২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার বছর দুয়েক পার হওয়ার পর একটা বিষয় সবার মুখে মুখে শোনা যায় এ সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। এ জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের
নানা ব্যর্থতাও বহুল আলোচনায় ওঠে আসে। এসবের মধ্যে আছে পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক দুর্নীতি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, প্রশাসনের দলীয়করণ, নেতাকর্মীদের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের
ওপর সীমাহীন দমন-পীড়ন ও দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এর পরও আছে বেগম
খালেজা জিয়াকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তার নাম বাদ দেয়া এবং ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
নাম থেকে জিয়ার নাম বাদ দিয়ে হজরত শাহজালালের নাম প্রতিস্থাপন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে নানামুখী পদক্ষেপ অনেক কিছুই সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে
নেয়নি। ফলে সরকারের জনপ্রিয়তায় সুস্পষ্টভাবে ধস নামতে থাকে। বিশেষ করে পাঁচটি বিভাগীয়
সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর
বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হওয়ার ফলে এটুকু নিশ্চিত হয়ে যায় দশম সংসদ নির্বাচনে মহাজোট
সরকারের জয়ী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিভিন্ন জরিপেও এ ধারণাই একের পর এক প্রকাশ পেতে
থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি আগে থেকেই আঁচ করতে পেরে, সমালোচকদের বর্ণনায় আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
অধীনে সাংবিধানিক নির্বাচনব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ
বহাল রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল নেন। কিন্তু সরকারবিরোধী ১৮ দলীয় জোটসহ
দেশের নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন
আয়োজনের পক্ষ নেয়। দেশের সুশীলসমাজও এ দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা তাতে রাজি না হয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় থাকেন। শেষ
পর্যন্ত ২৮টি দলের বর্জনের মুখে ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে ভোটারবিহীন গত ৫ জানুয়ারি সে
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত
হন। বাকি ১৪৭টির মধ্যে নামেমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন হয়। আটটি আসনে নির্বাচন
স্থগিত করতে হয়। ১৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী, বিদ্রোহী প্রার্থী ও জোটের দুই একটি দলের মধ্যে। এর মধ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়
সৃষ্ট বিএনএফ থেকেও অচেনা-অজানা একজনকে এমপি বানানো হয়েছে। কার্যত যা হয়েছে সিট ভাগাভাগির মাধ্যমে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে; যা ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে আওয়ামী লীগ দলের একটি কলঙ্কতিলক হিসেবে
অভিহিত হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। দেশের ভেতরে ও বাইরে এ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বিবেচিত
হচ্ছে ভোটারবিহীন, অগ্রহণযোগ্য ও গণতন্ত্রপরিপন্থী এক নির্বাচন হিসেবে।
সবচেয়ে
মজার ব্যাপার ছিল জাতীয় পার্টির এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে। প্রথমে নির্বাচনের আগে
একদলীয় নির্বাচন বলে সমালোচিত হওয়ার মুখে একটি বহুদলীয় সরকার গঠনের চেষ্টা চলে মহাজোটের
কয়েকজনকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্য দিয়ে। সে নির্বাচনকালীন সরকারে জাতীয় পার্টি যোগ
দিলেও নির্বাচনের আগে মাঝপথে এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ডাক দিলেন। দলীয় নেতাকর্মীদের
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন। ফলে দুই শতাধিক দলীয় প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার
করলেন। তবে দলের ুদ্র একটি অংশ তা না করে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা
দেন। অপর দিকে র্যাবের গাড়িতে করে এরশাদকে যেতে হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। এর
পরেও নানা নাটকীয়তার কথা আমাদের সবার জানা।
শেষ পর্যন্ত
ভারত ও ভুটান ছাড়া বাকি সব দেশের পর্যবেক্ষকহীন নির্বাচন হলো। নির্বাচন কমিশন জানাল, এ নির্বাচনে ৩৯ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। তবে বিভিন্ন মহলের দাবি, এতে ১০ থেকে ২০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। সে এক অন্য বিতর্ক। যা হোক, নির্বাচন শেষে শেখ হাসিনা এরই মধ্যে জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে নতুন সরকার গঠন করেছেন।
সরকার গঠনের আগে থেকেই মোটামুটি নির্বাচনের পরপর ১৮ দলীয় জোটের প্রতি জিরো টলারেন্স
দেখিয়ে চলছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন। বলা হচ্ছে, জনগণের জানমাল রক্ষা করতে সহিংসতা দমনে যত কিছু দরকার তার সবই করবে সরকার।
বিএনপির পক্ষ থেকে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নের অভিযোগ করা হলেও সরকার তা আমলে
নিচ্ছে না।
সরকারি
দল নির্বাচন-পরবর্তী সময় থেকে একটা কথা বেশ জোরেশোরে চালিয়ে যাচ্ছে ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ বিরোধী দলের সব বাধা
দূরে ঠেলে এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু একমাত্র সরকারপক্ষ ছাড়া দেশের ভেতরের ও বাইরের
কেউ বলছে না এ নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল। তার পরও সরকারি দলের নেতাকর্মী
ও সরকারসমর্থক বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, এ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন
করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে সক্ষম হয়েছে। এখানে আওয়ামী লীগ বিজয়ী আর বিএনপি পরাজিত।
এমনকি সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা বেগম জিয়ার প্রতি টিটকারি ছুড়ে দিয়ে বলছেন বেগম জিয়া দুই কূলই হারিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও হতে পারলেন না; এমনকি বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারলেন না।
কিন্তু
সুধীজনেরা বলেন, এ নির্বাচন বয়কট করায় বেগম জিয়ার সিদ্ধান্ত ছিল একটি প্র্যাগমেটিক
সিদ্ধান্ত। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রমাণ করেছে বেগম জিয়া সঠিক অবস্থান নিয়ে তিনি বিজয়ী।
আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা কূটকৌশলে ক্ষমতায় টিকে থেকে নিজেকে পরাজিতের আসনে
বসালেন। বেগম জিয়া যে এখানে বিজয়ী তার পেছনে নানা যুক্তিই তুলে ধরা যায়। প্রথমত, বেগম জিয়া বলেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়নি, সে কথা আজ সবাই বলছেন। বেগম জিয়া
জনগণকে নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্র প্রমাণ
করে জনগণ এ নির্বাচন বর্জন করেছেন। তা ছাড়া মহাজোটের বাইরের একটি দলও এ নির্বাচেন অংশ
নেয়নি। বিএনএফ সৃষ্টি করে বিএনপি ভাঙার আওয়ামী লীগ দলীয় চেষ্টাও সফল হয়নি। ভারত ও ভুটান
ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশ এ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে অসম্মতি জানিয়ে এ কথাই বলে
দিয়েছে বিরোধী দলবিহীন একতরফা এ নির্বাচন তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য, গুরুত্বহীন ও অর্থহীন। নির্বাচনের পরও কোনো দেশ এ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এমন
কথা বলেনি। এসব কিছুই প্রমাণ করে, একমাত্র সরকারি জোট ছাড়া বাকি সবারই অবস্থান বেগম
জিয়ার অনুকূলে। এখানেই বেগম জিয়ার বিজয়।
নির্বাচনোত্তর
এই সময়ে আমরা জানলাম, দশম সংসদের ২৯৭ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৩৩, জাপার ৩৪, স্বতন্ত্র ১৫ এমপি। এই বিপুল বিজয়ের পরও বিজয়ী এমপিদের মুখে তৃপ্তির
হাসি নেই। কারণ এরা নিজেরাও জানেন, এ নির্বাচন নিয়ম রক্ষার নির্বাচন।
আইনি বা সাংবিধানিকভাবে একে বৈধ বা অন্য যা-ই বলা হোক, এটি প্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন নয়। কারণ, এ নির্বাচন দেশের মালিক জনগণকে
ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এ নির্বাচনে দেশের ৫২ শতাংশ মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের
কোনো সুযোগই ছিল না। কারণ, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত
হয়েছেন; যেগুলোয় নির্বাচন হয়েছে সেখানেও চলেছে ব্যাপক জাল ভোট। অর্ধশতাধিক
প্রার্থী ভোট জালিয়াতির অভিযোগে ভোটের দিনের মধ্যভাগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
এত কিছুর
পরও এখন সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিরা বলছেন, জনগণ তাদের দেশ শাসনের ম্যান্ডেট
দিয়েছেন। তাই এ সরকার ক্ষমতায় থাকবে পুরো পাঁচ বছর। কিন্তু চার দিকে সবাই বলছেন, এ নির্বাচন নিয়ে প্রহসন যা চলার চলেছে, এবার সময় শোধরানোর। আর এর একমাত্র
উপায় হলো, সব দলের সাথে সমঝোতা করে সবার অংশগ্রহণে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য
নির্বাচন আয়োজন করে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে
তাদের পছন্দের একটি সরকার গঠন নিশ্চিত করা।
গত ১৭
জানুয়ারি ডেইলি স্টারে পত্রিকাটির সম্পাদক মাহফুজ আনামের একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত
হয়। তার এই প্রতিবেদনে এ কথাই জোর দিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন ১৯৪৯ সালে জন্মের পর থেকে আওয়ামী লীগ এর সব কর্মকাণ্ডে জনগণের ক্ষমতার ওপর
নির্ভর করেছে। অথচ সেই দলটি নিষ্ঠুর, নির্দয় এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী
সদ্য হয়ে যাওয়া নির্বাচন হইজ্যাক করেছে। এবং শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জনগণের ভোটের
অধিকার অস্বীকার করছে। এ নির্বাচনে তথাকথিত বিজয় ছিল পূর্বনির্ধারিত। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ
আসনে ৩০০টির মধ্যে ১৫৩ আসনে প্রার্থী জয়ী হওয়ার জন্য একটি ভোটেরও প্রয়োজন
হয়নি। এটা যদি পূর্বনির্ধারিতও না হয় তাহলে কী? এসব এ নির্বাচনকে পাতানো এবং
ফলাফলকে বল প্রয়োগের বিজয়ের খেতাব এনে দিয়েছে।... এ সরকারও গঠন হয়েছে ভোটারদের কোনো
ধরনের অংশগ্রহণ ছাড়া। আব্রাহাম লিঙ্কনের সংজ্ঞা যদি আমরা বিশ্বাস করি তবে গণতন্ত্র
হচ্ছে জনগণের সরকার জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। তা হলে ৫ জানুয়ারির
তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার জনগণের সরকার নয়। জনগণ দিয়ে গঠিতও নয়।... শেখ
হাসিনা যা-ই করুন না কেন, এ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্রকে শক্তিশালী
করেননি; যদিও তিনি সব সময় দাবি করে থাকেন গণতন্ত্রের জন্য তিনি সংগ্রাম
করছেন। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে তিনি এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করেছেন, সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী যে নির্বাচনে ১৪৭ আসনে ভোট পড়েছে ৩৯ শতাংশ যা গত নির্বাচনে ৩০০ আসনে পড়া ৮৭ শতাংশ ভোটের তুলনায় অনেক কম। এবারের নির্বাচনে
ভোট পড়ার যে হারের কথা বলা হয়েছে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ভোটের দিন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় যে চিত্র দেখা গেছে, তার ভোটের হার কিছুতেই ১৫ থেকে ২০ শতাংশের বেশি হতে পারে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের
সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জনগণের বিশ্বাস ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
একই লেখায়
মাহফুজ আনাম আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেনÑ ‘এখন আমরা একটি মৌলিক সাংবিধানিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছি। ৫ জানুয়ারির
নির্বাচন কি এক ব্যক্তিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়নি? এ প্রশ্ন তুলে তিনি তার লেখায়
বলেছেন Ñ সমালোচক হিসেবে নয়, বরং গণতন্ত্রের বন্ধু হিসেবে
আমরা প্রধানমন্ত্রীকে তার হাতে থাকা অসীম ক্ষমতার ব্যাপারে সতর্ক করছি। লর্ড অ্যাকটিন
এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন, ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয়। এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা
নিরঙ্কুশ দুর্নীতির জন্ম দেয়। আধুনিক রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও বিচার বিভাগ। আজকের দিনে শেখ হাসিনা প্রশ্নাতীতভাবে কার্যকর দু’টি স্তম্ভ নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণ রীতি অনুযায়ীই আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী
নির্বাহী বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আইন প্রণয়নকারী বিভাগ সংসদের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর
ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যদিও সর্বশেষ নির্বাচনের পরও নতুন অগ্রগতিও হয়েছে। এমনকি বিরোধী
দলও প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিরোধী দলের একটি অংশ মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছে।
আরেকটি অংশ রয়েছে বিরোধী দলে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে।
আমরা সবাই জানি, কিভাবে বিরোধীদলীয় নেতা তৈরি করা হয়েছে। এবং তথাকথিত বিরোধী দল
কিভাবে মন্ত্রিসভায় আরো স্থান পাওয়ার জন্য দরকষাকষি করছে। এ পরিস্থিতিতে সংসদের ওপরও
প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বাকি থাকে বিচার বিভাগ। ঐতিহ্যগতভাবেই বিচারক
নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে থাকে। উচ্চ
আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায়, বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের
প্রভাবের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। আমরা এখন এমন একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে
আছি যেখানে সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ক্ষেত্রে কোনো
ধরনের ভারসাম্য নেই।’
আসলে বাস্তবতার
প্রেক্ষাপটেই মাহফুজ আনামের মতো আরো অনেকেই এসব প্রশ্ন তুলছেন। কারণ শুধু প্রধানমন্ত্রী
নন, বরং তার আশপাশে যারা আছেন তারাও আজ ধরাকে সরাজ্ঞান করছেন। এরা
জনসংশ্লিষ্টহীন ভোটারবিহীন একটি নির্বাচন করে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার কথা ঘোষণা করছেন।
কেউ কেউ দাঁত বের করে ঠাট্টার হাসি হেসে ২০২১ সাল এমনকি ২০৪১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার
কথাও উচ্চারণ করছেন। ‘সপ্তম নৌবহরের দিন শেষ’ বলে এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিচ্ছেন
কেউ কেউ। আবার যুক্তরাষ্ট্রদূতকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার হুমকিও দিচ্ছেন। জানি না, কার ভরসায় দেশের কোন স্বার্থে এ ধরনের অযৌক্তিক কথাবার্তা। এ ধরনের আসফালন
না দেখিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অহেতুক শত্রু বানানোর কোনো অর্থ আছে বলে মনে করি না; বরং আমাদের উচিত দেশের মানুষকে জাতীয় উন্নয়নে সর্বাধিক সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে
দেশকে এমন এক সমৃদ্ধতর পর্যায়ে নিয়ে পৌঁছানো, যখন আমাদের সমৃদ্ধির কারণে অন্যরা
আমাদের সমীহ করবে। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন দেশে জনগণের একটি সরকার। আজকে বাংলাদেশের
এগিয়ে যাওয়ার যে টুকু অর্জন তার বেশির ভাগই ঘটেছে ১৯৯০-উত্তর সময়ে। কারণ এই সময়ে আমরা
যে কয়টি সরকার পেয়েছি, সেগুলো ছিল জনগণের নির্বাচিত সরকার। কোনো দলীয় সরকারের
অধীনে এই সময়টায় কোনো নির্বাচন হয়নি বলে কোনো সরকারই জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতায়
টিকে থাকতে পারেনি। ১৯৯০-উত্তর সময়ে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আমরা এই প্রথম দেখলাম
ভোটারবিহীনতা, প্রতিদ্বন্দ্বিহীনতা জনসংশ্লিষ্টতার এক অদ্ভুত পাতানো নির্বাচন।
এর প্রভাবে এরই মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভাটা পড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
অত্যন্ত
যৌক্তিক কারণেই ভোটারবিহীন ও জনবিরোধী নির্বাচনের অভিশাপ থেকে বাঁচার জন্য দ্রুত বের
হয়ে আসার জন্য ঘরে-বাইরে যখন চাপ দেখা হচ্ছে, তখন সরকার এসব আমলে না নিয়ে এখন
ব্যস্ত স্থানীয় উপজেলা নির্বাচন নিয়ে। এ নির্বাচন সুষ্ঠু কতটুকু হবে তা নিয়ে সন্দেহ
প্রকাশের যথেষ্ট কারণ আছে। সে যাই হোক, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা
পায়নি দেশে-বিদেশে। তাই দ্রুত সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচনের দাবি এখনো জোরালো।
এমনকি আন্তর্জাতিক মহল বলছে, আগামী জুনের আগেই সে নির্বাচন হোক। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের
হাউজ অব কমনসে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ পাঁচ দফা প্রস্তাব
গৃহীত হয়েছে। গত ১৭ জানুয়ারি পেশ করা প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আছেÑ ০১. বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা; ০২. রাজবন্দীদের মুক্তি; ০৩. জরুরি ভিত্তিতে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন; ০৪.সহিংসতা বন্ধ এবং ০৫. র্যাবের বিলুপ্তি ঘোষণা। অপর দিকে বাংলাদেশে সম্প্রতি
অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ইইউর এক বিবৃতিতে বলা হয়, সহিংসতার কারণে প্রতিদিন বাংলাদেশের জনজীবন অচল
হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলের নেতাদের সরকার খেয়ালখুশিমতো গ্রেফতার করছে, এসব নেতাকে মুক্তি দেয়া উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের
সংস্কৃতি থাকা উচিত। একই সাথে যেসব রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায় তাদের নিষিদ্ধ
করা উচিত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে সমঝোতার জন্য সম্ভাব্য সহায়তা করার
গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ইইউকে এমন একটি সমঝোতা প্রক্রিয়ায় সহায়তার সব চেষ্টা
করতে হবে, যাতে বাংলাদেশের নাগরিকেরা জনপ্রতিনিধি বেছে নেয়ার গণতান্ত্রিক
অধিকার পান।
অপর দিকে
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র
করে বাংলাদেশে
মার্কিন সহায়তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে এবং এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয়
নির্ধারণে
মার্কিন আইনপ্রণেতারা এরই মধ্যে নিজেদের মধ্যে একান্ত আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। বাংলাদেশের
গণতান্ত্রিক ধারায়
ফিরে না
আসা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শীতল (টেম্পার)
রাখা উচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা সরকারের সাথে কাজ চালিয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের
জন্য খুবই কঠিন। বাংলাদেশে যেখানে গণতন্ত্র নেই, এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র
চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্র স্বাভাবিক কার্যকর
আছে এমনভাব ধরে চুপ করে থাকতে পারে না বলে এসব মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত
থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’। এ ছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা করে শেখ হাসিনা সরকারকে শর্তহীন সমর্থন
দেয়ার ভারতীয় নীতিকে দেশটির ‘অদূরদর্শী’ সিদ্ধান্ত ‘সঙ্কীর্ণ’ নীতি বলে মনে করছে হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশন আরো মনে করে ‘শেখ হাসিনা সরকারকে শর্তহীন সমর্থন দেয়ার ভারতীয় অদূরদর্শী নীতি উল্টো ভারতের
জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিতে পারে, কেননা হাসিনা সরকারের ক্রমবর্ধমান একনায়কতান্ত্রিক
শাসনের ফলে বাংলাদেশ আরো বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে, যা ভারতের স্বার্থের অনুকূলে
নয়।’
এ ছাড়া
১৪ জানুয়ারি অ্যালায়েন্স অব লিবারেলস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটস ফর ইউরোপ (এএলডিই) গ্রুপের
১২ জন সদস্য নির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশে যথা শিগগির সম্ভব নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন ক্রান্তিকালীন
সরকার গঠন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব আলোচনার জন্য ইাউরোপীয় পার্লামেন্টে উত্থাপন
করেন। তা না করলে ইউরোপে বাংলাদেশের বাণিজ্যসুবিধা পর্যালোচনার ইঙ্গিতও এ প্রস্তাবে
ছিল। তবে ওই প্রস্তাব পার্লামেন্টে হুবহু গৃহীত হয়নি। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এই প্রস্তাব
ওঠা বাংলাদেশের জন্য অমর্যাদাকর ও অসম্মানজনক। ওই প্রস্তাব
হুবহু
গৃহীত না হলেও পার্লামেন্ট যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে খুবই গুরুত্বের সাথে নিতে
হবে। তিনি
বলেন, শুধু ইউরোপীয় পার্লামেণ্ট এককভাবে এ প্রস্তাব করেনি, এর আগে
মার্কিন
কংগ্রেস ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের
হাউজ অব
কমন্স থেকে মোটামুটি একই মত এসেছে।
সব কিছু
বিবেচনায় নিলে বলতেই হয়, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনোত্তর সময়টা আমাদের
জন্য খুব ভালো যাচ্ছে না। এ সময়কে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আমরা যদি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে
না পারি, তবে ঘরে-বাইরে আমরা বড় ধরনের সঙ্কটের মুখোমুখি হতে পারি। তবে সঙ্কট
থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ একটিই দ্রুত সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য একটি আগাম নির্বাচন
আয়োজনÑ যেখানে জনগণ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পাবেন; তাদের পছন্দের প্রতিনিধি ও সরকার গঠনের সুযোগ পাবেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন