরকারি জোটের প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। বাকি ১৪৭ আসনে চলেছে পাতানো নির্বাচনী খেলা। আসন নিজেদের মধ্যে আপসে ভাগাভাগি করে নেয়ার খেলা।
পাকিস্তানভিত্তিক প্রভাবশালী দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারের অনলাইন সংস্করণে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখেছেন। পয়েন্টলেস পোলস ইন বাংলাদেশতথা বাংলাদেশের অর্থহীন নির্বাচনশিরোনাম দিয়ে এ লেখায় তিনি মন্তব্য করেছেন ‘ভাগ্যের বদল হয়, কোনো সন্দেহ নেই। আজ যে শাসক, কাল সে প্রতিপক্ষ। এর পরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসা দৃশ্যমান। একজন স্বৈরশাসক তো খারাপ বটেই; কিন্তু তা আরো খারাপ হয়, যখন তিনি ক্ষমতা ছাড়তে চান না। এটি বাংলাদেশের একটি জটিল সমস্যা। বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিল। এর বদলে শেখ হাসিনা তার সরকারের অধীনেই নির্বাচন সম্পন্ন করেন। এর আগে সংবিধান সংশোধন করে বাতিল করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। প্রহসনের এ নির্বাচনে একটিও ভোট পড়ার আগে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ১৫৪ জন প্রার্থী। আর একতরফা ভোটে আরো ১০৩ জন।তিনি আরো লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের একটি দৈনিক সংবাদপত্রের চালানো মতামত জরিপে দেখা গেছে, ৭৭ শতাংশ মানুষই ছিল এ নির্বাচনের বিপক্ষে। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল (নিবন্ধিত ৪০ দলের মধ্যে ২৮ দল) নির্বাচন বর্জন করেছে এবং নতুন সরকারকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তখন হাসিনার এ বিজয় কোনো অর্থ বহন করে না।
অপর দিকে ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত ব্যাকিং বাংলাদেশশিরোনামে মতামত কলামে সিএনএন-আইবিএনের ফরেন এডিটর সুহাসিনী হায়দার মন্তব্য করেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সংসদে ফিরে গেছেন, সেখানে এখন শুধু তার নিজের কণ্ঠস্বরেরই প্রতিধ্বনি হবে। কিন্তু সে প্রতিধ্বনি হবে সারশূন্য, যেমন সারশূন্য ছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। যেকোনো বিবেচনায় বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেশটির গণতন্ত্রের জন্য চরম নেতিবাচক মুহূর্ত। আঠারোদলীয় জোট নির্বাচন বয়কট করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ যেসব আসনে বিজয়ী হয়েছে, সেগুলোর অর্ধেকেই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। বাকি যেসব আসনের নির্বাচনে মাত্র ২২-৩০ শতাংশ ভোট পড়েছে, সেখানেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ছিলেন প্রায় অপরিচিত মুখ। সংসদে হয়তো কাগজে-কলমে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন শেখ হাসিনা, কিন্তু বাস্তবে তিন-চতুর্থাংশ ভোটার ভোটই দেননি।
এ দিকে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে ‘গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে। গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে নতুন সরকারের বৈধতা প্রশ্নযোগ্য বা সরাসরি অবৈধ। ওই সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশকে ভারতের জন্য একটি সঙ্কট হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়, এ মুহূর্তে ভারতের জন্য অন্যতম বৃহৎ সঙ্কটটির নাম : বাংলাদেশ।
এভাবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল বাংলাদেশে নতুন সরকারকে নানাভাবে নানা বার্তা দিয়ে বাস্তবতা উপলব্ধি করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা গড়ে তুলে যথাসম্ভব দ্রুত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি দলের নেতাকর্মীরা সে ব্যাপারে বেখেয়াল। নতুন সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী-এমপিরা দম্ভভরে বলছেন, এ সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে। এ পাঁচ বছরে কোনো নির্বাচন নয়, সংলাপও নয়। কেউ বলছেন, আগামী পাঁচ বছর নয়, এ সরকার ক্ষমতায় থাকবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। কেউ কেউ কৌতুক করে বলছেন, আজ ২০১৪ সাল। ১৪-কে উল্টো করে লিখলে হয় ৪১। অতএব এ সরকার ক্ষমতায় থাকবে ২০৪১ সাল পর্যন্ত। সে জন্যই আওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১’-কে সম্প্রসারিত করে করা হয়েছে রূপকল্প ২০৪১। আসলে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিজয়ীদের মাথায় এ ধরনের চিন্তাভাবনাই বাসা বেঁধেছে। তাই আওয়ামী লীগের এসব নেতা এখন উৎসবে মেতেছেন।
এ উৎসবের নানা মাত্রা এরই মধ্যে দেশবাসী দেখতে শুরু করেছেন। চার দিক থেকে যখন বলা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচন আওয়ামী লীগের কপালে এঁকে দিয়েছে এক কলঙ্কতিলক, তখন এ নির্বাচনে বিজয়ীরা নিজ নিজ এলাকায় গণসংবর্ধনার নামে কার্যত মেতে উঠেছেন উৎসবে। এ উৎসব খালি মাঠে গোল দেয়ার আওয়ামী উৎসব। এরই মধ্যে এসব উৎসব পালনের পদ্ধতি-প্রক্রিয়া নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। সমালোচনার ঝড়। তা ছাড়া এ কিসের বিজয় উৎসব, যেখানে নেই সত্যিকারের কোনো বিজয়। ভারতের পত্রিকা দ্য হিন্দু গত ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশে কোনো পক্ষই জয়ী হয়নি। নো রিয়েল উইনার ইন বাংলাদেশশীর্ষক সম্পাদকীয়তে এ মন্তব্য করেছে। অপর দিকে কারো মূল্যায়ন : এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলে হেরেছে বাংলাদেশ। কারণ এ নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমর্যাদা তলানিতে নিয়ে নামিয়েছে।
কিন্তু কে শুনে কার কথা। কারণ এখন সময়টা যে আওয়ামী উৎসবে মেতে ওঠার। গত শুক্রবার রাজশাহীর বাঘায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সংবর্ধনা উৎসব নিয়ে ইতোমধ্যেই সমালোচনার পাত্র হয়ে উঠেছেন তিনি। নেতাদের হাত সোনার নৌকায়, শিশুরা না খেয়ে রাস্তায়শীর্ষক প্রতিবেদনে পরদিন দৈনিক প্রথম আলো জানায় ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে মন্ত্রী-সাংসদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার চলছেই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে রাস্তায় কষ্ট দিয়ে মন্ত্রী-সাংসদেরা নিজ এলাকায় সংবর্ধনা নিচ্ছেন। গ্রহণ করছেন সোনার নৌকা উপহার।গত শুক্রবার রাজশাহীর বাঘায় শাহরিয়ার আলমকে স্বাগত জানাতে কয়েক শশিক্ষার্থীকে দুপুরে না খেয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে তাদের রাস্তায় নামান আয়োজকেরা। দিনাজপুরের পাবর্তীপুর উপজেলার ২০৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় গত শনিবার ছুটি ঘোষণা করা হয়। কারণ দিনাজপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানকে সংবর্ধনা দেবে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। তা ছাড়া প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সংবর্ধনা দিতে চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় বিভিন্ন সড়কে অর্ধশতাধিক তোরণ নির্মাণ করা হয়। ময়মনসিংহ-২ আসনের বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শরীফ আহমেদ তার এলাকায় আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দুইটি সোনার নৌকা পেয়েছেন। এভাবে নাটোর-১ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সংসদ সদস্য আবুল কালাম আযাদও পেয়েছেন সোনার নৌকা উপহার। এ দিকে গত শনিবার ফেনীতে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ আরো কয়েকজন স্থানীয় সংসদ সদস্যকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এ জন্য গত মঙ্গলবার থেকে নগরীর একটি প্রধান সড়কের অর্থাৎ ট্রাংক রোডের একাংশে বন্ধ করে দেয়া হয় যান চলাচল। এভাবে সারা দেশে চলছে সংবর্ধনা দেয়ার মহোৎসব। স্কুল বন্ধ করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে রাজনৈতিক দলবিশেষের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নামানো কতটুকু নৈতিক, সে প্রশ্ন বিবেচনায় আনছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। অথচ এদের সোচ্চার হতে দেখেছি, হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে মাদরাসাছাত্রদের আনার বিরুদ্ধে।
এই সময়টায় সরকারি নেতা-নেত্রীরা তাদের কথাবার্তায় দেশবাসীকে যে বার্তাটি দিচ্ছেন, তা হলো বিরোধী দল দমনে সরকার যত কঠোর হওয়া দরকার তত কঠোর হবে। আর দ্রুত কোনো নির্বাচন দেয়া হবে না। সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে। অতএব নির্বাচন নিয়ে আর সংলাপ নয়। সরকার এখন দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাবে; কিন্তু সরকারকে একটা কথা উপলব্ধিতে রাখতে হবে একটি দেশের উন্নয়নের জন্য কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত একটি সরকার অস্তিত্বশীল থাকা। পাশাপাশি উন্নয়নের চাকা সচল থাকার জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে এ দুটি নিয়ামকেরই অভাব প্রবল। বর্তমান সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ফসল। আর সে নির্বাচনে যে জনসংশ্লিষ্ট ছিল না, সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, সে নির্বাচন যে ছিল একটা প্রহসনের নির্বাচন তা এ সরকারের শত্রু-মিত্র সবাই স্বীকার করেন। অতএব এ নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে তোলা সরকার দিয়ে কখনোই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কারণ এ সরকারের দেয়া কর্মসূচিতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কখনোই আশা করা যায় না। আজকে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্টের যেসব লক্ষ্য অর্জনের কথা সরকারপক্ষ বলেছে, এর সফলতার পেছনে রয়েছে ১৯৯০-উত্তর দুই দশকের সরকারগুলোর সম্মিলিত প্রয়াস। এই দুই দশককে আমরা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলাম বলেই এ সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি। এটি একক কোনো সরকারের সাফল্য নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন তাই বলছে; কিন্তু দুঃখজনক হলো, বর্তমান সরকার তাকে শুধু এ সরকারের সাফল্য বলে দাবি করছে। এখন দেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের বর্জন করা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার দিয়ে সে উন্নয়নের কথা ভাবাও পাপ। অতএব দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন। দেশের সচেতন মানুষের এটি ভিন্ন কোনো উচ্চারণ নেই।
গতকালের সব খবরের কাগজে দেখলাম আগের দিন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০১৩-১৪ দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনাবিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, একটি সুষ্ঠু, আস্থাভাজন, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে। সিপিডি ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, এ সঙ্কট দূর করতে হলে রাজনৈতিক বিরোধীদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে বিনিয়োগ ও আস্থার সঙ্কট কাটবে না। সিপিডি গবেষণাপত্র এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি গবেষণাপত্র উপস্থাপনের শুরুতেই বলেন, জনপ্রত্যাশা ও অর্থনীতির শক্তির ভিত্তিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি হারিয়ে গেছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির সেই সম্ভাবনা ফিরিয়ে আনা বর্তমান সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য অর্থনীতিকে মাশুল গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে অর্থনীতির গতি একেবারে শ্লথ হয়ে পড়েছে। ঘোষিত বাজেটের আয় ও ব্যয় অনেক কমে গেছে। নানা সঙ্কটে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের সহজলভ্যতা থাকলেও বাংলাদেশের খাদ্য মজুদ কমেছে। অপর দিকে খাদ্যমূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। তা ছাড়া নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংক খাত নাজুক অবস্থা পার করছে। এ দিকে অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ায় সরকারের রাজস্ব আয়ও বড় ধরনের ধসের মুখে পড়েছে।
অপর দিকে বিরোধী জোটবিহীন নির্বাচনের পর বাংলাদেশ কোন পথে যাচ্ছে তা বিশ্লেষণে গত শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আয়োজিত আলোচনাসভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা সবাই জানি সমাধান কীকিন্তু বাস্তবায়ন করি না। স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য সমঝোতার বিকল্প নেই। একই অনুষ্ঠানে নতুন সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে দেশের অগ্রগতি নিয়ে কাজ করার কথা জানান। এ ব্যাপারে তিনি বিএনপির সহযোগিতা চাইলেন; কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? আমরা দেখছি, তার সরকারের একলা চলোনীতি। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী। এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায় না। বিএনপি নেত্রী স্বাধীনতাবিরোধী; কিন্তু পত্রপত্রিকায় অনলাইন জরিপে দেখলাম সরকারপক্ষের এ ধরনের বক্তব্য ৯৯ শতাংশেরও বেশি মানুষ বিশ্বাস করেন না। যেখানে দেশের ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দলই নির্বাচন বর্জন করেছে, সেখানে তাদের স্বাধীনতাবিরোধী বলে চিহ্নিত করার অপর অর্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিকতাকেই বিতর্কিত করা। আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে যে এ উপলব্ধি থাকবে না, সে কথা ভাবা যায় না। কারণ এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় দল।
নির্বাচনোত্তর সময়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়ন চলছে, এর ফলে বিরোধী জোটের লাখ লাখ নেতাকর্মী এখন ফেরারি। নির্বাচন-পূর্ব হরতাল-অবরোধ আর রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ঘিরে সারা দেশে দায়ের করা হয় শত শত মামলা। খবরে প্রকাশ, এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে অন্তত আট লাখ মানুষকে। নির্বাচনের পর সরকারি জোটের সব নেতার মুখে একই কথাÑ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সন্ত্রাসী। এদের দমনে যত কঠোর হওয়া দরকার, তত কঠোর হবো।বাস্তবে ঘটছে তেমনটিই। যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে বিরোধী দল দমনপীড়ন যেভাবে চলছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে সোচ্চার। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিশ্ব প্রতিবেদন-২০১৪শীর্ষক পর্যালোচনায় বলেছেÑ ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উল্টো দিকে ধাবিত হয়েছে। নাগরিকসমাজ, মিডিয়া আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর কঠোর অভিযান চালিয়েছে সরকার। এ প্রতিবেদনে ২০১৪ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখ না থাকলেও সরকারের এই কঠোর অভিযান যে নতুন বছরে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে, তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জনসভায় বিরোধী দল দমনে কঠোর হওয়ার কথা বারবার উচ্চারণ করছেন। ফলে মনে হচ্ছে এ প্রবণতা অব্যাহত থাকবে আগামী দিনেও। যেখানে তিনি কথায় কথায় বিরোধীদলীয় নেত্রীকে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার প্রেসক্রিপশন দেন, সেখানে সমঝোতার আশা দূরীভূত হয় বৈকি!
এটি সমাধানের পথ নয়, বরং সমস্যা-সঙ্কটকে আরো জটিল করে তোলার পথ। এ পথে সরকার নিজেও ক্ষতির মুখে পড়বে, দেশ-জাতিকেও পিছিয়ে নেবে। একটি সরকারের সাফল্য নির্ভর করে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল-জোটকে কতটুকু আস্থায় আনতে পারল, বিরোধীদের সাথে কী মাত্রায় সমঝোতা সৃষ্টি করতে পারল তার ওপর। সে উপলব্ধির বাইরে গিয়ে সরকার একলা চলোনীতি অবলম্বন করে আমরা আর মামুরানিয়ে চলতে থাকলে সরকারের ব্যর্থতার পাল্লাই আরো ভারী হবে। সরকারকে উপলব্ধিতে রাখতে হবেÑ ভোটারবিহীন ও বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন যেমন কারো কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনই এ ধরনের নির্বাচনসূত্রে গঠিত সরকারও গ্রহণযোগ্য হয় না, দেশের ভেতরে ও বাইরে, তা সেই সরকার আইনি বিবেচনায় যত বৈধই হোক না কেন। অতএব সময় এখন শোধরানোর। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যথাসম্ভব দ্রুত আয়োজন ছাড়া সামনে পা বাড়ানোর কোনো সুযোগ আমাদের নেই। কারণ এ পথে চলা ছাড়া দেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চিন্তা করা যায় না। আর স্থিতিশীলতা ফিরে না এলে উন্নয়ন অসম্ভব, অসম্ভব এবং অসম্ভব।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads