বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৪

হলফনামায় মিথ্যাচার


আরব্য উপন্যাসের আলাদীনের কাহিনী অনেকেরই জানা। চেরাগ ঘষলেই হাজির হতো সুবিশাল দৈত্য। দেখেশুনে মনে হচ্ছে আরব্য উপন্যাসের সেই চেরাগ এখন মহাজোটের মন্ত্রী-এমপিদের হাতে।
চেরাগ এবং আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের স্ফীতি দেখে মনে হয় ক্ষমতায় যাওয়া মানে সম্পদের পাহাড় বানানোর উৎসব। গত পাঁচ বছরে এই উৎসব ভালোভাবেই উদযাপন করেছেন ক্ষমতাসীনেরা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের  ইশতেহারে মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব দেয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও কেন মহাজোট সরকার গত পাঁচ বছরে এ ব্যাপারে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি? প্রধানমন্ত্রী প্রহসনের দশম সংসদ নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনেও বললেন, মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি মন্ত্রী-এমপিদের আয়ও বেড়েছে। অতীতের সরকারের দুর্নীতির চেয়ে লুটপাট অনেক কমেছে। এ কথা বলে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি-লুটপাটের বিপক্ষে অবস্থান না নিয়ে প্রকারান্তরে আরো উৎসাহিত করলেন।
এবারের দশম সংসদ তামাশার নির্বাচনে হলফনামায় দেয়া সম্পদের বিবরণ জ্ঞাত আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা ২০০৮ সালের হলফনামায় দেয়া আয়ের উৎস ও সম্পদের বিবরণ তুলনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়। সুশাসনের জন্য নাগরিক সমাজের (সুজন) তথ্য মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৪০ জন প্রার্থী অংশ নিয়েছেন। ৯৩ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি বা এর চেয়েও কম। হত্যা মামলার আসামি ১২ জন। ব্যবসায়ী ৫২.২২ ভাগ। প্রার্থীদের সম্পদ গড়ে ৩৬৩ শতাংশ বেড়েছে। এই বেড়ে যাওয়ার হার মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ২৪৭ শতাংশ, প্রতিমন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ৪৫৯ শতাংশ এবং সংসদ উপনেতা চিফ হুইপদের ক্ষেত্রে ১৬৮৯ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রীর সম্পদ ৪৬ শতাংশ এবং ডেপুটি স্পীকারের সম্পদ ২৩৮ শতাংশ। ২৬৯ জন প্রার্থী আয়করসংক্রান্ত কোনো কাগজপত্রই জমা দেননি।  কারো সম্পদ বেড়েছে ২০০০ শতাংশের ওপরে। হলফনামায় তথ্যের ক্ষেত্রে অনেক গোঁজামিল দেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ প্রার্থীই সম্পদের সঠিক হিসাব না দিয়ে কৌশলে গোপন করে চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন। অথচ নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
ক্ষমতাসীনদের সম্পদ সাধারণভাবেই বাড়ে অর্থমন্ত্রীর এই নীতিতেই সবাই যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। হলফনামা জনসমক্ষে প্রকাশে ক্ষমতাসীন দল আপত্তি জানিয়েছে। অনুগত নির্বাচন কমিশনও এ আপত্তি আমলে নিয়েছে। এই সংবাদে জনগণ ুব্ধ ও উদ্বিগ্ন। এতে জনগণের জন্য তথ্য পাওয়ার অধিকারও ুণœ করা হয়েছে। একজন মহাজোট প্রার্থী দুঃখিনী মায়ের সন্তানবলে এর প্রথম নির্বাচনে হৃদয় গলানো বক্তব্য দিয়ে ভোটারদের সহানুভূতিকে পুঁজি করে নিজের দুঃখ ও আখের গুছিয়েছেন।  অবৈধ নির্বাচনের নামে আবারো দুর্নীতি-অনিয়মের  লাইসেন্স নবায়ন করতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আগাম জয়ী হয়েছেন। জনপ্রতিনিধিদের অবস্থানকে মুনাফা অর্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদ আহরণের একটি উপদ্রবমূলক প্রবণতা। ক্ষমতার অপব্যবহারের নগ্ন উদাহরণ এটি।
সম্পদের বিবরণী প্রকাশের প্রতিক্রিয়া উল্টো পরিবেশমন্ত্রী সাংবাদিকদেরই সম্পদের হিসাব চাইলেন। হাইব্রিড নেতা হিসেবে পরিচিত মাহবুব-উল আলম হানিফ বললেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ক্ষমতা ব্যবহার করলে তার এই সম্পদ বাড়ত বহু গুণে।
পদ্মা সেতু নিয়ে সমালোচিত আবুল হোসেনকে দেয়া হলো দেশপ্রেমিকসার্টিফিকেট।
দুর্নীতি নিয়ে তর্জনগর্জনকারী সুরঞ্জিত বাবু রেলের কালো বিড়াল ধরার নামে নিজেই রেলের কালো বিড়াল হলেন। এক মন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য  আংশিক প্রতিবেদন হলে পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সাধারণ মানুষ ভিরমি খেতো। বিভিন্ন সংগঠনের দাবি অনুযায়ী, এই পরিমাণ দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে টাস্ফফোর্স গঠন করলে ন্যূনতম দুটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব হতো।
সংবিধানের ১৪৭ (৪) ধারায় বর্ণিত সরকারের মন্ত্রীসহ যারা আটটি পদে আসীন আছেন, তাদের বেতন ছাড়া অন্যান্য আয়-অর্জন অসাংবিধানিক। এরা কোনো লাভজনক পদে আসীন হতে পারবেন না। অথচ আমরা দেখছি, গত পাঁচ বছরে অনেক মন্ত্রী ও এমপি ব্যবসায়ের সাথে জড়িত থাকায় ওই সব বায়বীয় উৎসের নামে সম্পদ বাড়িয়েছেন গাণিতিক হারে, যা সংবিধানের ১৪৭(৩) অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক। জ্ঞাত আয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে ঠুঁটো জগন্নাথ আয়কর বিভাগ ও আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন ওখানে হাত দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সর্বশেষ সংশোধনের মাধ্যমে নখদন্তহীন কাগুজে বাঘ বানিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারের অনুমতি ছাড়া কারো বিরুদ্ধে অভিযোগও করতে পারবে না দুদক। তা ছাড়া দুদক বলি, নির্বাচন কমিশন বলি এরা যেন নিজেদের সরকারি কর্মচারী ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এরা চাকরির ভয় করেন। নিদেনপক্ষে নিয়োগকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে অকুণ্ঠ। দেশের প্রতি, নৈতিকতার প্রতি কিংবা দায়িত্বের কথা ভাবতেই যত কুণ্ঠা। দুর্নীতিবাজদের প্রতি কদাচিৎ মামলা হলেও অদৃশ্য হাতের ইশারায় তা বাতিল হয়ে যায়। জনগণের স্বার্থে মিডিয়ার প্রকাশিত হলফনামা যেন নির্জলা মিথ্যার বেসাতি। এটা হলো দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণার এক অভিনব বাণিজ্যিক কৌশল। সুশাসনের জন্য দুর্নীতি বড় বাধা। জনগণের সম্পদ হরণকারী লুটেরাদের সামলে দেয়ার কি কেউ নেই?


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads