বাংলাদেশকে ঘিরে আবারও বিদেশীরা তৎপর হয়ে উঠেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের মধ্যে প্রথমে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন এবং পরদিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। ঠিক কি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন বা তার ফলাফলই কি সে ব্যাপারে ব্রিটিশ হাইকমিশনার নীরবতা অবলম্বন করলেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত এক বিবৃতিতে বলেছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খোঁজা এখন বাংলাদেশের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। ড্যান মজিনা একই সঙ্গে সরকারের প্রতি বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য এবং বিরোধী দলের প্রতি সহিংসতা এড়ানোর জন্য আহবান জানিয়েছেন। এই আহ্বান অত্যন্ত সময়োচিত হলেও এবং বিষয়টি নিয়ে জোর তৎপরতা শুরু করার তাগিদ অনুভূত হলেও এরই মধ্যে হঠাৎ দৃশ্যপটে এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি নাক গলানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। চেষ্টা করেছেন বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রাখতেও। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পরামর্শ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটনের উচিত ‘ভারতের চোখে’ বাংলাদেশকে দেখা। সালমান খুরশিদের যুক্তি, ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থিত এবং সে কারণে ভারতই বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলকে এবং এ অঞ্চলের জনগণকে ভালো বুঝতে পারে। অন্যদিকে অবস্থান কিছুটা দূরে হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দেয়ার অবশ্য কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন সফরকালে সালমান খুরশিদ নাকি বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ্য করেছেন। তার মনে হয়েছে, বিশেষ করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ঠিক কোন ধরনের নীতি নিয়ে এগোচ্ছে এবং কেন একতরফা নির্বাচন করতে যাচ্ছে এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাকি সঠিক ধারণা নেই। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিশ্চয়ই অত্যন্ত জটিল ও অনিশ্চিত। কারণ, নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। এমন পরিস্থিতি ভারতের জন্য উদ্বেগজনক জানিয়ে তিনি বলেছেন, বন্ধুরাষ্ট্রে কোন্ পন্থায় নির্বাচন হবে তা নিয়ে তারা সাধারণত কোনো পক্ষ নেন না। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা এবং সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয় বলেই তারা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। সালমান খুরশিদের মতে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ প্রশ্নে নয়াদিল্লী ও ওয়াশিংটনের অভিন্ন অবস্থান নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এজন্যই তিনি ‘ভারতের চোখে’ বাংলাদেশকে দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিয়েছেন।
আমরা মনে করি, বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নেয়া যায় না। কারণ, কথার মারপ্যাঁচ খাটালেও সালমান খুরশিদের মূলকথায় বাংলাদেশের ওপর ‘দাদাগিরি’ অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যই প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই একটি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থাকেই তারা কর্তৃত্ব করতে দিতে রাজি নন। যুক্তিও চমৎকারই হাজির করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘কিছুটা দূরে’ অবস্থিত বলে যুক্তরাষ্ট্র নাকি বাংলাদেশের সমস্যা ঠিক বুঝতে পারছে না! সব কেবল তারাই বুঝতে পারছেন। দাবিটিকে হাস্যকর না বলে উপায় নেই। কারণ, তথ্য-প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের বর্তমান যুগে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রেরই সবকিছু বেশি জানার কথা। বিশেষ করে বাংলাদেশের চলমান সংকট সম্পর্কে বেশি জানে এবং বেশি আগ্রহী বলেই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সংকটের সূচনাকাল থেকেই সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৎপরতা চালিয়ে এসেছেন। এখনও তৎপর রয়েছেন তিনি। সংকট কাটিয়ে ওঠার একই উদ্দেশ্যে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা বিসওয়াল দেশাই ঢাকা সফর করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে কথা বলেছেন। এসব তথ্যের কোনো একটিও কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই দাবিকে সমর্থন করে না যে, তারাই বাংলাদেশের সমস্যা সবচেয়ে ভালো বোঝেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ আসলে দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্যের দিকগুলো। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র যেখানে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন দেখতে চায়, ভারত সেখানে সর্বতোভাবেই আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
বলা দরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একা শুধু নয়, ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, গণচীন এবং জাতিসংঘসহ গোটা বিশ্বই সরকারের একতরফা নির্বাচন চেষ্টার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারও আগে প্রতিটি রাষ্ট্র ও সংস্থাই সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছে। এ ব্যাপারে মাত্র ক’দিন আগেই বাংলাদেশ সফর করে গেছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সত্যিই বাধাহীন বিকাশ চাইলে ভারতও এই চেষ্টায় অংশ নিত এবং সব দলকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতো। ভারত উদ্যোগী হলে সরকারের পক্ষেও না করে দেয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু সালমান খুরশিদরা সে পথে যাননি। তারা বরং একতরফা নির্বাচনের ব্যাপারেই সরকারকে উৎসাহ ও সমর্থন যুগিয়ে চলেছেন। একই কারণে আওয়ামী লীগ সরকারও পুরো বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সাহস পেয়েছে। ভারতও কম যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ভারতের চোখে’ বাংলাদেশকে দেখার পরামর্শ দেয়ার মাধ্যমে সালমান খুরশিদ প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে অসম্মানিত করেছেন, নাকও গলিয়েছেন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সরকার কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। এর কারণ নিশ্চয়ই উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। আমরা উদ্বিগ্ন এজন্য যে, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে ভারত একাই ব্যবস্থা নেয়ার ফলে বাংলাদেশের পরিণতি স্বাধীনতা খুইয়ে ফেলা সিকিমের মতো হওয়ারও আশংকা রয়েছে। এ ব্যাপারেই সম্প্রতি সতর্ক করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। একই কারণে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সর্বশেষ আহ্বানকেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করিÑ যেখানে তিনি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ খোঁজার জন্য সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি আরহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের, সেই সঙ্গে ভারতেরও। কারণ, ভারতের সমর্থন পাচ্ছেন বলেই ক্ষমতাসীনরা একতরফা নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন