একটি দেশের গণতন্ত্রের মান নিরূপণ করা যায় সুশাসন, রাজনৈতিক নেতাদের আচরণ ও নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছ ভূমিকার ভিত্তিতে। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। আস্থা, সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার অভাবে রাজনীতিবিদদের মধ্যে চলছে ব্লেমগেমের প্রতিযোগিতা। ফলে বলা যায়, স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও দেশে গণতন্ত্রের মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। আর গত ৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের দমনপীড়ন ও বিরোধী দলের রাজপথের উত্তপ্ত আন্দোলনে আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি অবাধ নির্বাচনের বদলে সরকারের একতরফা নির্বাচনের স্বেচ্ছাচারিতা গণতন্ত্রের সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছে। এমন অবস্থায় আমাদের নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাহসী ও নিরপেক্ষ ভূমিকা গণতন্ত্রের সঙ্কট লাঘবে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালনতো দূরের কথা বরং বিভিন্ন বিতর্কিত আচরণের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিজেকে সরকারের একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। আর বিরোধী দলবিহীন ৫ জানুয়ারির হাস্যকর নির্বাচন আমাদের ইসির কপালে কলঙ্কের তিলক যেন লেপ্টে দিয়েছে।
পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই অর্থহীন ও অগ্রহণযোগ্য দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সরকারের পাশাপাশি ইসিরও কঠোর সমালোচনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সমালোচনায় বলা হচ্ছে, জনগণের ভোট ছাড়াই ১৫৩ আসনে সরকারি ঘরানার লোকজন বিজয়ী হয়ে গেছে। ফলে বাকি থাকে মাত্র ১৪৭ আসনের ভোট। কিন্তু সেই কাজটিও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারলেন না কাজী রকিব উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আর যদি ৩০০ আসনে নির্বাচনের দায়িত্ব তাদের পালন করতে হতো তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো? উল্লেখ্য যে, নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ আসতে শুরু করলেও সে সব মোটেই আমলে নেয়নি কমিশন। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ভোটারবিহীন সহিংস নির্বাচনের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে বর্তমান ইসি। অনেক কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি কমিশন। বহু কেন্দ্রে কোনো ভোটারই যায়নি, ফলে ব্যালটবক্স ছিল শূন্য। কোনো কেন্দ্রে ভোটার না গেলেও হাজার হাজার ভোট গ্রহণের ঘটনা ঘটেছে। পত্রিকার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এই নির্বাচনে এত কিছুর পরও সরকারি দলের প্রার্থীরা জবর দখল করেছেন ভোটকেন্দ্র। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছেন। দুপুরের আগেই অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জন করেছেন। সব মিলিয়ে বিশাল কলঙ্কের তিলক পড়লো কাজী রকিব কমিশনের ওপর। এছাড়া নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রেই অনিয়মকে নিয়ম হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। তারা আইনের তোয়াক্কা না করেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ‘লাঙ্গল’ প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে। গত ১৩ ডিসেম্বর ছিল প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। ১৪ ডিসেম্বর ছিল চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের দিন। কিন্তু কমিশন ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কিছু আসনের প্রার্থী তালিকা বারবার রদবদল করেছে। আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টি, জেপি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্য শরিকদের সমঝোতা রক্ষা করতে গিয়ে ইসি এই অনিয়ম করে। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল এক হাজার ১০৭টি। শেষে জাতীয় পার্টি সরে পড়ায় অনেক আসনে প্রার্থী সঙ্কট দেখা দেয়। তখন কমিশনের পরামর্শে রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনেক প্রার্থীকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে মনোনয়নপত্র শুদ্ধ করে দেন। সব মিলিয়ে নজিরবিহীন অনিয়মের মধ্য দিয়ে অতীতের সব কলঙ্ক রেকর্ড অতিক্রম করেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন।
বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অনিয়ম, অযোগ্যতা ও তাঁবেদারির নানা বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বিরোধী দলের অভিযোগের সত্যতাই প্রমাণিত হয়েছে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন যদি পরস্পরের দোসর হয়ে যায়, তাহলে তাদের অধীনে তো কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। ফলে বিরোধী দল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছ্ েতাদের বর্জনের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী। ফলে সাজানো এই নির্বাচন শুধু অগ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচিত হবে না, জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন