প্রতিদিনই যৌথবাহিনীর অভিযানের খবর মুদ্রিত হচ্ছে পত্রিকার পাতায়। ২০ জানুয়ারি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, “সুন্দরগঞ্জে যৌথ বাহিনী ও আ’লীগের ব্যাপক গুলীবর্ষণ ঃ শিশু ও পুলিশসহ আহত দুই শতাধিক।” উক্ত রিপোর্টে বলা হয়, আসামী ধরাকে কেন্দ্র করে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে খানাবাড়ি এলাকায় যৌথ বাহিনীর সাথে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা শনিবার দিবাগত রাত একটা থেকে রোববার সকাল সাতটা পর্যন্ত সহ¯্রাধিক রাউন্ড গুলীবর্ষণ করেছে। এ সময় তারা অর্ধশতাধিক বাড়িতে নজিরবিহীন ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এমনকি নারী ও শিশুদের মারধর করে এবং অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। হুমকি দেয় গ্রাম তছনছ করে দেয়ার। বাদ যায়নি হিন্দু ও প্রতিবন্ধীর বাড়িও। এ অবস্থায় বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী বিভিন্ন সড়কে গাছ, বালুর বস্তা ও গোবর ফেলে যৌথ বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে রাখে। পুড়িয়ে দেয় পুলিশ বহনকারী একটি পিকআপ ভ্যান। এ সময় শিশু-নারী ও পুলিশসহ অন্তত দুই শতাধিক গ্রামবাসী আহত হন। তাদের মধ্যে ২২ জন গুলীবিদ্ধ হন বলে জানা গেছে। তবে পুলিশ বলেছে, তারা ভাংচুরের সাথে জড়িত নয়। গ্রেফতার করা হয়েছে ৭ জনকে। নজিরবিহীন এ হামলার ঘটনা দেখতে রোববার দিনভর সেখানে হাজার হাজার মানুষের ভিড় ছিল।
যৌথ বাহিনীর অভিযান আর কতদিন চলবে কে জানে? তবে যৌথ বাহিনীর সাথে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ক্যাডাররা যুক্ত হয়ে এখন প্রায় প্রতিদিন গুলীবর্ষণ, ভাংচুর, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের যেসব ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে তাতে জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। দেশে সরকার আছে, প্রশাসন আছে তারপরেও এমন আতঙ্কজনক অভিযান কেন? কেথাও কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে, কোথাও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার সংকট দেখা দিলে সেখানে তো আইন অনুযায়ী প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অনুরাগ-বিরাগের পশবর্তী না হয়ে বরং বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিতে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে কাক্সিক্ষত পদক্ষেপ নেয়া। এমন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলেই জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ। আমাদের সুশাসনের সংকট তো এখানেই। আমরা জানি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো সরকার দলের স্বার্থ রক্ষা করে না, বরং রক্ষা করে দেশ ও জনগণের স্বার্থ। কিন্তু বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। সরকার এখন দলীয় স্বার্থ রক্ষায় এবং ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার স্বপ্নে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে যৌথ বাহিনীকে বিরোধী দল দমনে কাজে লাগাচ্ছে। গুলী করে মানুষ হত্যা এখন যেন কোনো ব্যাপারই নয়। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের পর তাদের লাশ উদ্ধারের ঘটনা। এসব কোনো গণতান্ত্রিক দেশের চিত্র হতে পারে না। অনুরাগ কিংবা বিরাগ কোনো সরকারের নীতি হতে পারে না।
সরকারের দায়িত্ব হলো দলমত নির্বিশেষে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। কিন্তু এবার ভোটারবিহীন ও বিরোধী দলবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকারকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধী দল দমনের নিষ্ঠুর অভিযান চালাতে। এ অভিযানে সরকারি দলের ক্যাডাররা যুক্ত হওয়ায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আমরা জানি, সুশাসন এবং অপশাসন এক জিনিস নয়। সুশাসনে হিংসা-বিদ্বেষ থাকে না, বরং থাকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার দৃঢ় চেতনা। এ কথা কে না জানে যে, হিংসা হিংসাকেই ডেকে আনে। হিংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না।
অপরাধ তো একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়। সুনির্দিষ্ট অপরাধে অপরাধীরাও হবে সুনির্দিষ্ট। দলমত কিংবা ধর্ম-বর্ণের বিবেচনা এখানে আসতে পারে না। তাহলে কোনো কোনো এলাকা কিংবা কোনো কোনো গ্রামে যৌথ বাহিনী এমন বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুর অভিযান চালায় কী করে? যৌথ বাহিনী তো কোনো দলের বাহিনী নয়, দেশের বাহিনী। আমরা মনে করি, দেশের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে রাজনৈতিক হিংসা-বিদ্বেষের চেতনা পরিহার করে সহিষ্ণুতার নীতি অবলম্বন করা প্রয়োজন এবং ক্ষমতার অহঙ্কার ত্যাগ করে মানষিক ও নৈতিক মূল্যবোধের আলোকে সকলেরই এখন পথ চলা প্রয়োজন। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সুন্দরগঞ্জে যৌথ বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের ব্যাপক গুলীবর্ষণের ঘটনাকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় তদন্তের চাইতে ভাল আর কী হতে পারে? আমরা মনে করি সরকার অভিযোগের রাজনীতি পরিহার করে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করবে, যাতে দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেতে পারে। আর যৌথ বাহিনী ও আওয়ামী লীগের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করাও সরকারের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন