মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৪

বন্দুকযুদ্ধের নামে রাজনৈতিক হত্যা বন্ধ করতে হবে


রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হত্যার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা। ইসলামী ছাত্রশিবির ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ দল দু’টির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাও হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছেন। সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, গাইবান্ধা, নীলফামারী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রাম জেলায় তো বটেই, খোদ রাজধানী ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়ও হত্যাকা-ের যেন উৎসব শুরু হয়েছে। গত শনিবারও হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সম্পাদক আবুল কালাম এবং শিবিরকর্মী মারুফ হাসান ছোটন। দু’জনকেই গুলি করে হত্যা করেছে যৌথবাহিনী। একইদিন ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলা জামায়াতের অর্থ সম্পাদক এনামুল হকের গুলীবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে উপজেলার নওদাপাড়া স্কুলের পাশে। তাকে দিনের বেলায় সাদা পোশাকধারী পুলিশ ও গোয়েন্দারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর আলহাজ মকবুল আহমাদ এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন, বিগত মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৫৯ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে যৌথবাহিনী। তিনি বলেছেন, প্রধানমমন্ত্রী এসব হত্যার দায় এড়াতে পারবেন না। বিএনপি’র পক্ষ থেকেও হত্যাকা-ের একই অভিযোগ করে বলা হয়েছে, জনগণ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করায় ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষমতাসীনরা গুপ্তহত্যার ভয়ঙ্কর পন্থা বেছে নিয়েছেন। গত শুক্রবার বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আমলের মতো এবারও দেশের ছাত্র-যুবকদের নির্মূল করে ফেলার ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট পর্যন্ত ওই আমলে প্রায় ৪০ হাজার ছাত্র-যুবককে হত্যা করা হয়েছিল বলেও উল্লেখ করেছেন বেগম খালেদা জিয়া।
বস্তুত এ শুধু কথার কথা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত অভিযোগ মাত্র নয়। বাস্তবেও বেছে বেছে এমন সব নেতা-কর্মীকেই হত্যা করা হচ্ছে, যারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। ভবিষ্যতেও যারা নেতৃত্ব দিতে পারতেন। কৌশলও মুজিব আমলের মতোই নেয়া হচ্ছে। যেমন প্রতিটি হত্যাকা-ের পরই সরকারের পক্ষ থেকে একই ভাষায় জানানো হচ্ছে, অন্য আসামীদের গ্রেফতার করার জন্য নিহত নেতা বা কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল বলেই র‌্যাব ও পুলিশ  নাকি ‘বাধ্য হয়ে’ গুলী ছুড়েছে এবং এতেই মৃত্যু ঘটেছে ওই নেতা-কর্মীদের! মেহেরপুর জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল তারিক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের বেলায়ও একই গল্প বানানো হয়েছে। বলা বাহুল্য, কাহিনী চমৎকার হলেও সাধারণ মানুষকে কিন্তু মোটেও বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না। জনগণের সচেতন অংশের বরং আওয়ামী শাসনের অতীত আমলের রাজনৈতিক হত্যাকা-ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সিরাজ শিকদারসহ অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যার পরও একই ধরনের গল্প শোনা যেতো, এখনো যাচ্ছে। গল্পের পর গল্প ফেঁদে চলেছেন বর্তমান সরকারও। অন্যদিকে প্রতিটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, প্রথমে র‌্যাব, পুলিশ বা সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা বেছে বেছে নেতা-কর্মীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর দু’-একদিন পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এবং সবশেষে তাদের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে যেখানে-সেখানে। সব ক্ষেত্রেই এসব গুম ও হত্যাকা-ের জন্য পুলিশ ও র‌্যাবসহ যৌথবাহিনীর নাম জড়িয়ে পড়ছে। নেতা-কর্মীদের ধরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদেরও তৎপর দেখা যাচ্ছে।
লাগামহীন হত্যাকা-ের ফলে জনমনে ভীতি-আতঙ্ক যেমন ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি জীবনের নিরাপত্তা এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পাওয়ার দাবিও উঠছে জোরেশোরেই। কারণ, দ্রুত বেড়ে চলা গুম ও খুনের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের জন্য ঢালাও গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের পাশাপাশি গুম ও হত্যার ব্যাপারেও সরকার সমান তালে এগিয়ে চলেছে। এমন ভাবনারও কারণ তৈরি করেছেন স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিরোধী দলকে দমনে ‘আরও’ এবং ‘যতটা দরকার ততটা’ কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তার এই ঘোষণার পরপরই নতুন উদ্যমে হত্যার অভিযানে নেমেছে যৌথবাহিনী। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেয়ার পর হত্যাকা- বেড়ে গেছে বলেই তার নিজের এবং সরকারের পক্ষে দায় এড়ানোর সুযোগ থাকতে পারে না। কারণ, প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ ও র‌্যাব’র অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, সামনে পুলিশ ও র‌্যাবকে রাখা হলেও পেছনে আসলে রয়েছে সরকার। সরকারই পুলিশ ও র‌্যাবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যার জঘন্য কাজে ব্যবহার করছে। গণতন্ত্রে এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে পারে না। আমরা মনে করি, হত্যা ও গুমের মতো ভয়ঙ্কর পন্থায় সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করা সম্ভব নয়। হত্যার মাধ্যমে সাময়িকভাবে ভীতি-আতঙ্ক ছড়ানো গেলেও জনগণের আন্দোলনও স্তব্ধ করা যাবে না। পরিবর্তে বিপদ বরং সরকারেরই বাড়তে থাকবে। আমরা তাই আশা করতে চাই, ক্ষমতাসীনদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং তারা অবিলম্বে গুম ও গুপ্তহত্যা বন্ধ করবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads