রবিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৪

বিবাদ নয়, দরকার সংকট কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ


ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার কারণে দেশ-বিদেশে তীব্র নিন্দা-সমালোচনার মুখেও আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে সমঝোতা বা গণতন্ত্রমুখী কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। জনগণের আশার গুঁড়ে ক্ষমতাসীনরা ক্রমাগত বরং বালিই ঢেলে চলেছেন। এ ব্যাপারেও নেতৃত্বের ভূমিকায় রয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর সংবাদ সম্মেলন থেকে সর্বশেষ গত শনিবার অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা পর্যন্ত প্রতিটি উপলক্ষে দেয়া ভাষণে তিনি ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে শুধু যথেচ্ছভাবে তুলোধুনো করছেন না, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আক্রমণও যথেষ্টই চালাচ্ছেন। এমনভাবে জামায়াতের ‘সঙ্গ’ ত্যাগ করার তাগিদ দিচ্ছেন যা শুনে মনে হতে পারে যেন বেগম জিয়াসহ বিএনপির নেতা-কর্মীরা সবাই তার আওয়ামী লীগ করেন! তুচ্ছতাচ্ছিল্যও তিনি কম করছেন না। যেমন প্রতিটি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনে না এসে খালেদা জিয়া নাকি ভুল করেছেন এবং এই ভুলের খেসারতও তাকেই দিতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বেগম জিয়া নাকি একুল-ওকুল দু’কুলই হারিয়েছেন! খালেদা জিয়াকে ভয়-ভীতিও প্রধানমন্ত্রী কম দেখাননি। হরতাল-অবরোধ এবং আন্দোলনের নামে খুনখারাবি বন্ধ কীভাবে করতে হয় তা নাকি জানা রয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী এই বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, যতটা দরকার এবার ততটাই কঠোর হবেন তিনি।
অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়াও কষেই জবাব দিয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং সে নির্বাচনের আড়ালে গঠিত শেখ হাসিনার সরকারকে ‘অবৈধ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, সন্ত্রাস, কারসাজি, অন্তর্ঘাত ও অপপ্রচারÑ এই চার অস্ত্রে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় ক্ষমতায় এসেছে নতুন সরকার। কিন্তু গায়ের জোরে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে না তারা। ন্যায়, সত্য ও গণতন্ত্রের জন্য জনগণের আন্দোলনের বিজয় অনিবার্য এবং তা সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রধানমন্ত্রীর বাগাড়ম্বরের জবাবে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, তারা নন, সব কূল হারিয়েছেন ক্ষমতাসীনরাই। যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচন করা হয়েছে সে সংবিধানকেও ক্ষমতাসীনরাই লংঘন করেছেন। তারা সংবিধানের অপব্যাখ্যা যেমন দিয়েছেন তেমনি এর অপব্যবহারও করেছেন। প্রচ- দমন-নির্যাতন এবং গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলাসহ নির্বাচনপূর্ব ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, সব মিলিয়েই গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন ক্ষমতাসীনরা। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণ সমুচিত জবাব দেবে বলে হুঁশিয়ার করে খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, জনগণই গণতন্ত্রকে পুনরায় ফিরিয়ে আনবে। উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীনদের তীব্র সমালোচনা করলেও বেগম জিয়া কিন্তু একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য সমঝোতা ও সংলাপের আহ্বানও জানিয়েছেন।
ক্ষমতার জোরে মারমুখী কথা অনেক বেশি বললেও পর্যালোচনায় কিন্তু দেখা গেছে, বেগম খালেদা জিয়ার তুলনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেবল পিছিয়েই পড়ছেন। জনগণের মধ্যেও তার মারমুখী উদ্দেশ্যের দিকটিই বেশি আলোচিত হচ্ছে। কারণ, যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে সমঝোতার ধারেকাছে যাওয়ার পরিবর্তে একতরফা নির্বাচনের পথে এগিয়ে গেছেন তিনি। গত বছরের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত অবরোধ এবং নির্বাচন বাতিলের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনকে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে তার সরকার শ’ দেড়েক মানুষকে হত্যা করেছে। বেগম খালেদা জিয়াকেও তার বাসভবনে অবরুদ্ধ রেখেছে। দমন-নির্যাতন এবং হত্যা ও গ্রেফতারের অভিযান এখনও চলছে। তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জনগণকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারেননি। জনগণ বরং বেগম খালেদা জিয়ার ডাকেই সাড়া দিয়েছে। ফলে স্থাপিত হয়েছে সর্বনিম্ন পরিমাণ ভোটারের রেকর্ড। এমন এক অবস্থায় উচিত যেখানে ছিল সমঝোতামুখী উদ্যোগ নেয়া প্রধানমন্ত্রী সেখানে উল্টো আক্রমণাত্মক হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এমনকি নিজের নির্বাচনপূর্ব ঘোষণা থেকেও সরে গেছেন, যার মূল কথায় তিনি নিজেই বলেছিলেন, দশম সংসদ নির্বাচনের পর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সব দলকে সঙ্গে নিয়ে একাদশ সংসদের নির্বাচন আয়োজন করা হবে। বিভিন্ন ভাষণে তিনি বরং বুঝিয়ে চলেছেন, তারা পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ না করে ক্ষমতা ছাড়বেন না। এমন ঘোষণার পাশাপাশি আন্দোলন দমন করার হুমকি এবং আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে জামায়াতের ‘সঙ্গ’ ত্যাগ করার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি ‘পরামর্শ’ দেয়ার মাধ্যমেও প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সামান্য আগ্রহও তাদের নেই। বিরোধী দলের প্রতি তিনি বরং ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাবেন এবং কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। প্রশাসন ও সব বাহিনীকেও দলীয় কর্মী ও লাঠিয়ালের মতো ব্যবহার করবেন। অর্থাৎ তার ফ্যাসিস্ট নীতি ও কর্মকা-ে পরিবর্তন ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী যে কথার কথা বলেননি বরং আসলেও ‘মিন’ করেছেন তার প্রমাণও এরই মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা কিন্তু মনে করি না যে, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সবকিছু শুধু তার একার ইচ্ছায় চলবে। জনগণের প্রতিক্রিয়ার দিকটিকেও তার বিবেচনায় নেয়া উচিত।
বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার বিষয়টিকেই আমরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। পাঁচ থেকে সাত শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি বলেই জনগণের পাশাপাশি বিদেশিরাও এ নির্বাচনকে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য মনে করতে পারছেন না। একই কারণে একদিকে ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকরা নির্বাচন ও গঠিত সরকারকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন অন্যদিকে সরকারের প্রতি স্বীকৃতি আসছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। একই কারণে বিদেশী কূটনীতিকরা আবারও বিএনপির সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠানের জন্য এবং সব দলের অংশগ্রহণে নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়াও সরকারের উদ্দেশে একই কথা বলেছেন। আমরা মনে করি, ক্ষমতাসীনদের উচিত একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা থেকে সরে আসা এবং খালেদা জিয়া ও বিদেশীদের আহ্বানে সাড়া দেয়া। এজন্য অনুষ্ঠিত নির্বাচন এবং তার মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল করতে হবে এবং তারপর সংবিধানে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধান যুক্ত করে সে সরকারের অধীনে নতুন করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। আমরা আশা করতে চাই, সময় নষ্ট না করে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেই ক্ষমতাসীনরা বেশি  উদ্যোগী হবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads