বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৪

সরকারের গন্তব্য ও শ্রীনিবাসনের প্রেসক্রিপশন


বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিশ্বব্যাপী একটি আলোচিত ইস্যু। এ নির্বাচনে প্রত্যক্ষদর্শী পর্যবেক্ষকদের মতে, ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে গিয়ে থাকতে পারেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত দেখা যায়। ভারতীয় শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতেও নির্বাচনে ভোট দেয়ার হার এরচেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয়নি। এই নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন এক নির্বাচন যেখানে ১৫৩টি আসনে ভোট ছাড়াই সরকার সমর্থকেরা জয়ী হওয়ার রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে। এই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার এবং সিনিয়র মন্ত্রীরাও রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে স্পষ্টত দুটি শিবির দেখা যায়। যার একটিতে ছিল বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত আর বাকি সব দেশ ছিল অন্য পক্ষে। প্রথম পক্ষ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতায় আসতে পারবে এমন একটি নির্বাচন চেয়েছিল। এ লক্ষ্যে বিদ্যমান সরকারের অধীনে নির্বাচনকে তারা সর্বান্তকরণে সমর্থন করে। দ্বিতীয় পক্ষ মনে করে বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলে সেটি এ দেশকে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার পথে রাখতে পারবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রতিবেশী দেশটির তার অবস্থানের পক্ষে বাংলাদেশে প্রকাশ্য তৎপরতা চালানোর বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের আকম্মিক বাংলাদেশ সফরে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের সাথে বৈঠকের পর সাবেক এই প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। সে সময় ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ অন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথেও কথা বলেছিলেন।
এ সময় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে মেনে নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ে সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশ্বাস দেন তিনি। সেই আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় অংশ আন্দোলনের কার্যসূচি বাস্তবায়ন থেকে কার্যত নিজেদের সরিয়ে রাখেন। এতে ২৯ ডিসেম্বরের রোড টু ডেমোক্র্যাসি সাফল্য পায়নি। তবে জনগণের অনাগ্রহ ও প্রতিরোধের মুখে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটারের অংশ গ্রহণে। এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ফলে এটি সংবিধানে জনগণের সম্মতিতে সরকার গঠনের শর্ত পূরণ করে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এ নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মন্তব্যকে অবশ্য আমলেই নেয়নি সরকার। এমনকি আগের সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় আরেকটি সংসদের সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান এবং সে সংসদের ভিত্তিতে সরকার গঠন বৈধ কি না, এর কোনোটার ব্যাপারেই সাংবিধানিক প্রশ্নগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সরকার গঠন করা হয়।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরপরই সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য পাল্টে যায়। সিনিয়র মন্ত্রী আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, সৈয়দ আশরাফসহ একাধিক ব্যক্তি বর্তমান সরকার আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে বলে মন্তব্য করেন। সরকার গঠনের পর কূটনীতিকদের আনুষ্ঠানিক এক সভায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা আগামী মে-জুনের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এটিকে উচ্চাভিলাষী চাওয়া বলে উল্লেখ করে মেয়াদপূর্তি বা মধ্যবর্তী সময়ে নির্বাচনের বিষয় ভাবতে বলেন। সরকারি দলের সিনিয়র নেতা মুহাম্মদ নাসিম আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, বিএনপিকে রাজনীতি করতে হলে আর কোনো ভুলকরবে না বলে দাসখত দিতে হবে।
বাংলাদেশে সরকারের কর্মকৌশল কী হবে, এ ব্যাপারে গত পাঁচ বছর ধরে এখানকার সরকারি নীতিনির্ধারকদের চেয়ে ভারতের কিছু সাবেক নীতিনির্ধারকের বক্তব্যে আভাস অনেক বেশি সুস্পষ্টরূপে পাওয়া যায়। যাদের লেখায় এ ধরনের আভাস বেশি স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় তাদের একজন হলেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন। তিনি বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই ভারতীয় হাইকমিশনার বা রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটিশ অক্সফোর্ডে অধ্যয়নকারী এই ভারতীয় কূটনীতিক তার পেশাজীবনের শেষ পর্যায়ে কমনওয়েলথের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কয়েকদিন আগে তিনি ভারতীয় টেলিগ্রাফ পত্রিকায় অন দি রাইট সাইড অব দি হিস্টরিনামে একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবেদন লিখেন। তার এ লেখাটি একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়া ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পরামর্শের সাথে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। শ্রীনিবাসন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ২০ শতাংশ ভোটার অংশ নিয়েছে বলে উল্লেখ করে বলেছেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ২৫ শতাংশের বেশি ভোটার অংশ নেয় না; কিন্তু তিনি এটি বলেননি যে ইইউ গঠন হওয়ার পর থেকে এটি হলো ইইউ সংসদের ভোট দেয়ার সাধারণ অনুপাত। অথচ বাংলাদেশে এর আগের বারে (২০০৮) সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ৮৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিল। আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও এর কাছাকাছি হারে ভোট পড়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো ৫ শতাংশের পরিবর্তে শ্রীনিবাসনের দাবি অনুসারে ২০ শতাংশ ভোটারেরও যদি ভোট দেয়া হয়ে থাকে সেটি কিভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে।
লেখাটিতে শ্রীনিবাসন শেখ হাসিনার যুক্তি সমর্থন করে বলেন, পৃথিবীর কোনো গণতন্ত্রেই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় না। বেগম জিয়ার এ ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি যৌক্তিক ছিল না। কিন্তু তিনি এটি ভুলে যেতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা নিজে। গত চার বছরের আন্দোলনে বেগম জিয়া যেসব কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বলেছেন ঠিক এ কথাই শোনা গিয়েছিল ২০০৬ সালের পূর্ববর্তী সময়ে শেখ হাসিনার মুখে।
সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ব্যাপারে শেখ হাসিনার সাথে সুর মিলিয়েছেন শ্রীনিবাসন। তিনি বলেছেন, সেই নিক্সন-কিসিঞ্জারের আমল থেকেই আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণে তারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন না করার মহাভুল করেছিল। এখন তারা নোবেল জয়ী ড. ইউনূসের মর্যাদার ব্যাপারে শেখ হাসিনার দ্বিমতে এবং মুক্তিযুদ্ধের অপরাধীদের বিচার ইস্যুতে একই ধরনের বৈরিতা দেখাচ্ছেন। কিন্তু কি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অস্বীকার করবে যে উগ্র ইসলামিস্ট হিসেবে পরিচিত জামায়াত হলো বিএনপির প্রধান সহযোগী। গণতন্ত্রের নীতি ও চেতনাকে উচ্চকিত করার চেয়েও পাকিস্তানপন্থীদের বিচারের হাত থেকে বাঁচানোই হলো তাদের প্রধান এজেন্ডা।
 
লক্ষ্য করার বিষয় হলো, জামায়াতের ব্যাপারে জুজুর ভয় দেখানোর কৌশলটি প্রতিবেশীদের বেশ পুরনো। গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে তাদের ব্যাপারে এই প্রচারণাই চালানো হয়েছে দলটি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠছে যে অচিরেই তারা ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াত ও ইসলামিস্টদের সমর্থক বলে উল্লেখ করেছিলেন। অথচ জামায়াত নিকট অতীতের নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করেনি। দলটি এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্তির রেকর্ড ১১ শতাংশের কোঠায়। দলটি বাংলাদেশে সক্রিয় হওয়ার পর থেকে সব কটি নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে একাধিক সময়ে আওয়ামী লীগ জামায়াত যুগপৎ আন্দোলন করেছে। আসলে জামায়াতের যুক্তি দেখিয়ে ১৯৭৫ সালের পরবর্তী যে রাজনীতি বাংলাদেশে প্রধান হয়ে উঠেছিল সেটির নির্মূল কামনা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কর্মসূচি নেয়ার জন্য পরামর্শও দেয়া হচ্ছে।
শ্রীনিবাসন তার লেখার শেষ পর্যায়ে একতরফা নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ভারত ইতিহাসের সঠিক প্রান্তেই থাকবে। এখন শেখ হাসিনার উচিত হবে খালেদা জিয়ার সাথে অর্থহীন সমঝোতার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তার সরকার ও ক্ষমতাকে সুসংহত করা। যারা সহিংসতার সাথে যুক্ত ছিল তাদের গ্রেফতার ও দমন করা। ১৯৭১ সালের রাজাকারদের দণ্ড কার্যকর করা। আর সেই সাথে উন্নয়ন কর্মসূচির প্রতি নজর দেয়া।
 
শ্রীনিবাসন উল্লেখ করেছেন, খালেদা জিয়ার নির্বাচন বয়কট অথবা তাকে সুযোগ দিতে আশু অরেকটি নির্বাচনের দাবির বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মতো আধাসামরিক বাহিনী এর মধ্যে অনেক কিছু করেছে, তাদের সমর্থন অব্যাহত থাকলে শেখ হাসিনার পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। বেগম জিয়া এবং জামায়াতের সহিংসতাকেন্দ্রিক অসহযোগ আন্দোলনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিএনপিকে সামনে ভাঙনের মুখে পড়তে হবে। দলটির অনেক নেতাই জনমত জরিপে জেতার সম্ভাবনা থাকার পরও নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিল না। আন্তর্জাতিক চাপও বেশি কিছু করতে পারবে না।
ক্ষমতাকে সংহত করতে কি কি করতে হবে এ ব্যাপারে শ্রীনিবাসনের বক্তব্যে বিস্তারিত কিছু বলা নেই। তবে নির্বাচনোত্তর সময়ে সারা দেশে যৌথবাহিনীর মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ক্রসফায়ারের নামে যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে তার সাথে সরকারকে সংহত করার কর্মসূচির সম্পর্ক থাকতে পারে। শ্রীনিবাসন তার লেখায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত সমর্থনের কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে আগামী দিনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে আওয়ামী লীগ সমর্থক পরিবারগুলো থেকে কর্মকর্র্তা ও জওয়ান পর্যায়ে ৭৩ হাজার সদস্য নিয়োগ করার একটি পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব বাহিনীকে এমনভাবে বিন্যাস করতে হবে যাতে তাদের সর্বোচ্চ  সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে; কিন্তু সরকারের ইচ্ছার বাইরে কিছু করার ক্ষমতা তাদের থাকবে না। সব কিছুর মূল লক্ষ্য হবে ১৯৭৫ পরবর্তী ধারার রাজনীতির সুযোগ না থাকার স্থায়ী ব্যবস্থা করা। নির্বাচনের আগে মতলববাজ মানবাধিকার নেত্রী হিসেবে বিতর্কিত সুলতানা কামাল বলেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবহির্ভূত কোনো দলের রাজনীতি করতে দেয়া উচিত নয়। সরকারি দলের নেতারা মহাজোটের বাইরের সব দলকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরের দল হিসেবে চিহ্নিহ্নত করে থাকে। সুলতানা কামালের দাবি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে আবার ৭৫ পূর্ববর্তী সময় ফিরে আসতে কোনো বাধা হয়ত আর থাকবে না। এ দেশ স্থায়ীভাবে পরিচালিত হবে সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ইচ্ছায়। 


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads