১৮ দলীয় বিরোধী জোটের অংশগ্রহণ ছাড়াই নজিরবিহীন এবং প্রায় ভোটারবিহীন একটি নির্বাচন হয়ে গেল দেশে গত ৫ জানুয়ারি। জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত এ নির্বাচনে ভোট পড়েছে খুব কম। প্রধান বিরোধীদল বিএনপির দাবি অনুসারে মাত্র ৪ শতাংশ। পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘ফেমা’ বলেছে ১০ শতাংশেরও কম। ৩ শতাধিক কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। ভোট প্রদানের হার কত তা নির্বাচন কমিশন জানাতে রহস্যজনকভাবে নীরব থেকেছে। ভোটের দিন সারা দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বুলেটের আঘাতে এবং ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের হামলায় নিহত হয়েছেন ২৪ জন। সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া ভোটকেন্দ্রে বিকেল ৩টা পর্যন্ত একজন ভোটারও ভোট প্রয়োগ করেননি এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে। ৪১টির মতো কেন্দ্রে একটিও ভোট পড়েনি বলে জানা গেছে। অনেক কেন্দ্রে প্রতিঘণ্টায় ভোট পড়েছে ২ থেকে ৩টি। অনেক কেন্দ্রের যেখানে ভোটার ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার সেখানে পড়েছে মাত্র ২ থেকে ৩শ ভোট। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ২টা পর্যন্ত অনেক কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি প্রায় দেখাই যায়নি। টিভি চ্যানেলগুলোর বুলেটিনেও এমন দৃশ্য দেখা গেছে প্রায় সর্বত্র। ভোটগ্রহণের এমন পরিস্থিতি দেখে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা বহু কেন্দ্র জোর করে দখলে নিয়ে ভোটগ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে নৌকা মার্কায় সিল দেবার ব্যবস্থা করা হয় বলে ব্যাপকভাবে অভিযোগ উঠেছে।
বিরোধীদলের অংশগ্রহণহীন নির্বাচনে কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কেন্দ্র দখল ও কারচুপি দেখে ভোটের দিন দুপুরের দিকেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অধিকাংশই সরে দাঁড়ান। সংগত কারণেই বিদেশের পর্যবেক্ষকরা এ নির্বাচন মনিটর করতে আসেননি। প্রতিবেশী ভারত ও ভুটান থেকে দু’জন করে চারজন পর্যবেক্ষক আনা হয়েছিল। তবে তাদের নাকি কোটি টাকা ব্যয় করে আনা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই বিশ্ব গণমাধ্যমে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রহসন ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কড়া সমালোচনা করা হয়। বিদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রায় ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্র দেখানো হয়। দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও একই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা গেছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশটির টিভিতেও প্রায় ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্র দেখানো হয়েছে। কিন্তু এতকিছুকে আমাদের ক্ষমতাসীনরা তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। তারা বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াচ্ছেন দেশবাসী নাকি তাদের বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে। বিরোধীদলের আন্দোলন এবং নির্বাচন প্রতিরোধের কর্মসূচিকে নাকি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে ভোটাররা। প্রতিবেশী দেশটির তরফ থেকে প্রহসন ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে সমর্থন করা হয়েছে। দেশটি এ প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের পাশে থাকবে বলে দৃঢ় আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে এমন খবরই আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রতিবেশী বন্ধুদেশটির এমন আচরণকে ‘নগ্ন হস্তক্ষেপ’ বলে সুশীল সমাজ ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে। দেশের সিংহভাগ মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকা সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার প্রতিবেশী দেশটির আচরণ সঙ্গত এবং আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি কিনা তা ভেবে দেখার মতো বৈ কি।
স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশটি যে অবদান রেখেছে বাংলাদেশের জন্য তা এদেশের মানুষ কখনও বিস্মৃত হবে না এটা যেমন ঠিক, তেমনি কোনও দল বা গোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা-নির্যাতনকে সমর্থন দিয়ে হিংসা আর হানাহানিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যাবে তা কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে শুধু প্রতিবেশীই নয় বিশ্বের সকল সচেতন মানবগোষ্ঠীর সমর্থন ও শুভেচ্ছা আমাদের কাম্য। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে এদেশে দলাদলি, সংঘাত কিংবা প্রতিপক্ষ দলনের আত্মঘাতী কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হলে তা দেশ ও জাতির জন্য শুভ হবে না কখনও।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন