বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৪

সংবিধানের জন্য নয়, ক্ষমতার জন্য সর্বনাশা নির্বাচন


সিরাজুর রহমান

মধ্যপ্রাচ্য কিংবা উত্তর আফ্রিকার কোথায় আলকায়েদাসহ যুক্তরাষ্ট্রের কোন কাক্সিত সন্ত্রাসী নিজ বাড়িতে আছেন কিংবা গাড়িতে কোথাও যাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ঘাঁটি থেকে কর্মরত অফিসার সেটা দেখতে পান। অবিলম্বে দূরনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে পাইলটবিহীন ড্রোন বিমান পাঠান তিনি। সে বিমান ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে কয়েক হাজার মাইল দূরের ওই সন্ত্রাসীকে ঘায়েল করে ফেলে। কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তির দৌলতে এটা সম্ভব হয়েছে। এমনকি আপনি যদি আপনার পুকুরঘাটে বসে হাত-পা ধোয়ার কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে ১০ কিংবা ২০ হাজার মাইল দূর থেকে শুধু যে আপনাকেই দেখা যাবে তা নয়, আপনি কী রঙের এবং কী নকশার জামা পরেছেন, সেটাও পরিষ্কার দেখা যাবে।

শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, চীনসহ অনেক দেশ এখন এই প্রযুক্তির অধিকারী এবং সেটা তারা নিয়মিত ব্যবহারও করে থাকে। শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচনে যে সংখ্যক ভোট পেয়েছে বলে দাবি করছে, সেটা যে ভিত্তিহীন, এই দেশগুলো সেটা ইতোমধ্যেই জেনে গেছে কৃত্রিম উপগ্রহ মারফত। তা ছাড়া মোবাইল টেলিফোন, বহু ব্লগ ও অন্যান্য সামাজিক মিডিয়ার কল্যাণে পৃথিবীর এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত মানুষ ভোটকেন্দ্রগুলোর ছবিও দেখে ফেলেছেন। এসব প্রযুক্তি ও মিডিয়া বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জ্ঞানান্ধ ও প্রতারকেরা ছাড়া আর সবাই এখন জানে, অদ্ভুত এক নির্বাচন হয়ে গেল বাংলাদেশে। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাতিসঙ্ঘ আওয়ামী লীগের সেম-সাইডনির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে নাকচ করে দিয়েছে।

এ নির্বাচনে নগণ্যসংখ্যক মানুষ ভোটকেন্দ্রে গেছে। একটি ভোটও পড়েনি প্রায় ৫০টি ভোটকেন্দ্রে। মিডিয়ায় দেখা যায়, ভোটার আসবে আশা করে পোলিং অফিসারেরা বসে বসে নখ খুঁটেছেন কিংবা দাঁত খুঁচিয়েছেন। দু-একজন টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছেনও দেখা গেল। ফাঁকা সেসব কেন্দ্রের খাঁ-খাঁ ছবি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে ভোটদান বন্ধ হওয়ার আগেই। প্রায় সাড়ে ৬০০ ভোট কেন্দ্রে বিভিন্ন কারণে ভোটদান স্থগিত ছিল। কোথাও কোথাও জনকয়েক আওয়ামী লীগ কর্মী সারা দিন বারবার ভোট দিয়েছেন (যেমনটা ১৯৮৮ সালে এরশাদের ভোটারবিহীন নির্বাচনে স্বচক্ষে দেখে এসেছিলাম)। অনেক স্থানে আওয়ামী লীগ কর্মীরা সারা দিন ব্যালটে ছাপ মেরেছেন এবং সেসব ব্যালট দিয়ে বাক্স ভর্তি করেছেন। 

এ নির্বাচনের ওপর কোনো দেশের কারোই আস্থা ছিল না। খালেদা জিয়ার এবং বিরোধী দলগুলোর আহ্বানে দেশের মানুষ সার্থকভাবে নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করেছে। দেড় শরও বেশি ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া কিংবা ভাঙচুর করা হয়েছে। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ অসম্ভব করে দিয়ে যে একদলীয় নির্বাচন হলো সেটা পর্যবেক্ষণ করার কোনো কারণ কেউ দেখতে পাননি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপান, এমনকি রাশিয়াও পর্যবেক্ষক পাঠানোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। অর্থাৎ এই দেশগুলো আগে থেকেই রায় দিয়েছে যে, ৫ জানুয়ারির এ নির্বাচন কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশে যেসব নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা আছে তারাও আগে থেকে বলে দিয়েছিল, এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার কোনো হেতু তারা দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু সরকারের চাপ ও হুমকির ফলে তাদের কেউ কেউ পর্যবেক্ষণ-পর্যবেক্ষণ খেলাখেলতে বাধ্য হয়েছেন। নির্বাচনের পরে ফেমা (ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স) রায় দিয়েছে গড়পড়তা ভোট পড়েছে ১০ শতাংশেরও কম। কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, এই হাতেগোনা ভোটদাতারা হয় আওয়ামী লীগের কর্মী, নয়তো এর ভোটব্যাংকের কিছু ছুটকো মানুষ। আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ সংখ্যালঘুদেরও অনেকে ভোট দিতে যাননি।

কী প্রয়োজন ছিল এই সর্বনাশা নির্বাচনের? বিরোধী দলগুলোকে (অর্থাৎ দেশের মানুষের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সমর্থক ৯০ শতাংশকে) ভোটাভুটির বাইরে রেখে যেন এক ছাত্রীর কাসেপ্রধানমন্ত্রী আগেই ফার্স্ট হয়ে গিয়েছিলেন। 

ভোটাভুটির তিন সপ্তাহ আগেই গরিষ্ঠতা উৎপাদন করে নিয়েছিল সরকার। গরিষ্ঠসংখ্যক ভোটদাতার ভোট দেয়ার অধিকার তখনই ভণ্ডুল করে দেয়া হয়। তবু কেন এ নির্বাচন? সব মিলিয়ে এ নির্বাচনে অন্তত হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ভারত সরকার তাদের ঘোষণা অনুযায়ী ব্যয় করেছে হাজার কোটি রুপি। জানা গেছে, দেড় শতাধিক মানুষ খুন হয়েছেন এ নির্বাচনী ইস্যুকে ঘিরে। জখম হয়েছেন কয়েক হাজার। শতাধিক স্কুল ও বাড়িসহ বহু সম্পত্তি নির্বাচনের দিনই বিধ্বস্ত হয়েছে। এদিন নিহত হয়েছেন ২৬ জন। এদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের সমর্থক এবং মারা গেছেন রাব-পুলিশের গুলিতে। বিভিন্ন বাহিনীর যৌথ অভিযানে সাতক্ষীরা জেলাটি শ্মশানের মতোই শ্রীহীন ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে।

 

ক্রুদ্ধ দেশ, ক্রুদ্ধ জাতি

বাংলাদেশের মানুষ আজ ভয়ানক ক্রুদ্ধ। বিভিন্ন বাহিনীর ওপর তো তারা ক্রুদ্ধই। তারচেয়েও বেশি ক্রুদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকার এবং এর নেতৃত্বের ওপর। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভোট দেয়ার অধিকার যেদিন তারা ফিরে পাবেন, সেদিনের কথা ভেবে আওয়ামী লীগের এখন থেকেই নিশ্চয়ই আতঙ্ক হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল; কিন্তু ক্ষমাশীলতারও সীমা-পরিসীমা আছে।

শেখ হাসিনা ক্ষমতা বজায় রাখতে চান। বাংলাদেশের সাথে সদ্ভাব ও সদিচ্ছাই যদি দিল্লির কাম্য হতো, তাহলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনো প্রয়োজন তার ছিল না। এ যাবৎ বাংলাদেশের সব সরকারই দিল্লির সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করেছে। খালেদা জিয়া আগেও একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দুই দেশের মধ্যে তখন বিশেষ কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। বিএনপি একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন। তারা অবশ্যই বাংলাদেশের স্বার্থকে বড় করে দেখবে। কিন্তু যেহেতু জনগণের সমর্থন তাদের দিকে, সেহেতু তাদের সাথে সমঝোতার ওপর ভারত নির্ভর করতে পারত- যেটা আওয়ামী লীগের সাথে চুক্তি করে ভারত পাবে না। এই সরকারের সাথে যেসব গোপন চুক্তি ভারত করছে, বাংলাদেশের মানুষ সুযোগ পেলে সেসব চুক্তি প্রত্যাখ্যান করবে। সদিচ্ছা থাকলে ভবিষ্যতেও জাতীয়তাবাদী সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সুসমাধান অবশ্যই সম্ভব হতো। কিন্তু দিল্লির জন্য সেটা যথেষ্ট নয়। তারা আরো, আরো, আরো চান।

অনেক আগেই ভারত বাংলাদেশের বাণিজ্যের বাজার দখল করে নিয়েছিল। দুই দেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল বৈষম্য। ভারসাম্য বিধানের প্রতিশ্রুতি তারা বহুবার দিয়েছেন; কিন্তু কথা রাখেননি। সেটাও দিল্লির ক্ষুধা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। বিনিময়ে কিছুই বাংলাদেশকে দিতে রাজি নয়। এমনকি দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত পুরনো চুক্তিগুলোও ভারত মানছে না। শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালেই বেরুবাড়ি ছিটমহলটি ভারতকে দিয়ে দিয়েছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী বিনিময়ে তিন বিঘা ছিটমহল বাংলাদেশ আজো পায়নি। শেখ হাসিনা সরকার ফারাক্কার পানিবণ্টন চুক্তি করেছিল ১৯৯৬ সালে। সে চুক্তি অনুযায়ী পানি বাংলাদেশ কোনো বছরই পায়নি। এখন আবার চুক্তি করতে রাজি হয়েও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে ভারত সই করছে না। ভবিষ্যতেও করবে বলে মনে হয় না। মমতা ব্যানার্জি বলেই দিয়েছেন, বাংলাদেশকে এক ইঞ্চি জমি কিংবা এক ফোঁটা নদীর পানিও তিনি দেবেন না।

 

বাংলাদেশী লেন্দুপ দর্জি?

দিল্লি আবারো শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। দিল্লির প্রতি আওয়ামী সরকারের বদান্যতা ইতোমধ্যেই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চার বছর আগে দিল্লিতে গিয়ে যে চুক্তি করে এসেছিলেন, সেসব চুক্তির বিষয়বস্তু, এমনকি সংখ্যাও বাংলাদেশের মানুষকে জানতে দেয়া হয়নি। কিন্তু আমরা দেখেছি তার আমলে এশিয়ান হাইওয়েটি দিল্লিকে দিয়ে দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের রেল, সড়ক ও নদীগুলো দেয়া হলো, এমনকি বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর দুটিও খুলে দিয়েছেন দিল্লির জন্য। সবই বিনামূল্যে। এখন আর কী কী চায় দিল্লি? এ দেশে কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে লেন্দুপ দর্জির সমকক্ষ দেখতে চায় দিল্লি। বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা এখনো সিকিমের মতো দিল্লির হাতে তুলে দেননি। আরো কিছুকাল ক্ষমতায় বহাল থাকলে আরো কিছু গোপন চুক্তিতে সই করিয়ে নেয়ার সময় পাবে বলে আশাবাদী দিল্লি। অবশিষ্ট চাহিদাও সে পূরণ করে নিতে চায়।

এই প্রেক্ষাপটে ৫ জানুয়ারি ভোটারবর্জিত নির্বাচনের বৈধতা দেখাতে উঠেপড়ে লেগেছে দিল্লির সাউথ ব্লক। পররাষ্ট্রমন্ত্রক এবং তার কূটনীতিকদের বিশাল বাহিনী বিশ্বজোড়া ওভারটাইম তৎপরতা শুরু করে দিয়েছেন। বিদেশীরা যেন দয়া করে মেনে নেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী ফলাফল বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। তা না হলে বিপদ আছে। বিপদ শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের জন্য। ভারতের জন্যও। বাংলাদেশে গণনির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ও বিরোধী রাজনীতিকদের কারারুদ্ধ করে রেখে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ বন্ধ করতে এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন করতে বিদেশীরা শেখ হাসিনার সরকারকে দীর্ঘকাল ধরে অনুরোধ ও উপরোধ করে আসছেন। তিনি তাতে কান দেননি। বরং তার আচরণে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য কোনো কোনো রাষ্ট্র অপমান বোধ করেছে।

এর পরিণতি বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ভোগ করতে শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের মূল আমদানিকারক। তারা বাংলাদেশের পরিবর্তে অন্যান্য দেশে অর্ডার দিতে শুরু করেছেন। পদ্মা সেতুর কেলেঙ্কারির ফলে বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, মালয়েশিয়া ও জাপান বাংলাদেশকে ঋণসাহায্য দানের ব্যাপারে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। ইদানীং প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পড়ে গেছে। শ্রমিক রফতানি পড়ে গেছে অর্ধেক। সুতরাং ভবিষ্যতে রেমিট্যান্স আরো কমে যাবে। দেশের ভেতরে যেসব বিত্তসম্পদ ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা আর ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এর বিরাট অংশ আগেই ভাগাভাগি করে নিয়েছেন এবং বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। বিদেশী ঋণ বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশ লাটে উঠবে। এই সরকারের স্বভাব না বদলালে সেটাই হবে- বিদেশীরা আনুষ্ঠানিক অবরোধ আরোপ করুক আর নাই করুক।

আওয়ামী লীগ সরকারকে অন্যায় ও একতরফা সমর্থন দেয়ার খেসারত হিসেবে ব্যবসায়ী সমাজ এখন চোখে সরষে ফুল দেখছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ এক অর্থনৈতিক শ্মশানে পরিণত হতে পারে, যার ওপর রাজত্ব করবে আওয়ামী লীগ। 

অন্যায় ও অত্যাচার যেখানে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, প্রতিরোধ ও সহিংসতা সেখানে অনিবার্য হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি যখন সহিংসভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবি ঠেকিয়ে রাখছিল, নজরুল যখন লিখেছিলেন ওদের বাঁধন যতো শক্ত হবে, মোদের বাঁধন টুটবে’, ভারতবাসী তখন অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে সহিংস স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছে, গান্ধীজীর অহিংসার ডাক তারা সব সময় মেনে চলেনি। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের অমানুষিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং নেলসন ম্যান্ডেলা অবশেষে সহিংস প্রতিরোধ ও গেরিলাযুদ্ধ শুরু করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ম্যান্ডেলা স্বয়ং গেরিলাযুদ্ধ করেছেন, এর শাস্তি হিসেবে ২৭ বছর একটানা জেল খেটেছেন। কিন্তু অত্যাচারী যখন অনুশোচনা করেছে, সঠিক পথে ফিরে এসেছে, ম্যান্ডেলা তখন শান্তি ও সমঝোতার পরামর্শ দিয়েছেন। সদ্য প্রয়াত ম্যান্ডেলার আদর্শকে মানবজাতি দীর্ঘকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। আওয়ামী লীগের ভারতের প্রতি নতজানু নীতি, আগ্রাসী রাজনীতি, ক্যাডারদের দৌরাত্ম্য, দলীয়কৃত বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্যাতন ও হত্যা ইত্যাদি চলছে। এ অবস্থায় মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকতে পারে না। কোনো-না-কোনো পন্থায় প্রতিরোধ করতে তারা বাধ্য হবে।

বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে বহু ভুলভ্রান্তি করেছে। একবার প্রতিপক্ষ চিহ্নিত হয়ে গেলে তার প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানো বিজ্ঞতা নয়। কারণ সেটাকে দুর্বলতা বলে ভুল করা হয়। থেমে থেমে ও জিরিয়ে জিরিয়ে আন্দোলন হয় না এবং চূড়ান্ত পদক্ষেপের জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিলম্ব করার ঝুঁকি মারাত্মক। তার ফলে বহু কর্মী হতাশ ও নিস্তেজ হয়ে পড়তে পারে। অবশ্য বিএনপির নিজের কিছু দুর্বলতা ছিল। শৃঙ্খলার অভাব এবং প্রথম কাতারের নেতৃত্বের সবার আনুগত্য পরীক্ষিত না হওয়ায় আন্দোলন বাধা পেয়েছে। তবুও বিএনপির জন্য আশার কথা, ৫ তারিখের নির্বাচনকে স্বতঃস্ফূর্ত বর্জন প্রমাণ করে, আন্দোলন এখন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় কর্মী ও সমর্থকেরা নিজেদের উদ্যোগে কর্মসূচি ঘোষণা ও পালনে তৎপর হয়েছেন। দু-একজন নেতা বিশ্বাসঘাতকতা করলেও আর আন্দোলনকে পথভ্রষ্ট করতে পারবেন না।

আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিযোগিতায় বাজিমাত করতে ভালোবাসে। যিনি প্রথম হতে চান, কাসে তার একমাত্র ছাত্রী হওয়া প্রয়োজন। এজন্য শত্রুর হাত-পা পিছমোড়া করে বেঁধে তার সাথে লড়াই করা দরকার। পাঁচ বছর ধরে বিএনপির বক্তব্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ায় সর্বপ্রকারের বাধা দিয়েছে সরকার। এ দলের সভা-সমাবেশ ও মিছিলে বাধা দেয়া হয়েছে, এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো ছাড়াও অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তদের ব্যবহার করা হয়েছে। বস্তুত এ লক্ষ্যে ক্ষমতাসীনেরা দেশটিতে ব্যাপক দুর্বৃত্তায়ন করে ফেলেছেন।

 

বাকস্বাধীনতারও গণহত্যা

সরকারের বিরোধী ও সমালোচক মিডিয়ার কণ্ঠরোধের সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চ্যানেল ওয়ান, ইসলামিক ও দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্য টিভি চ্যানেলগুলোর ওপরও সরকারি হুকুম বর্ষিত হচ্ছে। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে বিনা বিচারে কারাবন্দী করে জেলে এবং রিমান্ডে নির্যাতন করা হচ্ছে তার ওপর। আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় তালা দিয়ে মুদ্রণ বন্ধ করেছে সরকার। এই পাঁচ বছরে শাসক দলের মদদপুষ্টরা দুই ডজন সাংবাদিককে হত্যা করেছে। বহু সাংবাদিক দুর্বৃত্তদের আক্রমণে আহত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলোর প্রায় সব শীর্ষ নেতাকে সাজানো মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। অন্যদের ভয় দেখিয়ে আত্মগোপন করতে বাধ্য করা হয়েছে।

এবার নির্বাচনের ১৩ দিন আগে থেকে খালেদা জিয়াকে কার্যত গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। তার সাথে যারা দেখা করার চেষ্টা করেছেন তারাও অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। পুলিশ দিয়ে তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করানো হয়েছে। বিবিসি, আলজাজিরা, রয়টার্স, নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রভৃতি মর্যাদাবান বিশ্বমিডিয়াকে বেগম জিয়ার সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি। তারপরেই শুধু নির্বাচন করার সাহস পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সে নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ১০ শতাংশ ভোট পেয়েছে বলেই জনগণ মনে করে। বিশ্বব্যাপী সাংঘাতিক মার খেয়েছে দলটির বিশ্বাসযোগ্যতা। এ ধকল কাটিয়ে উঠতে বহু বছর লাগবে।

গুলি খাওয়া প্রাণী মরিয়া হয়ে যাকে-তাকে আক্রমণ করে। তাদেরও হয়েছে সে দশা। যে কদিন তারা ক্ষমতায় থাকছেন বাহিনী এবং দলের দুর্বৃত্তদের তারা বিরোধীদের ওপর লেলিয়ে দেবেন। নির্যাতন-নিপীড়ন চরমে পৌঁছবে। ১৮ দলের নেতাকর্মীদের আত্মরক্ষার জন্য ব্যস্ত থাকতে হবে। ঢাক ঢাক গুড় গুড় করে আর লাভ নেই। এ দিকে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ বাধানোর পাঁয়তারা চলছে। 

বিশেষ করে বিএনপি নেতৃত্বকে একটা কাজ অবিলম্বে করতে হবে। তাদের ঘোষণা করতে হবে, শুধু নতুন সরকারের আমলেই নয়, ২০১০ সাল থেকে সরকার বিদেশের সাথে যেসব চুক্তি করেছে, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সেসব চুক্তি মান্য করতে বাধ্য থাকবে না। প্রতিবেশী দেশের সাথে বিবাদ-বিসম্বাদ চায় না বাংলাদেশ। কিন্তু তারা স্বাধীনতাকে ভালোবাসে। কখনোই তারা সিকিম হতে রাজি হবেন না।

 

প্রয়োজন ঈমানদারি

শেখ হাসিনা এখনো দাবি করছেন যে, তিনি সংবিধান রক্ষার্থে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছেন। সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কথা। সংবিধান কিংবা আদালতকে তারা আসলেই সম্মান করেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। নতজানু এক বিচারপতির অত্যন্ত বিতর্কিত একটা রায়ের একটা অংশ প্রধানমন্ত্রী ব্যবহার করছেন মাত্র। অন্য অংশে স্পষ্ট করে বলা ছিল, পরবর্তী দুটি (অর্থাৎ দশম ও একাদশ) সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই করা যাবে।

এখনো প্যাঁচের খেলা চলছে, বিএনপিকে ফাঁদে ফেলার স্বপ্ন দেখছেন আওয়ামী নেতারা। গত সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি যদি আন্দোলনের পথ ছেড়ে দেয় এবং জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে, তাহলে তিনি পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে সংলাপে রাজি হবেন। দেশের মানুষ কতটুকু বিশ্বাস করছে এই সরকারকে? সংলাপ হবে বলে তিনি জাতিসঙ্ঘকেও কথা দিয়েছিলেন। কোথায় গেল সেই সংলাপ? বিএনপি যদি আন্দোলন বন্ধ করে তাহলে সত্যিকারের এবং অর্থবহ সংলাপ করে বিশ্বস্ততা দেখাবেন তিনি? মনে হয় না। তখন বগল বাজাবেন এই বলে যে, তিনি বিএনপিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছেন। আর জামায়াতে ইসলামী? বিএনপি কারো সাথে মৈত্রী করবে কি করবে না, সেটা সম্পূর্ণরূপে তার নিজের এখতিয়ার। তারা কেন অন্যের কথায় ওঠা-বসা করবে?

সবাই জানে, জামায়াত একটি নিবন্ধিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। তারা দিল্লির কাছে নতজানু হতে রাজি নয় বলেই ভারত এ দলের অস্তিত্ব লোপ করতে চায়। এ কথা বুঝতে হবে, প্যাঁচপোঁচ আর ফাঁদের খেলা ছেড়ে দিয়ে ঈমানদারির পথে না এলে নেতৃত্বের প্রতি জনআস্থা আর ফিরে পাওয়া যাবে না।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads