ষোল কোটি জনগণের দেশ বাংলাদেশ। জনসংখ্যার আধিক্যে ক্ষুদ্রায়তন এ ভূ-খ-ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো তেমন কিছু নেই। বলা যায়, স্বাধীনতাপরবর্তী এদেশের উন্নয়ন যথেষ্ট হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। কারণ, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব একটি দেশের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের একটি অপরিহার্য শর্তকেই মৌলিক প্রেরণা জোগায় বলে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় সার্বভৌমত্বের ভিত্তি বলে মনে করে। সমাজ, দেশ, সংস্কৃতি বলে যে, সামাজিক আচার-আচরণ এবং নিত্যনৈমিত্তিক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের যে শর্তাবলীগুলো রাষ্ট্রের দায়িত্বের অংশ হিসেবে পরিগণিত তা যদি কোন ভঙ্গুর সামাজিক অবকাঠামোর অর্থনৈতিক ঘূণে ধরা আওতাধীন প্রশাসনিক ব্যবস্থা বজায় থাকে, তবে তাতে সুশাসন এবং সামাজিক শৃঙ্খলার কোন প্রশাসনিক মজবুত ব্যবস্থা কায়েম থাকতে পারে না। বোধকরি তা রাষ্ট্র পরিচালকদের কারো অজানা নয়। সে দিক থেকে জনপ্রশান্তি এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মৌলিকভাবে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের দিকটিই মুখ্য বলে বিবেচিত। নতুবা উন্নয়ন এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ও সুখ-শান্তির সমাজ ব্যবস্থা কখনো কামনা করা যায় না। যেহেতু বাংলাদেশ জনভারে জর্জরিত সেহেতু তার সমস্যা এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও ব্যাপক। তাই এখানকার জনগণের সুখ-দুঃখের ভাগাভাগিতে বিত্তবানদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হয় একথা বলাই বাহুল্য। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এদেশটিতে সম্পদের কোন ঘাটতি নেই। যা আছে তা সৎ প্রশাসন এবং আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির অভাব।
বর্তমান ডিজিটাল যুগের চাহিদা মেটাতে যে পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার অপ্রতুলতায় কাক্সিক্ষতমানের তেমন কোন উন্নয়ন আমরা ঘটাতে পারছি না। এটাও একটা সংকট এবং বাধা। এতোসব বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মজবুত উন্নয়ন ঘটাতে হলে প্রথমেই দরকার একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার। যার দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার অনুভূতি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় আন্তরিকভাবে আত্মনিয়োগ করা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং স্বার্থহাসিলের দৃষ্টিভঙ্গিকে চিরতরে নির্বাসিত করতে না পারলে কোন সরকারের পক্ষেই আধুনিক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উপহার দেয়া সম্ভবপর নয় বলেই সবার ধারণা এবং এটাই বাস্তব। এর বাইরে গিয়ে যে সরকারই প্রতিষ্ঠিত থাকবে সেটা ফ্যাসিবাদী গভ:মেন্ট এর রূপ পরিগ্রহ করে। যার সাথে মিশ্রণ ঘটে বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদীদের চিন্তা-চেতনা এবং অনাদর্শিক নিপীড়ন। প্রকারান্তরে যাদের যুপকাষ্ঠে বলি হতে থাকে সাধারণ জনগণ। আর সেই সমাজেই তখন সুখ-শান্তি তিরোহিত হয় চিরতরে। পাশাপাশি জুলুমের বিস্তার ঘটে ব্যাপকভাবে। যাকে আমরা স্বৈরতন্ত্র বা জুলুমতন্ত্রের সরকার বলেই আখ্যায়িত করতে পারি।
এ ব্যাপারে বিগত শতাব্দীর রাজনীতির ইতিহাস যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তবে একথাগুলো অবশ্যই আমরা বুঝতে পারব যে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দেশে দেশে কি পরিমাণ গজব নাযিল হয়। আমরা যদি মধ্য এশিয়ার বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক হালচাল পর্যবেক্ষণ করি তাতে ভুরি ভুরি নজির পেশ করা যাবে যে, একেকটি দেশের কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ এবং বিপর্যয়কর অবস্থা ঘটেছিল। মধ্য এশিয়ার চেঙ্গিস-হালাকু খানদের বীভৎস রাজনৈতিক ধ্বংসকা- কে না জানে। একটি দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সমুদ্রের অতলগর্ভে নিক্ষিপ্ত করেছিল ভয়ঙ্কর রূপে। ইতিহাস সাক্ষী নীলনদের পানি কালো রূপ ধারণ করেছিল জ্ঞানীগুণীদের লেখনী কালির বই পুস্তকের ডুবিয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। এ সমস্ত ইতিহাস জ্বল জ্বল করছে এবং এখনও বেদনার সমুদ্রে হতাশায় হাবুডুব খাচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তারপর জার শাসিত রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলগুলোর করুণ আর্তনাদ এবং পরবর্তীতে গোটা রাশিয়ার লেনিন এবং স্ট্যালিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা পরিচালিত কমিউনিজম শাসনের সময় আড়াই থেকে পাঁচ লাখ মানুষের নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে প্রায় সিকি শতাব্দীর কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গোটা জাতিকে দিয়েছিল বিভীষিকাময় অন্ধকার এবং দুঃসহ যন্ত্রণাময় জীবন। প্রশাসনের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ে টুঁ-শব্দ করাই ছিল নির্ঘাত মৃত্যুদ-। আমাদের নিকট অতীতেও যদি ঔপনিবেশিক আমলের কথাই ধরি, তবে তাতেও লিখা আছে হাজারো অশ্রুঝরা দুঃখ-যন্ত্রণার প্রশাসনিক ইতিহাস। আমাদের এ উপমহাদেশেও কতো রচিত হয়ে গেলো সাম্রাজ্যবাদীদের নখর থাবায় রক্তাক্ত ইতিহাস। মানুষ আজো ভোলেনি রক্ত পিপাসুদের স্বার্থ হাসিলের নিকৃষ্ট শাসনের। অতএব যে কোন দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা এবং জনগণের মতামতের মূল্যায়ন করা। কেননা, সমাজে মানুষের সুখ-দুঃখ এবং সুবিধা-অসুবিধার কথা মাথায় রেখেই জনকল্যাণের ছক আঁকতে হবে প্রশাসক নেতৃবৃন্দের এবং এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিটি ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা আবর্তিত হতে হবে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ভূমিকায় এবং কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশ গঠনের পরিকল্পনা। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতা তখনই সৃষ্টি হবে যদি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার গঠনের বিধিব্যবস্থা কার্যকর থাকে। আর যদি কোন একপেশে মনোভাবের শুধু ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যেই সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে যেনতেনভাবে পরিচালনার মাধ্যমে নির্বাচন এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েম হয় তবে তাতে অবশ্যই স্বার্থ হাসিল এবং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবকে দৃঢ়তর করে। এ সমস্ত সরকার গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনকল্যাণের বিষয়টি আর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মৌলিক কাজ বলে গণ্য হয় না।
বর্তমানে আমাদের দেশের অবস্থাটাও অনেকটা সেরকম সরকার গঠনের প্রক্রিয়া গোটা দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। প্রার্থীবিহীন, ভোটারবিহীন এবং বুথ সেন্টারগুলোতে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই ভোটগ্রহণ (প্রহসনের নির্বাচন) শেষ হয়ে সরকার গঠন প্রক্রিয়াও প্রায় সমাপ্ত। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কোন পর্যবেক্ষক ছাড়াই নির্বাচনপরবর্তী সরকার দম্ভভরেই বলেছিলেন সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। এমন ঘোষণায় সম্ভবত তাদের বিবেকবোধও লজ্জায় অধোবোদন হয়েছে! তবুও তাদের দাবি যথেষ্ট ভোট পড়েছে। এমনকি শেখ হাসিনা পর্যন্ত বললেন, উন্নত দেশগুলোতে এতো ভোট পড়ে না। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে চাপা ফোটালেন। যাক, বিশ্ব মিডিয়ার বদৌলতে সবাই প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশের দশম সংসদের প্রহসনের নির্বাচন! জনগণের মতামতকে পদদলিত করে ফ্যাসিবাদী আচরণের মধ্যদিয়ে যে সরকার গঠিত হলো, সেটাকে আর যাই বলা হোক, গণতান্ত্রিক সরকার বলা যায় না। সুতরাং দেশ জাতির কথা চিন্তা করে সমৃদ্ধ দেশ গঠনের লক্ষ্যে যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে অবাধ-নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ কায়েমের কোন বিকল্প নেই। আশা করি, সরকারের শুভবুদ্ধির উদয়ের মাধ্যমে জন আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবেন। বর্তমানে জনগণের এটিই একমাত্র চাওয়া-পাওয়া। আর যদি সে পথে না গিয়ে সরকার অন্য কোন টালবাহানার পথ বেছে নেয়, তবে জাতি ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তবে জনগণ যদি আবারো সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতার মসনদে বসায় তবে কারো কোন মন্তব্য করার অবকাশ থাকবে না। কারণ, জনগণের মতামত নিয়েই সরকারের ক্ষমতায় আসা উচিত। বর্তমান দুনিয়ায় যে ধরনের গণতান্ত্রিক ফর্মুলা বিদ্যমান আছে, ন্যূনতম পক্ষে সে ব্যবস্থাটাই কায়েম হোক, আজকের জনগণ সে প্রত্যাশাই করে। আর এ ব্যবস্থাটুকুও যদি নির্বাসিত হয় তবে এ দেশ আর গণতন্ত্রের পক্ষে থাকবে না, তখন তা হয়ে যাবে এক ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়া আর ক্ষমতা লিপ্সার কাছে বন্দী এবং সেটা হবে আরেকটি ‘রাজতান্ত্রিক ফর্মুলার নয়া সংস্করণ’। তাই আসুন, দেশকে বাঁচাতে আমরা গণতন্ত্রের পথে শান্তি শৃঙ্খলাভাবে নতুন বাংলাদেশকে গড়তে বিপ্লবের পথে এগিয়ে চলি এবং সেই প্রত্যাশায় ভবিষ্যতের পথ রচনা করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন