আওয়ামী গণতন্ত্রের ইতিহাসে জানুয়ারি’ শিরোনামে গত সপ্তাহের উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জানুয়ারি মাসের সম্পর্ক নিয়ে লিখেছিলাম। এতে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল-এর একদলীয় শাসন কায়েমের কথা ছিল। ছিল জেনারেল মইন উ’র নেতৃত্বে ১/১১’র অবৈধ অভ্যুত্থান ঘটানোর এবং তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা দখলের তথ্যওÑ যে সরকারকে শেখ হাসিনা তাদের ‘আন্দোলনের ফসল’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এবারের জানুয়ারিতে মাত্র পাঁচ শতাংশ ভোটারের ভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়ে সরকার গঠনের কথাও জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, এরকম আরো কিছু কারণে জানুয়ারি মাস বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জন্য একটি ‘ঐতিহাসিক’ মাস। দলটি যে কত ‘গণতন্ত্রে’ বিশ্বাস করে তারও প্রমাণ এ জানুয়ারি মাসের ইতিহাসেই পাওয়া যায়। স্থান স্বল্পতার জন্য অন্য একটি ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখে যাওয়া সম্ভব হয়নি। হয়তো যেতামও না কখনো। কিন্তু এরই মধ্যে সরকারের উদ্যোগে এমন কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে যেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ওই ঘটনার উল্লেখ থেকে বিরত থাকাটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সে ঘটনা একটি নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের, যার শিকার হয়েছিলেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির চেয়ারম্যান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদার। এটা ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারির ঘটনা। বাংলাদেশে তখন ‘মুজিবী আমল’ চলছিল। শেখ মুজিব সরকারের কঠোর সমালোচক ও বিরোধিতাকারী ছিলেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন বলে সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতারের হুকুম দিয়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। সিরাজ সিকদারকে তাই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছিল। তাছাড়া কমিউনিস্ট বিপ্লবী হিসেবে এমনিতেই তিনি ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ থাকতেন। তাকে এমনকি তার নিজের পার্টির সাধারণ নেতা-কর্মীরাও চিনতেন না। সে কারণে তাকে গ্রেফতার করাটাও সহজ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। কোথায়, কিভাবেÑ সে বর্ণনায় যাওয়ার আগে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ সেরে নেয়ায় যাক। এ থেকে বোঝা যাবে, এতদিন পর হঠাৎ কেন বেছে বেছে সিরাজ সিকদারের হত্যাকান্ডের কথাই বলা হচ্ছে।
পাঠকরাও নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, প্রতিদিনই দেশের নানাস্থানে হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছেন বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা। প্রথমে কখনো গ্রেফতার কিংবা গুম করা হচ্ছে তাদের। ক’দিন পর আদালতের কাঠগড়ার পরিবর্তে তাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে বনে-জঙ্গলে কিংবা রাস্তায়। এসব গুম ও হত্যাকান্ডের জন্য পুলিশ ও র্যাবসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম জড়িয়ে পড়ছে। ঘটনাগুলো শুধু আপত্তিজনক নয়, ভীতিকরও। যেমন গত ১৮ জানুয়ারি একদিনেই যে ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশি আলোচিত হয়েছে নীলফামারী সদর উপজেলার লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম রব্বানীর হত্যাকান্ড। গত ১৪ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে ওই এলাকায় প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও নতুন সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তার গাড়ি বহরের ওপর হামলার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বিএনপির ওই নেতা গোলাম রব্বানীকে প্রধান আসামী করা হয়েছিল। কয়েকদিন আগে পুলিশ তাকে পঞ্চগড় থেকে গ্রেফতার করেছিল। সেই থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে সদর উপজেলার পলাশবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের পার্শ্ববর্তী একটি বাঁশঝাড়ে তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তাকে নিষ্ঠুরভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর দু’দিন পর একই এলাকার ছাত্রদল নেতা আতিকুর রহমানের লাশ পাওয়া গেছে সৈয়দপুর উপজেলার ধলাগাছ নাড়িয়া এলাকায় বাইপাস সড়কের নিচে। আতিকও আসাদুজ্জামান নূরের মামলার আসামী ছিলেন। ঠিক কার নির্দেশে কারা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তা নিয়ে এলাকাবাসীর মনে কোনো সন্দেহ নেই।
নীলফামারীর এ দুটি হত্যাকান্ড উদাহরণ মাত্র। সাতক্ষীরার ভোমরা ইউনিয়নের শিবির কর্মী ছোটনসহ আরো অনেকে যৌথবাহিনীর প্রকাশ্য অভিযানে মারা গেছেন। এর পরপর আলোড়ন তুলেছে ১৮ জানুয়ারির অন্য তিনটি মৃত্যুর ঘটনা। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, দু’দিন আগে সীতাকুন্ডের মিরসরাই উপজেলার মিঠাছড়া এলাকা থেকে র্যাব-এর পরিচয় দিয়ে ১০/১২ জনের একটি সশস্ত্র দল ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা মোশাররফ হোসেনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল। ২০ জানুয়ারি তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে সীতাকুন্ডের টেরিয়াল এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে। অভিযোগ উঠেছে, র্যাবই তাকে হত্যা করেছে। নরসিংদীর রায়পুরা এলাকাতেও দু’জন যুবকের লাশ পাওয়া গেছে, র্যাব যাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। খবরে বলা হয়েছে, এই দু’জনের সঙ্গে র্যাবের হাতে আটক অন্য একজনের খোঁজ এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ মাত্র দু’দিনের মধ্যে সব মিলিয়ে অন্তত ২২ জনের মৃত্যু ঘটেছে, যাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন র্যাব ও পুলিশের হাতে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন উঠেছে মেহেরপুর জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল তারিক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের হত্যাকান্ডে। ২০ জানুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। তার লাশ পাওয়া গেছে রাত দেড়টার দিকে। পুলিশ দাবি করেছে, তারিক মুহাম্মদ নাকি সন্ত্রাস-বোমাবাজির মতো কথিত অপরাধের দোষ স্বীকার করেছিলেন। দলের অন্য বোমাবাজ-সন্ত্রাসীদের আস্তানা দেখিয়ে দেয়ার জন্য তাকে নিয়ে শ্মশানঘাট এলাকায় গেলে পুলিশ নাকি প্রতিরোধের মুখে পড়ে। উভয় পক্ষের গোলাগুলিতেই নাকি প্রাণ হারিয়েছেন এই জামায়াত নেতা!
পাঠকরা হত্যাকান্ডের ধরন লক্ষ্য করবেন।
এবার দেখা যাক, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সিরাজ সিকদারকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যাকান্ডের বিবরণী প্রকাশ করেছিল তৎকালীন জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ (১৯ মে, ১৯৭৮ সংখ্যা)। আসুন, ‘সিরাজ সিকদার হত্যার নেপথ্য কাহিনী’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই রিপোর্টের আলোকে ঘটনা সম্পর্কে জানি।
১৯৭৫ সালের পহেলা জানুয়ারি। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির চেয়ারম্যান সিরাজ সিকদার দাঁড়িয়ে আছেন চট্টগ্রামের হালিশহরে। একটু আগেই তিনি পার্টির উচ্চ পর্যায়ের এক সভার সমাপ্তি টেনেছেন। এবার তার ফিরে যাওয়ার পালা। ওই দিনগুলোতে কিছুটা বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছিলেন তিনি। কারণ, দেশজুড়ে সশস্ত্র কর্মকা- চালাচ্ছিলেন বলে আওয়ামী লীগ সরকার তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানও তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার এবং তার পার্টিকে নির্মূল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সে কারণে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দাদেরও জোর তৎপরতা চলছিল। সিরাজ সিকদার কিন্তু একটি বিষয়ে অসতর্ক ছিলেন : ক্ষমতাসীনদের কতজন এজেন্ট তার দলে অনুপ্রবেশ করেছে তা তিনি লক্ষ্য করেননি। এই অসতর্কতার কারণে হালিশহরের সভার খবরও গোয়েন্দাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সভা চলাকালে নিয়ম ভঙ্গ করে একজন সদস্য বাইরে চলে যান। তিনি আর ফিরে আসেননি। এ থেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন সিরাজ সিকদার। দ্রুত সভা শেষ করেছিলেন তিনি।
রাস্তায় এসে একটি বেবি ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন সিরাজ সিকদার। ওঠার পরমুহূর্তে অচেনা এক ব্যক্তি তার কাছে লিফ্ট চেয়েছিল। প্রথমে অসম্মতি জানালেও উপর্যুপরি অনুরোধে তাকে উঠতে দিয়েছিলেন তিনি। লোকটি বসেছিল চালকের পাশে। চট্টগ্রাম বিপণি বিতানের সামনে আসা মাত্র লোকটি হঠাৎ পিস্তল উঁচিয়ে ধরে এবং বেবি ট্যাক্সি থামাতে বাধ্য করে। মুহূর্তে ঘিরে ফেলে সাদা পোশাকধারী সশস্ত্র গোয়েন্দারা। জীবনের প্রথম ধরা পড়ে যান সিরাজ সিকদার। তাকে হাতকড়া পরিয়ে এবং চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় ডবলমুরিং থানায়। এরপর বিশেষ আয়োজনে কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী একটি বিমানে উঠিয়ে দেয়া হয় এবং পাইলটের আপত্তি সত্ত্বেও হাতকড়া বাঁধা অবস্থাতেই সিরাজ সিকদারকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সশস্ত্র পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিরাট একটি দল বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছিল। একজন অতি উৎসাহী পুলিশ ইন্সপেক্টর সোজা লাথি মেরে বসে সিরাজ সিকদারের বুকের ওপর। জানতে চায়, ‘তোর বিপ্লব কোথায় গেল হারামজাদা?’
তেজগাঁও বিমান বন্দর থেকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে নিয়ে আসা হয় সিরাজ সিকাদারকে। প্রচ- শারীরিক নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি অফিসাররা তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। সিরাজ সিকদার তার ভাষায় ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতকের’ কাছে ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকাকালেই টেলিফোনে নির্দেশ এসে যায়, তাকে গণভবনে নিয়ে যাওয়া হয়Ñ যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব অপেক্ষা করছিলেন। তার সামনে হাত বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করানো হয় সিরাজ সিকদারকে। শেখ মুজিব ব্যস্ততার ভান করেন, বসতে পর্যন্ত দেয়া হয় না বন্দি নেতাকে। প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন সিরাজ সিকদার। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করা হয়। এরপর কথা কাটাকাটি চলে কিছুক্ষণ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে মাথানত করতে অস্বীকার করেন সিরাজ সিকদার। মধ্যরাতে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে আসা হয় সিরাজ সিকদারকে। রাতভর অকথ্য নির্যাতন চলে তার ওপর, অভুক্ত রাখা হয় তাকে। পরদিন, ২ জানুয়ারি তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সাভারে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর বিশেষ ঘাঁটিতে। দিনব্যাপি সেখানেও চলে নির্যাতন। ঢাকা থেকে উপস্থিত হন রক্ষীবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা। বন্দি এবং অর্ধমৃত সিরাজ সিকদারকে দাঁড় করানো হয় সাভার থানার কাছাকাছি তালবাগের এক রাস্তায়। সেখানেই গুলীর পর গুলী করে তাকে হত্যা করা হয়।
পরদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় অন্য রকম বিবরণী। ‘সিরাজ সিকদার গ্রেফতার : পালাতে গিয়ে নিহত’ শিরোনামে পুলিশের বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ‘জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি (সিরাজ সিকদার) স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি দেন এবং তার দলীয় কর্মীদের কিছু আস্তানা এবং তাদের বেআইনী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দেখিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশের সঙ্গে যেতেও সম্মত হন। তদনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) রাতে একদল পুলিশ যখন তাকে ভ্যানে করে গোপন আস্তানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি সাভারের কাছে পুলিশের ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়েন এবং পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। পুলিশ তার পলায়ন রোধের জন্য গুলীবর্ষণ করে। ফলে সিরাজ সিকদারের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়।’
পাঠকরা বিশেষ করে মেহেরপুর জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল তারিক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের হত্যাকান্ডের ধরনের সঙ্গে এই ঘটনা মিলিয়ে দেখতে পারেন। দেখবেন, একই মিথ্যাচার তখনও করা হয়েছিল। সিরাজ সিকদারও নাকি তারিক মুহাম্মদের মতোই সঙ্গীদের আস্তানা দেখানোর জন্য পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে গিয়েছিলেন! আওয়ামী সন্ত্রাস ও দুঃশাসনের ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে তো বটেই, এমনকি ৩৮ বছরের ব্যবধানে আজও পর্যন্ত পুলিশ তথা সরকারের এ বক্তব্যটুকু কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্রতিটি সংবাদপত্রে সেদিন একই ভাষায় একই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। একদলীয় শাসন ও শেখ মুজিবের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি ততদিনে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল বলে দ্বিতীয় কোনো ভাষ্য প্রকাশ করার সাধ্য ছিল না কারো। পরবর্তীকালে মুখ খুলেছেন অনেকে, এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদেরও কেউ কেউ। তাদের বক্তব্য থেকে শুধু নয়, বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার বিশ্লেষণেও পরিষ্কার হয়েছে, সিরাজ সিকদারের মতো একজন কঠোর প্রহরাধীন, হাত-পা বাঁধা এবং মৃতপ্রায় বন্দির পক্ষে চলন্ত পুলিশ ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়া বা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার প্রশ্ন উঠতে পারে না। তাকে বরং সুপরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছিল। দুটি তথ্যের উল্লেখ করলেও এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। প্রথম তথ্যটি হলো, শেখ মুজিবের ভাগ্নে এবং আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির মালিকানাধীন ও সম্পাদিত দৈনিক বাংলার বাণীতে ৫ জানুয়ারি প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিল, ‘বিপ্লব করিবার জন্য চারু মজুমদারকে যে কল্পনা পাইয়া বসিয়াছিল তাহার পরিণতি সকলের জানা থাকিবার কথা। সিরাজ সিকদারের পরিণতি তাহার চাইতে ভিন্নতর কিছু হয় নাই। সিরাজ সিকদার ধৃত হইয়া মৃত্যুবরণ করিবার পর আশা করা যায়, যাহারা এই দেশে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহারা অতঃপর নিজেদের ভুল ধরিতে পারিয়াছেন।’
প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব নিজেও কিছুটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হত্যাকান্ডের সত্যতা স্বীকার করেছিলেন। একদলীয় শাসন তথা বাকশালের প্রতিষ্ঠালগ্নে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের ভাষণে তিন সিরাজ সিকদার সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছিলেন দম্ভ ও গর্বের সঙ্গে। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্ত ও উল্লসিত কণ্ঠে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ সংসদের মতো সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সেই উল্লাস ও আস্ফালন স্তম্ভিত করেছিল সমগ্র জাতিকে। প্রচন্ড দমন-পীড়ন আর হত্যা-সন্ত্রাসের মধ্যে বন্দি জনগণের কাছে একথাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, সিরাজ সিকদার পালাতে গিয়ে নিহত হননি, তাকে হত্যা করা হয়েছিল এবং হত্যার নির্দেশ এসেছিল সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।
ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় অর্জিত হয়েছিল বলে সিরাজ সিকদার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণরূপে মেনে নিতে রাজি হননি। তার মতে স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ‘ভারতের উপনিবেশে’ পরিণত হয়েছিল। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সিরাজ সিকদার বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও (রুশপন্থী নেতা) মনি-মোজাফফর বিশ্বাসঘাতক চক্র ক্ষমতার লোভে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জাতীয় স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং জাতীয় আত্মমর্যাদা পদদলিত করেছে।’ সিরাজ সিকদারের মতে তাই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনদান ব্যর্থ হয়েছে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। এজন্য তিনি আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে ‘স্বাধীন গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ নিরপেক্ষ প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র’ এবং তার সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন। (মার্চ, ১৯৭২)
এই বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে স্বাধীনতার পরও সর্বহারা পার্টির গেরিলাযুদ্ধ ও সশস্ত্র কর্মকান্ড অব্যাহত ছিল। ১৯৭৩-৭৪ সময়কালে সর্বহারা পার্টির কর্মকান্ড সর্বাত্মক হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, দমন-পীড়ন এবং গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সিরাজ সিকদার দ্রুত এক জনপ্রিয় বিপ্লবী নেতা হিসেবে নন্দিত হতে থাকেন। তার আহ্বানে ১৯৭৪ সালের বিজয় দিবসে আংশিকভাবে হলেও হরতাল পর্যন্ত পালিত হয়েছে। সিরাজ সিকদারের এই বিচিত্র কিন্তু অসাধারণ সাফল্য ও জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রত করেছিল। সে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। একই কারণে সিরাজ সিকদারকে শুধু হত্যা করা হয়নি, শেখ মুজিব নিজেও উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন।
একথা সত্য, স্বাধীনতা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সিরাজ সিকদার সম্পূর্ণ সঠিক ছিলেন না, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তিনি তার চিন্তা ও সিদ্ধান্তগত ভুল-ত্রুটিকে সাফল্যের সঙ্গেই অতিক্রম করেছিলেন। জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতাকে নিশ্চিত ও সমুন্নত করতে গিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত জীবনও উৎসর্গ করেছেন। বলা দরকার, সিরাজ সিকদারের সঙ্গে এই লেখকের দ্বিমত রয়েছে। তা সত্ত্বেও হত্যাকা-টিকে নিয়ে আলোচনা করার বিশেষ কারণ হলো, অন্য অনেক বিষয়ের মতো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার মধ্য দিয়ে নির্মূল করার চেষ্টার ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলছে। এজন্যই সিরাজ সিকদারের হত্যাকা-ের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে মেহেরপুরের জামায়াত নেতা তারিক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের হত্যাকা-ের। আরো অনেককেই হত্যা করা হচ্ছে একই কৌশলে। শেখ মুজিবুর রহমানের মাত্র সাড়ে তিন বছরে প্রায় ৩৭ হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল বলে প্রচারণা রয়েছে। সেদিক থেকে শেখ হাসিনার সরকার এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এটাই এখন উদ্বেগের বড় একটি কারণ!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন