সোমবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৪

জাতিকে বিভক্ত করা কার স্বার্থে?

আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। তাদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এর মধ্যে গণতন্ত্রের ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই, জাতি-ধর্ম-বর্ণ দল নির্বিশেষে সবাই এটিকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্য তিনটি মৌলনীতির ব্যাপারে কোনো ঐকমত্য নেই। এবং এগুলোর ব্যাপারে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের তীব্র আপত্তি রয়েছে। এক এক করে এগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যাক।
প্রথমেই আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। এটি সুবিদিত যে এ দেশে শুধু বাংলা ভাষাভাষী লোক কিংবা বাঙালি বসবাস করে না। এ দেশে অবাঙালি উপজাতি ও অন্যান্য ুদ্রনৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে যেমন চাকমা, মগ, ত্রিপুরা, মারমা, বোম, কোল, ভীল, সাঁওতাল, মণিপুরি, গারো প্রভৃতি। এ ছাড়া রয়েছে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী। তাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছে। তাদের মাতৃভাষা কিন্তু বাংলা নয়। যদিও  বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের বিদ্যালয়ে বাংলামাধ্যমে পড়তে হয়, তবে অনেকে নিজেদের মাতৃভাষায় পড়তে শুরু করেছে। এরা বাঙালি জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করতে রাজি নয়। ১৯৭২ সালে সংবিধানে প্রণয়নের সময় একমাত্র উপজাতীয় প্রতিনিধি প্রয়াত মানবেন্দ্র রায় সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেন। যদিও ব্রুট মেজরিটির জোরে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান অনুমোদন করিয়ে নেন। পরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির স্বার্থে বাঙালি-অবাঙালি সব নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন, যা ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০১ সালে গণরায় লাভ করে। বর্তমান সরকার আবার সংসদে ব্রুট মেজরিটির জোরে অন্যান্য মৌলিকনীতির মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত করেন। ুদ্র জনগোষ্ঠীসহ এ দেশের বেশির ভাগ লোক এটি মনেপ্রাণে  মেনে নিতে পারেনি।
এরপর আসে ধর্মনিরপেক্ষতারকথা। ১৯৭২ সালে সংবিধান যে সংসদে গৃহীত হয়েছিল দু-একজন বাদে এর সব সদস্যই ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন করেছিলেন লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফ)  অধীনে যেখানে ইসলামি আদর্শ সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধর্মনিরপেক্ষতারনামগন্ধও কেউ শোনেননি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ নেই। তাহলে এটি সংবিধানের মৌলিক নীতি হয় কিভাবে? আসলে ভারতের সাথে কথিত গোপন চুক্তির শর্ত হিসেবে ভারতের সংবিধানের আলোকে এটি আমাদের সংবিধানে চাপিয়ে দেয়া হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল নাম থেকে মুসলিমশব্দ বাদ দেয়া হলো। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইসলামি নামনিশানা মুছে ফেলা সমার্থক হয়ে গেল। এ ধরনের ক্রিয়াকলাপ ধর্মপরায়ণ মুসলমানদের অনুভূতিতে তীব্র আঘাত দেয়। উল্লেখ্য, পরে এই কোর্টের নির্দেশে ওই হলো দুটিতে মুসলিম শব্দ পুনর্বহাল করা হয়। এ কারণে  বেশির ভাগ লোক ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদকে ভীতির চোখে দেখে। তাদের মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষকে ধর্মহীনতার দিকে নিয়ে যায়।
এখন দেখা যাক সমাজতন্ত্রমৌলিকনীতি হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টির ভিত্তি কী? ঐতিহাসিকভাবে এ দেশের মানুষ ধর্মপরায়ণ। অনেকের মধ্যেই সমাজতন্ত্র সম্পর্কে একটি ভীতি রয়েছে। তাদের ধারণা, সমাজতন্ত্র, মানে ধর্মহীনতা যা এ দেশের ধর্মপরায়ণ মানুষ পছন্দ করে না। উল্লেখ্য, মানুষ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেনি। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এ দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে এরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। জীবনকে বাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করাই ছিল তাদের ব্রত। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ছিল সাধারণ জনগণ যাদের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না বা নেই। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও সমাজতন্ত্রের কোনো উল্লেখ নেই। তা ছাড়া বাস্তব ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ কোথায়? বাস্তবে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে নিকৃষ্ট ধরনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং শাসন ও শোষণ। এটি একধরনের ভাঁওতবাজি এবং জনগণ এ ধরনের ভাঁওতাবাজিও মেনে নিতে পারছে না।
স্বাধীনতার পর এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা ছিল এ দেশের মানুষের মনন বুঝতে না পারার ফল। ১৯৭২ সালের এবং বর্তমানে বলবত থাকা সংবিধান যেন দলীয় গঠনতন্ত্র। এতে সব দল-মতের লোকের আশা-আকাক্সার প্রতিফলন ঘটেনি। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দলীয় চেতনা চাপিয়ে দিয়ে তাতে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি প্রধানমন্ত্রী এবং তার দল অনবরত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ বিভাজন। বিভক্ত জাতি দুর্বল জাতি হিসেবে পরিচিতি পায়।
একটি কথা আছেÑ United we stand, divided we fall, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা অনেকটা এ রকমই। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে দেশ বা জোট যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষের শক্তি হয় তাহলে কি ১৯৭৯, ১৯৭১, ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে এবং সাম্প্রতিক কালে অনুষ্ঠিত সিটি নির্বাচনে বিএনপিকে ভোটাদনকারী বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গণজাগরণ মঞ্চকে মদদ দিয়ে সরকার এ বিভক্তিকে আরো উসকে দিয়েছে। আর শাহবাগ আন্দোলনের কুশীলবদের ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে আবির্ভাব ঘটেছে হেফাজতে ইসলামের। গুটিকয়েক উচ্ছিষ্টভোগী আলেম ছাড়া এতে সমর্থন দিয়েছে এ দেশের তৌহিদি জনতা। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি ব্যাখ্যা করে কর্মজীবী নারীদের ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে। অথচ সরকারের উচিত ছিল হেফাজতে ইসলামের সাথে আলাপ-আলোচনা করে তাদের সাথে একটি সমঝোতা করা। বরং তা না করে সরকার তাদের দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয়। হেফাজতে ইসলাম এবং ১৮ দলীয় জোটের কাউকে রাজধানীতে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এবং কোনো বিরুদ্ধে মতই সরকার সহ্য করতে পারছে না। সরকারবিরোধী কোনো কথা কেউ বললেই তাকে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। সত্য বলার কারণেই আমার দেশ পত্রিকা এবং ইসলামিক টিভি ও দিগন্ত টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমার দেশ পত্রিকার নির্ভীক সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে হাজতবাস করতে হচ্ছে। বিরোধী জোটের যেকোনো কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দেয়া হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রবণতা যেটা লক্ষ করা যাচ্ছে। সেটি হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে দলীয় ঠেঙাড়ে বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে সরকার বিরোধী জোটের কর্মসূচি নস্যাৎ করে দিচ্ছে। এক অর্থে বিরোধী জোট বা দলের জন্য রাজনীতি কঠিন হয়ে পড়েছে। জাতিকে আজ এমনভাবে বিভক্ত করা হয়েছে যে অনেকেই গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। এসব করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে এবং ক্ষমতার মোহে। আর এর সুযোগ নিচ্ছে কোনো একটি বিদেশী রাষ্ট্র।
অতএব, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এহেন বিভাজনের বিষাক্ত রাজনীতি পরিহার করে, ক্ষমতাসীন জোট রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন এটিই সবার কাম্য। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads