বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৪

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মূল সঙ্কট


একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ কখনোই আরেকজনকে অপমান করতে পারেন না। কদিন আগে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, টকশোতে যারা কথা বলেন তারা সব বিষয়ে পারদর্শী, শিশুদের দুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠানেও নাকি কথা বলেন। সব বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য না থাকতে পারে। তাই বলে কি অন্যদের থাকতে নেই? আর ওনার প্রধানমন্ত্রী তো বলেন, টকশোতে যারা কথা বলেন, তারা নাকি মধ্যরাতের সিঁধেল চোর। খেলার মাঠে খেলোয়াড় তো উনি একাই। তাই ইচ্ছেমতো গোল দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা খুব সহজেই অনুমান করতে পারি, কেন আমাদের দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা আজ লাঞ্ছিত, অপমানিত? কেন তারা বরেণ্য ব্যক্তিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলেন।

আমাদের রাজনীতি কলুষিত হয়েছে, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আজ বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অবস্থানে থাকার কথা ছিল। দেশের বরণ্যে ব্যক্তিরা সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, খেলতে পারেন না, আর ফাইভ পাস কণ্ঠশিল্পী মাঠ দাপিয়ে বেড়ান, গোল দেন (তবে আত্মঘাতী)। এ কারণে আমাদের সরকারপ্রধানকে বিশ্বরাজনীতিতে তেমন কেউ ডাকে না। এমনকি সুইজারল্যান্ডের ড্যাভোসে অর্থনীতি নিয়ে যে আলোচনা সভা হয়, সেখানেও কারো ডাক পড়ে না, একমাত্র ড. ইউনূস ছাড়া।

তবে মন্দের ভালো এই, খালেদা জিয়া উপদেষ্টা ও তার দলের সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ নেন এবং গ্রহণ করেন। আর শেখ হাসিনা পরামর্শ নেয়া তো দূরের কথা। এ কারণে আমরা কী বলার কথা কী বলছি, কী শোনার কথা কী শুনছি। এটিই হলো জাতির দুর্ভাগ্য।

এই উপমহাদেশে আমাদের আশপাশে যে কটি রাষ্ট্র আছে তাদের অভ্যন্তরীণ সব গণ্ডগোল, রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি প্রভৃতির পেছনে বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ইন্ধন আছে। শোনা যাচ্ছে, আমাদের বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দেউলিয়া করার পেছনেও তাদের ইন্ধন আছে এবং বেশ বড় অঙ্কের টাকা তাদের দেশেই পাচার করা হয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার পেছনে তারা কলকাঠি নাড়ছেন। ভারত চাচ্ছে, যে সংবিধান শেখ হাসিনা ইচ্ছেমতো সংশোধন করে দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী নির্বাচন হোক। এ কৌশলে শেখ হাসিনা আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসবেন। এর ফলে বাংলাদেশকে তাদের দখলে নিতে তেমন অসুবিধা হবে না। আর একবার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ দেশকে কোথায় নেবে, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। 

বাংলাদেশের রাজনীতির নষ্টের গোড়া হচ্ছে- এক ব্যক্তির হাতে, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব ক্ষমতা।

মোগল সম্রাটদের হাতেও এত ক্ষমতা ছিল না বা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের হাতেও এত ক্ষমতা নেই যা বাংলাদেশের একজন প্রধানমন্ত্রী উপভোগ করেন। চেক অ্যান্ড ব্যালান্স না থাকায় এত ক্ষমতা পেয়ে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারী হয়ে যেতে বাধ্য হন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের দলের গঠনতন্ত্র এমনভাবে রচনা করেছে, সেখানেও দলের প্রধানের হাতে সর্বময় ক্ষমতা। কারো কোনো কিছু বলার নেই। নেই নতুন নেতা বা নেত্রী নির্বাচনের ব্যবস্থা। 

সংবিধান এমনভাবে রচনা করা হয়েছে যে, সেখানেও ওই এক ব্যক্তির হাতে সর্বময় ক্ষমতা। যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনি যা বলবেন, তাই হবে। মন্ত্রী-এমপিদের কোনো ক্ষমতা নেই। সবাইকে একজনের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। রাষ্ট্রপতির হাতেও কোনো ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্রপতিকেও প্রধানমন্ত্রীর কথায় ওঠবোস করতে হয়।

বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা বাস্তবায়ন হয়। 

জাতীয় সংসদের হাতেও কোনো ক্ষমতা নেই। এখানেও এক ব্যক্তির ইচ্ছা বাস্তবায়ন হয়। আর সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ তো সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর অবিবেচক আজ্ঞাবহ বানিয়ে ছেড়েছে।

যদি এক ব্যক্তির হাতে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর হাতে এত ক্ষমতা থাকে, তাহলে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের দোষ কোথায়?

প্রচলিত পদ্ধতিতে কোনো এক ব্যক্তি বা দলীয়প্রধান, পাঁচটি আসনের মধ্য থেকে, চারটি আসনে পরাজিত হয়ে, মাত্র একটি আসনে অল্প কিছু ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেও, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কাজে লাগিয়ে, সরকারপ্রধান হতে পারবেন এবং রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে যেতে পারবেন। এ পদ্ধতিতে একটি বা একাধিক সংসদীয় আসনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে, চা-বিস্কুট-বিরিয়ানি এবং নগদ ৫০০ টাকা দিয়ে ভোট কিনে সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করা যায়।

অন্য দিকে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায় কোটি কোটি মানুষকে ঘুষ, টাকা দেয়া সম্ভব নয় এবং নির্বাচনের জিততে হলে ১০ কোটি ভোটারের মধ্যে কমপক্ষে ৫১ শতাংশ ভোট পেতে হয়।

আমেরিকার রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায়, একজন রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর। একজন ব্যক্তি পরপর দুই টার্ম অর্থাৎ মোট আট বছর রাষ্ট্রপতি থাকতে পারবেন। পরের টার্মে তিনি আর নির্বাচন করতে পারবেন না, যা আমাদের দেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় অনুপস্থিত। এ কারণে এ ধরনের সংসদীয় ব্যবস্থাকে সংসদীয় রাজতন্ত্রবলা যেতে পারে। আমাদের দেশে ফিলিপাইনের মতো এক ব্যক্তির মেয়াদ মাত্র এক টার্ম (তা-ও আবার চার বছর) করা উচিত, যাতে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারে।

এ ছাড়া আমেরিকার রাষ্ট্রপতির হাতে সর্বময় ক্ষমতা নেই। নির্বাচনের সময়ে তিনি একজন উপরাষ্ট্রপতি রানিংমেট হিসেবে নির্বাচন করেন এবং উপরাষ্ট্রপতি সংসদের উচ্চকক্ষের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। যদি কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি নিহত হন বা মারা যান, তাহলে উপরাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতির। ফলে নতুন নির্বাচনের প্রয়োজন পড়ে না। ফলে নির্বাচন প্রতি চার বছর পর হওয়ার এর ব্যত্যয় ঘটে না।

আমেরিকার কিছু ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে, কিছু ক্ষমতা সংসদের হাতে, কিছু ক্ষমতা আদালতের হাতে। ফলে কোনো রাষ্ট্রপতি স্বৈরাচারী হতে পারে না। তিনি এককভাবে কিছু করতে পারেন না। সবার সাথে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান তাকে করতে হয়।

আমাদের দেশের রাজনীতির মানে হচ্ছে লক্ষকোটি টাকার বাণিজ্য। আগে মানুষ দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকার দুর্নীতি করত। এখন আস্ত একটা ব্যাংক গিলে খাওয়া কোনো ব্যাপার না।

আর এক ব্যক্তির হাতে সর্বময় ক্ষমতা থাকায় ক্ষমতার অপব্যবহারের শঙ্কা কেবল বেড়েই চলেছে।

একজন সংসদ সদস্য নির্বাচনে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা খরচ করে, পরবর্তী পাঁচ বছরে শতকোটি টাকা আয় করে থাকেন। আজ যদি ঘোষণা দেয়া হয়, এখন থেকে সংসদ সদস্যদের কাজ শুধু আইন প্রণয়ন করা। তাহলে খুব কম লোকই নমিনেশন পেপার কিনবেন।

বাংলাদেশের সংবিধান অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। এ সংবিধান দিয়ে সামনে এগোনো যাবে না। এটি পুনর্লিখন করতে হবে। এ সংবিধান ক্ষমতাসীনদের রক্ষাকবচ। এ সংবিধান সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ। 

সমাধান :

বাংলাদেশের প্রতিটি পদের মেয়াদকাল চার বছর হওয়া উচিত। পরপর দুটি মেয়াদ পূর্ণ করার পর আর কোনো নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি চেক অ্যান্ড ব্যালান্সআনা দরকার। আমেরিকার মতো কিছু ক্ষমতা জাতীয় সংসদের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে, কিছু ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে। তা হলে আর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করা সহজ হবে না। 

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads