ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
আমরা তিমিরবিনাশী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিমিরবিলাসী হয়ে পড়েছি। ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আর সবচাইতে যা বিপজ্জনক তা হলো জবরদস্তির মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের বিপুল আস্ফালন। তারা অবশ্য দাবি করার চেষ্টা করছেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষ বলছে যে, ৫ জানুয়ারি এখানে কোনো নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়নি। কার্যত কিছু লোকের নাম ঘোষণা করে দিয়ে জনগণকে জানান দেয়া হয়েছে যে, এই লোকেরা তোমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমরা তাকে দেখিনি, চিনি না। তাকে ভোটও দেইনি। ভোট হলেও তাকেই ভোট দিতাম কিনা সেটাও জানি না। কিন্তু আমাদেরকে বলা হচ্ছে তুমি মানো বা না মানো এই-ই তোমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আর জনগণকে সেটাই মেনে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
এটা ফ্যাসিবাদের আর একটা রূপ। পৃথিবীতে কালে কালে ফ্যাসিবাদ নানাভাবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু তাদের চরিত্র থেকেছে অভিন্ন। সে চরিত্র হলো মানুষের উপর জবরদস্তি। মানুষ যা চায়নি সেটা তাকে করতে বাধ্য করা হয়েছে। মানুষ যা চায় না সেটা তাকে চাইতে বাধ্য করা। কিন্তু মানুষের ধর্মই হলো এই যে, তারা কখনোই তাদের বিবেচনার বাইরে জোর জবরদস্তির মাধ্যমে চাপিয়ে দেয়া ব্যবস্থা মেনে নেয় না। আর শেষ পর্যন্ত মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেই। এসব চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। পৃথিবীর ইতিহাস এভাবেই আবর্তিত হয়েছে। তা থেকে অবশ্য ফ্যাসিবাদীরা কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেনি। এক ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে কিন্তু আর এক ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটেছে। এভাবেই চলছে।
বাংলাদেশে এখন যে সরকার তারা একই ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি। জনগণের ইচ্ছা বা আকাক্সক্ষার এখানে কোনো মূল্য নেই। রাষ্ট্রীয় শক্তির জোরে তারা জনগণের উপর যা খুশি তাই- নীতি কিংবা নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে গত ৫ জানুয়ারি যে প্রহসন হয়েছে তার ইতিহাস বড় বিরল ঘটনা। ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমানও এদেশে এমন একটি নির্বাচন করেছিলেন। সেখানেও তার মনে হয়েছিলো যে, বাংলাদেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের সবগুলোই তার দরকার। সে কারণেই তিনি আওয়ামী লীগের বাইরে যারা জিতেছিলো তাদের বিজয় নাকচ করার জন্য জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার অর্থ হলো আওয়ামী লীগ ছাড়া এদেশে আর কোনো রাজনৈতিক দল থাকতে পারবে না। এই মানসিকতার ভয়াবহ পরিণতিতেই শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালে এসে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন। একদলীয় বাকশাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ, ভিন্নমত প্রকাশের পথ রুদ্ধ, চিন্তা চেতনার স্বাধীনতা রুদ্ধ- যেনো গোটা বাংলাদেশের মানুষ তার কাছে ক্রীতদাস মাত্র। যেন তার অঙ্গুলী হেলনেই পরিচালিত হবে দেশ। তার বাইরে কেউ কোনো ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারবে না।
সেই দুঃসহ দিনে জনগণ একেবারেই যেনো রুদ্ধবাক হয়ে গিয়েছিলো। যেনো স্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছিলো সব। কিন্তু তাদের ভেতরে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিলো তার মীমাংসা সহজ ছিলো না। সে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। শেখ হাসিনা রাজনীতিতে প্রবেশ করার সময় বলেছিলেন যে, যে জাতি তার পিতৃহত্যার বিচার করেনি, তাদের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্যই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। সে প্রতিশোধ নেয়ার পালা বোধকরি এখনও শেষ হয়নি। প্রতিশোধের পালা চলছেই।
এর আগে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন এমনই ছিলো তার রাজনীতি। কিন্তু সে সময় খানিকটা রাখঢাক ছিলো। ২০০৮ সালে ইন্দো-মার্কিন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সে রাখঢাকের পাট তিনি চুকিয়ে দিয়েছেন। সর্বগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের অস্তিত্ব, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বই বিপন্ন করে তুলেছেন। দেশকে কার্যত ভারতীয় করদ রাজ্যে পরিণত করেছেন শেখ হাসিনা। পৃথিবীতে এখন বাংলাদেশ এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেই। জাতিসংঘ নেই। মধ্যপ্রাচ্য নেই। শুধুমাত্র ভারত আছে পাশে। অনেকখানি ভুটানের দশা। ভুটানে ম্যাচবাক্স ভারত থেকে আসে। কিছু কাঠের কারবার ছাড়া আর কোনো কিছুই তাদের নিজস্ব নেই। ভুটানের ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার জন্য ভারত ছাড়া গত্যন্তর নেই। সেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। মেডিকেল কলেজ নেই। সবই ভারতনির্ভর। ভুটান এমন একটা দেশ, যা কেউ কোনদিন দখলও করতে যায়নি। কেবলই পাথুরে পর্বতমালা আকাশছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ যা আছে তা কেবলই বড় বড় বৃক্ষ। পানি নেই। বৃষ্টি নেই। বরফ চুইয়ে যেটুকু পানি নামে সেটাই ভরসা। সেখানকার মানুষ তিন-চার মাস গোসলও করে না। শৌচকার্য সারে পাথর দিয়ে। শহরে যেটুক পানির ব্যবস্থা তাও ছড়া নির্ভর। বাকি সব খাঁ খাঁ বিরান। আর শহর বলতে- পারো এবং থিম্পু। বিমানবন্দর শুধু পারোতে।
বাংলাদেশকে এখন শেখ হাসিনা সরকার তেমন এক ভুটানের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের দশা এখন অনেকটাই খাঁ খাঁ বিরান। ভবিষ্যতে আরও বিরান ভূমি হবে। এ নিয়ে সরকারের কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই। ঐ যে জনগণের উপর প্রতিশোধ নেয়ার আকাক্সক্ষা- সেটাই মুখ্য হয়ে আছে। ৫ জানুয়ারি প্রহসনের মধ্য দিয়ে যারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন, তারা আবোল-তাবোল বকছেন। আবোল-তাবোল বকছেন শেখ হাসিনা নিজেও। কিন্তু যারা আমাদের নেতৃত্বে থাকেন তাদের কাছ থেকে আমরা এতোটা আবোল-তাবোল আশা করিনা। একবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন গ্যারি হার্ট। তার বিজয় প্রায় নিশ্চিত ছিলো। সকল জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছিলো তিনিই হবেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তার বিপত্তি ঘটলো অন্য কারণে। নির্বাচনী প্রচারণার মাঝখানে তিনি এক গভীর বনে কয়েক রাত্রি কাটাতে গিয়েছিলেন তার প্রেমিকা ডোনা রাইচকে নিয়ে। কিন্তু পাপারাজি ফটোগ্রাফাররা তার ছবি তুলে পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছিলো। সে এক বিরাট কেলেংকারী। শেষ পর্যন্ত গ্যারি হার্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। কেনো তাকে সরে দাঁড়াতে হলো? তখন মার্কিন সংবাদপত্র এক জরিপ চালায়। তাতে দেখা যায় অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক পরকীয়ার সমর্থক। তারা নিজেরা হয় পরকীয়ায় জড়িত অথবা পরকীয়ায় ব্যর্থ। তবু তারা কেনো গ্যারি হার্টকে নিয়ে এমন করলো? এর জবাবে মার্কিন সাধারণ নাগরিকরা জানিয়েছিলো যে, তারা খারাপ হতে পারে কিন্তু তাদের যে নেতৃত্ব দেবে তার খারাপ হলে চলবে না। তাকে অবশ্যই আদর্শবান, চরিত্রবান হতে হবে।
অর্থাৎ যিনি নেতা হবেন আমরা সব সময় চাই, আমাদের নেতাও তেমনি সজ্জন ও ভদ্র আচরণকারী হবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন বলেন, ‘গোলাপীরে গোলাপী ট্রেন তো মিস করলি।’ তখন আমাদের লজ্জার অবধি থাকে না। এর দু’টো অর্থ। প্রথমত; এই ভাষা ভব্যতার সঙ্গত নয়। দ্বিতীয়ত; যিনি আমাদের নেতা তার কাছ থেকে এরকম ভাষা কাম্যও নয়। কিন্তু শেখ হাসিনা এরকম ভাষায় স্বস্তিবোধ করেন। আর শেখ হাসিনা যখন এরকম কথা বলেন, তখন তার আস্থাভাজন হওয়ার জন্য পারিষদ দলবলে তারও শতগুণ। এমনকি লক্ষ্য করলাম যে, তোফায়েল আহমেদও এই পারিষদ দলে নাম লিখিয়েছেন। যা খুশি তাই বলছেন। যেন এরা কেউ উপলব্ধিই করছেন না যে, ৫ জানুয়ারি কোনো নির্বাচনই হয়নি এদেশে। এবং তারা কেউই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিও নন। তা সত্ত্বেও এমন ফুটানির কথা তারা কীভাবে যে বলতে পারেন!
অথচ এখন বাংলাদেশে সেটাই ঘটছে। স্বৈরশাসন, ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ে সিন্দবাদের দ্বৈত্যের মতো চেপে বসেছে। র্যাব, পুলিশ, বিজিবি এইসব দিয়ে সরকার প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। এতো রক্ত! এতো রক্তের হলি খেলা! এর যে কোথায় শেষ হবে কেউ বলতে পারেনা। হত্যা বাংলাদেশে এখন সবচাইতে সহজ কাজ। পুলিশ প্রায় খোলামেলাভাবেই চালাচ্ছে গ্রেফতার বাণিজ্য। সেই সঙ্গে বেড়েছে মুক্তিপণের কারবারও। এবং কি আশ্চর্য মুক্তিপণের দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই দুই-একজন শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু কোথায়ও প্রতিকার নেই। প্রতিকারের কথা কেউ ভাবছে বলে মনে হয়না। দেশজুড়ে এখন হত্যা আর রক্তের উৎসব। মনে হয় সরকারও সে উৎসবে শরিক। কীভাবে হবে জানি না কিন্তু এই হত্যা ও রক্তের উৎসব একসময় আরও গভীর প্রতিক্রিয়ায় ফিরে আসতে বাধ্য।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন