সোনাভান পুঁথির শায়ের ছিলেন ফকির গরীবুল্লাহ। হুগলি জেলার অধিবাসী এই শায়ের সতর শতকের শুরুর দিকে রচনা করেছিলেন তার সোনাভান পুঁথিটি। কবিদের কল্পনার পাখা নাকি পাহাড় পর্বতের বাধা ভেদ করতে দ্বিধা করে না। তারা পৃথিবীর এই প্রান্তে বসে অপরপ্রান্তের চিত্র আঁকতে পারদর্শী। আঁকেনও চমৎকার। এই চমৎকারীত্ব পাঠককে চমকিত করে, স্বচকিতও করে মাঝেমধ্যে। শায়ের বা কবিদের বর্ণিত দৃশ্যাবলী কল্পনাবিলাস হলেও ক্ষণিকের জন্যে বিমুগ্ধ হন পাঠক। এখানেই কবি বা শায়েরদের সার্থকতা, বাহাদুরী। তারা তাদের সৃজনী কর্মকুশলতায় আবেশিত করে ফেলেন। ঠিক তেমনি ফকির গরীবুল্লাহ হুগলীর বাসিন্দা হয়েও তার পুঁথির স্থান এবং বিষয় নির্বাচনে দূরদৃষ্টির নজির রেখেছেন। হুগলী থেকে টংগি শহরের দূরত্ব যোজন যোজন হলেও তিনি এই স্থানটিকেই পছন্দ করেছিলেন। কহর দরিয়ার (তুরাগ নদী) তীরের বাসিন্দা সোনাভান ফকির গরীবুল্লাহর পুুঁথির প্রধান চরিত্র। দূরত্ব বা অচেনা জায়গা সৃষ্টিশীলতার বাধ সাধেনি। মদীনাবাসী হানিফা এবং টংগী নিবাসী সোনাভানের জং অর্থাৎ যুদ্ধ কহরদরিয়ার উপকণ্ঠেই সংঘটিত করাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। এই পুঁথিতে আরো অনেক আজব আজব দৃশ্যাবলী রয়েছে যা কেবল কবির বিশেষ করে পুঁথির শায়েরের দ্বারাই সম্ভব। অস্বাভাবিক না স্বাভাবিক সে ব্যাপারে তাদের তেমন কোনো শিরপীড়া নেই। এই যেমন ফকির গরীবুল্লাহ উপস্থাপন করেছেন- ‘দুধে জলে ত্রিশ মণ করিল জলপান। আশি মণ খানা পুনঃ খায় সোনাভান।’ এখানে সম্ভব অসম্ভবের কোন বালাই নেই। ব্যাপারটি বিশ্বাসযোগ্য কিনা সে ব্যাপারেও শায়েরের পরোয়া নেই। পরওয়া থাকলে তো ‘এরাদা’কে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে না। হয়তো এজন্যেই ফকির গরীবুল্লাহ অবিবেচনাকেই বিবেচনার পালকিতে তুলতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ বাধ্যবাধকতা বলেও একটি শব্দ আছে অভিধানে। এই বাঁধনের জন্যেই সাধনকে সঙ্গী করেছিলেন।
সেই বাধ্যবাধকতার কারণেই ‘সোনাভান’কে ফকির গরীবুল্লাহ ‘আশি মণ খানা’ আর ‘ত্রিশ মণ জল’ খাওয়াতে বাধ্য হয়েছিলেন এক বৈঠকে। তা বাস্তব কি অবাস্তব পাঠক সে ব্যাপারে গবেষণা করতে পারেন। পুঁথির শায়ের তার অবকাশ রেখে দিয়েছেন। ঠিক যেমন নির্বাচন কমিশন। ভোট গণাগণির বিষয়ে ভাবনা-চিন্তার ফুরসত দিয়েছেন জনগণকে। এই তো কদিন আগে বাংলাদেশে একটি নির্বাচন হয়ে গেলো। ক্ষমতাসীন পক্ষ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বলছে এটি নাকি বাধ্যবাধকতার নির্বাচন। এটি কিসের বাধ্য। বেশ কদিন থেকে তারা রাস্তা-ঘাটে চিৎকার করে বলছে এটি নাকি সংবিধানের বাধ্যবাধকতা(?)। যে কোন প্রকারেই হোক নির্বাচন সংঘটিত করানো হলো। বাংলাদেশে নির্বাচন- ২০১৪ নামে যার পরিচয়। যদিও এই নির্বাচন ছিল একতরফা, একদলীয়। তাছাড়া অর্ধেকেরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়াকওভার পেয়েছেন। কেউ তাদেরকে ভোট দেয়নি। তারপরও তারা ‘মাননীয়’ এমপি বনে বসে আছেন। চমৎকার দৃশ্যই বটে। আরো চমৎকারিত্ব অপেক্ষা করছিল দেশবাসীর জন্যে। মিডিয়ার বদৌলতে (বিদ্যুৎ এবং প্রেস) জনগণ অবলোকন করেছে অভিনব সব দৃশ্য এবং প্রতিবেদন। কোথাও ভোট কেন্দ্রগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। ভিতরে প্রিজাইডিং অফিসারগণ ঝিমুচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। দু-চারটাতে ভোট পড়লেও তা ছিল অতি নগণ্য। শতেরও উপরের কেন্দ্র নির্বাচন বিরোধী জনতার কোপানলে আগুনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। হাসি তামাশা আর দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাঝখান দিয়ে যে নির্বাচন অতিক্রম করল সেই প্রত্যাখ্যাত নির্বাচনকেই বাংলাদেশের করিৎকর্মা নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করল অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু এবং ভোটারদের স্বরব উপস্থিতির ফিরিসতি। এই ঘোষণা দেশবাসীকেই নয় বিদেশীদেরও হতবাক করেছে। এই অভিনব এবং জোরজবরদস্তির নির্বাচন যারা কাছ থেকে পাঠ করেছেন তাদের অংকের ফল এসেছে দুই থেকে দশ শতাংশের ভিতর। কারো কারো হিসাব নিকাশ আরো একটু উপরে উঠলেও তা দুই সংখ্যা অতিক্রম করেনি। কি দেশী কি বিদেশীদের চোখে। যে নির্বাচনে একজনেই শতের উপর সিল মেরেছে। ভোটার হয়নি এমন অনেকেই ভোটের কাগজ বাক্সে ঢুকিয়েছে, এমনকি ভোটকেন্দ্রের জিম্মাদাররাই বাক্স ভর্তি করেছে। এমন খবর এবং দৃশ্য দেখেছে, পাঠ করেছে। এমন ধরনের খেল-তামাশার নির্বাচনেই বঙ্গদেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশন আহলাদে আটখান। তারা নিজেরা আটখান বা দশখান হলেও বিশ্ববিবেকের কাছে যে তারা খানখান হয়ে গেছেন সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা ওয়াকেফহাল আছেন বলে মনে হয় না। থাকলে হয়তো নির্বাচন পরবর্তী সময় বত্রিশপাটি দন্ত বিকশিত করতে শরমের ব্যাপারটি দেমাগে আনতেন। কারণ বাংলাদেশের নির্বাচন ২০১৪ একটি তামাশার নির্বাচন বলেই সভ্য দুনিয়া ঘোষণা করেছে। দেশের সচেতন এবং গণতন্ত্রমনা মানুষ যে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছিল।
সংবিধান প্রেমে উতলা হয়ে উঠেছিল এক শ্রেণীর ক্ষমতালিপ্সু এবং মতলববাজ মানুষ। প্রেম থাকা ভাল। তবে সে প্রেম অতিমাত্রা হলে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। একতরফা নির্বাচনের পর তা খোলাসা হতে শুরু করেছে। যারা এতো সময় সংবিধান সংবিধান করে বাজার মাথায় তুলেছিল, ঠোঁটের কোণায় ফেনা জমিয়েছিল তারাই এখন সংবিধানকে বাতিল কাগজের মতো টুকরা টুকরা করতে দ্বিধা করছে না। এই যে সংবিধান নিয়ে ব্যাট-বল খেলা তা দেখেও দেখছেনা নির্বাচন কমিশন। তাদের দেখার উপায়ও নেই হয়তো। কারণ এরাদার বিষয়টি তাদের মনে রাখতেই হচ্ছে। যে জন্য নির্বাচন কমিশনের কর্তাগণ চোখ থাকিতে অন্ধের ভূমিকায় নেমেছেন। যদিও দেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করছেন বর্তমানের নির্বাচিত(?) সরকার যা করছে তা সব অবৈধ এবং সংবিধান পরিপন্থী। একমাত্র ভারত ব্যতীত তামাম বিশ্ব বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনকে বাতিলের খাতায় তুলে রেখেছে। এমনকি ভারত সরকারের অন্যায় এবং অবিবেচনাপ্রসূত সমর্থন সে দেশের মিডিয়াগুলো সুনজরে দেখছে না। তারা সমালোচনায় মুখর। এই নির্বাচনকে বলছে প্রশ্নবিদ্ধ এবং সরকারকে বলছে অবৈধ। এত কিছুর পরও নির্বাচন কমিশন নির্বিকার। বাধ্যবাধকতা বা এরাদা থাকলে নির্বিকার থাকতেই হয়, বিশেষ করে ফলাফল বা নির্বাচনী বৈধতার ব্যাপারে। অভিজ্ঞ এবং দেশের সচেতন নাগরিকগণের অভিমত হলো বর্তমানের পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, পাশাপাশি ভোট কেন্দ্রগুলোর সহিংসতা রোধেও তারা চরমভাবে ব্যর্থ। এমন সর্বাংশ ব্যর্থ নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের নির্বাচন অঙ্গনে যে নতুন মাত্রা যোগ করল তা হয়তো ইতিহাসে কলঙ্ক তিলক হিসাবেই বিবেচিত হবে দীর্ঘ সময়, দীর্ঘকাল।
যে কোনো নির্বাচনে ভোটার এবং ভোটের সংখ্যাটিই মূল ব্যাপার। যার জিম্মাদার থাকেন নির্বাচন কমিশন। তাদের সুষ্ঠু পরিচালনা এবং নিরপেক্ষ নজরদারি একটি নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে। দুঃখের সংবাদ হলো, এর একটিও দেশবাসীর কাছে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে ভোট পড়েছে দুই শতাংশ থেকে দশ শতাংশের মতো। এই গণাগুনির জন্য যদিও কোন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন পড়ে না। আমজনতাই যথেষ্ট। কারণ যা কিছু ঘটেছে সবার চোখের সামনেই ঘটেছে। তাছাড়া ভোট হয়েছে মাত্র ১৪৭ আসনে। বাকি আসনে তো ভোটের কোন বালাই ছিল না। পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, ৩০০ আসনে ভোট হলেও দশ-বার ঘন্টায় ফল প্রকাশ পেয়েছে, নির্বাচন অফিসকে এতটা বেচইন হতে হয়নি। কিন্তু বর্তমানের দৃশ্য ভিন্ন। যদিও গুণাগুনতি হয়েছে অর্ধেকেরও কম প্রার্থীর ভোট। তারপরও নির্ঘুম দুই রাত পার হয়ে গেল। এত কিছুর পরও হিসাব মিলছে না। মিলবে কি করে ৫-১০ শতাংশকে চল্লিশ শতাংশে উন্নীত করা কষ্টকর ব্যাপারতো বটেই। তবুও রক্ষা ক্যালকুলেটার আবিষ্কার হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের ভোট গণনার বাহার দেখে ফকির গরিবুল্লাহকে পুনরায় স্মরণে আনতে হচ্ছে। তিনি তার পুঁথিতে সোনাভান আর হানিফার জংয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক জায়গায় লিখছেন ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতারÑ শুমার করিয়া দেখে তেত্রিশ হাজার।’ এখানে সংখ্যাটি নি¤œগামী হয়েছিল। বাংলাদেশের ভোট শুমারের সংখ্যাটি কিন্তু উর্ধ্বগামী হয়েছে। যেখানে ভোটের অংক হাজার পার হওয়াই কষ্টকর, সেখানে শুনতে হচ্ছে লাখ লাখ। সোনাভানের পুঁথির ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, এভাবে ‘দুই দিন বাদে হইল লাখের উপরÑ শুমার করিয়া আজি ভরিল অন্তর’। যে জন্যে ঘোষণা করতেই হয় নির্বাচন কমিশন জিন্দাবাদ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন