প্রাচীন রোমানগণ একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সত্যকথা বলে গিয়েছেন যে, ‘অস্ত্রের বা সন্ত্রাসের ঝঞ্ঝনার মধ্যে ন্যায়শাস্ত্র নীরব থাকে।’ রাষ্ট্র বিপ্লবে, এমন কি দীর্ঘকালব্যাপী নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতের মধ্যে শুধু আইন বা ন্যায়শাস্ত্রই নয়, জীবনের সকল ক্ষেত্রই অবদমিত ও আক্রান্ত হয়ে মানবিক জীবনের স্বাভাবিক চর্চাই অসম্ভব হয়ে যায়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নীতি-নৈতিকতা পর্যুদস্ত হয়ে সভ্যতায় ক্ষয়রোগ সংক্রামিত হতে থাকে। মানবজীবন ও সমাজজীবনের জন্য আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এহেন চরম অবক্ষয় ও বিকৃতি নিয়ে আসে অন্ধকারের হাতছানি। বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তাকে ইতিহাসের সেইসব বীভৎস অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায়। যখন জীবন-যাপন পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে যায়। চারদিকে বিরাজ করে কবরের নৈঃশব্দ। বসবাসকারী মানুষেরা হয়ে যায় পরবাসীর মতো আক্রান্ত। বাংলাদেশের চলমান অবস্থার বাস্তব চিত্র উপস্থাপন করতে বলা হলে এর চেয়ে আর কি-ই বা বলা যেতে পারে! সর্বাংশে একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পেছনে সরকারের সর্বশক্তি আর জনপ্রতিরোধÑ এই হচ্ছে মাঠের মেরুকরণ। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি ১০ম জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এমনই সঙ্কুল অবস্থার সম্মুখীন। এই নির্বাচনের নামে গণতন্ত্রের যে হাল-অবস্থা করা হয়েছে, সেটা কালো না লাল কালিতে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে, তা বলার এখতিয়ার ইতিহাসের। পরিস্থিতিকে জর্জ ওরওয়েলের ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ উপন্যাসের চরমতর নিবর্তনমূলক অবস্থার সঙ্গে কিংবা রামচন্দ্র গুহের ‘পেট্রিয়টস অ্যান্ড পার্টিজানস’ গ্রন্থে কথিত ‘রূঢ়মনা সংস্কৃতিবিহীন ডিক্টেটর’-এর দুঃশাসনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেখানে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারের জন্য একজন নয়, শত নূর হোসেন রক্তাক্ত উপস্থিতিতে রাজপথে অবিচল।
অপর দিকে, মনে হচ্ছে, টিভি নাটকের মেগা-সিরিয়ালের শেষ পর্ব বা এপিসোডে পরিচালক যেভাবে চরম রোমাঞ্চ, রহস্য ও চমক লুকিয়ে রাখেন, তেমনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক রণাঙ্গনে চলছে প্রবল উত্তেজনাকর শেষ এপিসোড। সরকারি ও বিরোধী দল সর্বশক্তিতে মাঠে হাজির। নির্বাক-দর্শকরূপে চেয়ে চেয়ে দেখতে ও হিংসার প্রতিফল ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছে অবরুদ্ধ-জনসাধারণ। ঘর ছাড়া রাজনৈতিক নেতা-কর্মীগণ। অধিকাংশই কারাগারের অন্ধ-প্রকোষ্ঠে। অবরুদ্ধ প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীও। তাকে হয়তো আটকও করা হতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘সরকার মানুষের রক্তের ওপর দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাইছে।’ বিদেশী মিডিয়ায় বাংলাদেশকে ‘গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে’ বা ‘কারাগার-সদৃশ্য’ বলে যে মন্তব্য করা হয়েছিল, তা এখন শতভাগ বাস্তব। বাংলাদেশের একজনও মানুষ এ পরিস্থিতিতে মুক্ত আছেন কি-না সন্দেহ। কারও চলাচল, যাতায়াত ও গতিবিধির স্বাধীনতা নেই। নাগরিক সমাজ ও শহর-নগরের ওপর চলছে প্রথমত বিরোধী দলের আর এখন সরকার আরোপিত অবরোধ। এমন বিভীষিকার মধ্যে সরকার ৫ জানুয়ারি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবেই। অন্যদিকে বিরোধী দল নির্বাচন মানবেই না। ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ করতে না দেওয়ায় বিরোধীদের আন্দোলন আবার লাগাতারভাবে অবরোধ-হরতালরূপে গ্রামে-গঞ্জে-দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেল। আন্দোলনের মাঠে বাড়ছে আহত-নিহত-আটকের সংখ্যা। পুলিশের সঙ্গে সরকারি লোকজনের সশস্ত্র সংযুক্তিতে পরিস্থিতি আরও সংঘাত-সন্ত্রাসময়। ব্যক্তিগত ও দলীয় স্তর ছেড়ে আক্রমণ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ আর প্রেস ক্লাবের ভিতরেও পৌঁছে গেছে। নৈরাজ্যের তীব্রতম মাত্রার মধ্যে গণতন্ত্রের নয়, চলছে শক্তির মহড়া। কে বেশি শক্তি দেখাচ্ছে? সরকার? নাকি বিরোধী দল? তারচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, কে জিতবে শক্তির এই লড়াইয়ে? নাকি আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক কর্তৃক উচ্চারিত ‘দেশ হারবে দল জিতবে’ বক্তব্যই সঠিক বলে প্রমাণিত হবে? রাজনীতির মাঠে বা নির্বাচনে জয়ের আগেই দেখা যাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন আর সন্দেহ। যে ১০ম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বেই এতো আপত্তি, যেখানে দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ ভোটই দেয়নি, তেমন নির্বাচন হয়ে গেলেও তা কতক্ষণ টিকতে পারবে, বলা শক্ত। সামনের দিনগুলোতে ‘কি হবে’, ‘কি হতে পারে’, এমন বহু প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির শেষ এপিসোডে। আসলেই শেষ এপিসোডে রাজনৈতিক লড়াইটি শক্তি ও ক্ষমতার তীব্র, ভয়াবহ ও সর্বাত্মক লড়াই হয়ে উঠেছে। কে জিতবে জানা না গেলেও, যে জিতবে তাকে ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু রাজনৈতিক বিজয়ের জন্য আর্থ-সামাজিক-জৈবিক কতটুকু মূল্য দেওয়া সঙ্গত? যদি বিজয়ের মধ্যে নিহিত অর্জনের চেয়ে বিসর্জনের মূল্যই বেশি হয়ে যায়, তাহলে সে বিজয়ের মানে তো চরম পরাজয়। যে বিজয়ে জনগণের মুখে শঙ্কার কালোমেঘ, যে বিজয়ে গণতন্ত্রের শরীরে রক্তের দাগ, যে বিজয়ে গোপন ষড়যন্ত্রের ক্রুর অট্টহাসি, যে বিজয়ে কিলবিল করছে শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের শ্বাপদ ছায়া, যে বিজয়ে নৃত্যরত খলতার অশুভ প্রেতাত্মা, সে বিজয় কি আসলেই বিজয়? এমন বিজয় তুচ্ছ। কলঙ্কময়। নিন্দায় আকীর্ণ। সারা জীবনের বোঝা। এতো শ্রম, সংগ্রাম, ক্ষমতা আর শক্তি প্রয়োগ করে যদি এমনই বিজয় অর্জিত হয়, যা অগ্রহণযোগ্য, বৈধতাহীন, আপাদমস্তক প্রশ্নবিদ্ধ ও কালিমালিপ্ত, সে বিজয় কি এতোই দরকারি? নির্বাচন বন্ধ করে যদি শান্তি ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবাইকে নিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায়, তাহলে কি ক্ষতি? কিছুদিন পিছিয়ে সকলের সম্মতিতে নির্বাচন করার জন্য নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হলে সেটা যদি তৃতীয় শক্তিকে আনার যড়ষন্ত্ররূপে গণ্য করা হয়, তাহলে জনপ্রত্যাখ্যাত, একদলীয়, অস্বচ্ছ, রক্ত-পিচ্ছিল ও সংখ্যালঘুতমদের শাসন নিশ্চিতকারী ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কি নামে পরিচিত হবে? রাজনৈতিক পরিস্থিতির শেষ দেখতে অপেক্ষা করতে হবে বটে। কিন্তু এহেন নির্বাচনের উদ্দেশ্য ও চরিত্র জানতে কাউকেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। সবাই এই নির্বাচনকে চিনে ফেলেছে। তবে সেটা নির্বাচন নামে নয়, অন্য নামে। যে নির্বাচনকে মানুষ নির্বাচন নয়, অন্য নামে চিনে, সে নির্বাচন নিয়ে আর যাই হোক, সত্যিকারের বিজয়ী হওয়া কখনও সম্ভব নয়।
এই পরিস্থিতিতে রক্তময়-সংঘাতমুখর একটি বছরের (২০১৩) ক্ষতচিহ্ন শরীরে নিয়েই এসেছে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ আরেকটি নতুন বছর ২০১৪। ইতিহাসে আর কখনওই বর্ষ-বিদায় ও বর্ষ-বরণ এতোটা রক্তাপ্লুত ছিল না। বিভিন্ন সময় নতুন বছর বরণে অতীতের গ্লানি ছিল কিন্তু এবারের মতো এতো রক্তপাত, দুঃখ, নিপীড়ন ছিল না। আর ছিল না অনিশ্চিত বর্তমান ও অন্ধকার ভবিষ্যৎ। নতুন ২০১৪ সালে আমরা কোথায় চলেছি, এ প্রশ্নের উত্তর কেউই জানেন না। চারদিকে ঘোরতর অমানিশা। রক্তের স্মৃতি। এবং বলদর্পী হিংসা-হনন-জিঘাংসার নগ্ন-উল্লাস। মানুষ এই একতরফা শক্তিমত্তা মেনে নেয়নি। প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু জনপ্রতিবাদে পালিত হরতাল-অবরোধের বিপরীতে কি করা হয়েছে, সারা দেশে কি ঘটেছে, সেটার পুনরুল্লেখের দরকার নেই। টিভি ও সংবাদপত্রের বিবরণে সব কিছুই জানা হয়ে গেছে। শুধু আমরাই জানি নি; সারা পৃথিবীও জেনে গেছে। নিহত, আহত, অস্ত্রবাজি, ভাঙচুর, সংঘর্ষ, আগুন, রক্তপাত, নৃশংস আক্রমণ ইত্যাদিতে চিহ্নিত হয়ে আছে দিনগুলো। রাজপথ ছিল সরকারি দলের অস্ত্র প্রদর্শন আর পিটিয়ে/কুপিয়ে মানুষ মারার রক্তে রঞ্জিত। সাধারণ মানুষ ছিল ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়ায় আতঙ্কিত। সমাজ জীবন ছিল হিংসা এবং প্রতিহিংসার লেলিহান আগুনে দগ্ধ। মনে হয়েছে, ক্ষমতাসীনরা কাউকে সহ্য করতে পারছে না। আফ্রিকার আদিম উপজাতিগুলো যেমন একদল আরেক দলকে তাড়িয়ে ফেরে, সেভাবেই হানা দেওয়া হয়েছে। শক্তি, হিংসা ও ঘৃণায় তল্লাশি করা হয়েছে প্রতিপক্ষকে। হাতের কাছে পেলে নৃশংসতার তা-বে আক্রমণ করা হয়েছে। প্রবল অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কর্মী ও সমর্থকরা প্রতিপক্ষ নিধনের সহিংস উৎসব পালন করেছে। সরকারি শক্তির চরমতম প্রয়োগ করা হয়েছে প্রতিপক্ষ নিধনে। এই সর্বগ্রাসী হিংসা ও নৃশংসতার শেষ কোথায় কেউ জানে না।
জনগণ ছিল জিম্মি। সব সময়ই সাধারণ মানুষ পরিস্থিতির শিকার হন। বহু নিরীহ মানুষ, যারা দল করে না, তারাও নিগৃহীত হয়েছেন। প্রাণভিক্ষা চেয়েও বাঁচতে পারে নি পথচারী দর্জি বিশ্বজিৎ, সাতক্ষীরার নারী ও শিশুরা। মনে হচ্ছে রাজনৈতিক হিংসা ও নৃশংসতার আগুন ক্রমে ক্রমে সাধারণ মানুষকেও পুড়িয়ে ফেলবে। এর থেকে বাঁচার উপায় কি? জনগণ তো শান্তির জন্য, নিরাপত্তার জন্য, নিশ্চিত থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসতে দেয় শান্তি-শৃঙ্খলা, সমঝোতা, সংলাপ ও সুশাসনের জন্য। সরকারের প্রধান কাজই জনস্বার্থ দেখা; জননিরাপত্তা দেওয়া। বিরোধী দলকে জনস্বার্থ ও জননিরাপত্তার নামে নিধন করার আগে তাদের উচিত ছিল নিজেদের ক্যাডারের কবল থেকে বিশ্বজিৎকে বাঁচানো। সেটা করতে পারেনি তারা। বরং আরও আগ্রাসী হয়েছে। দেশের সাবেক ও একাধিক বারের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতাকে পর্যন্ত অবরুদ্ধ ও পথ আটকে রাখা হয়েছে। ঘোষিত ও প্রকাশ্য কোনও আয়োজনই করতে পারছে না বিরোধীরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের যৌথ ও সশস্ত্র প্রতিরোধের শিকার হচ্ছে। এভাবেই চারদিকে জ্বলছে শক্তির মদমত্ততায় প্রজ্বলিত হিংসা ও সন্ত্রাসের নরককু--সদৃশ্য আগুন।
কিন্তু হিংসা আর নির্মম নৃসংশতার আগুনে পুড়ে মরতে চায় না মানুষ। কিন্তু মানুষকে সেদিকেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। একদলীয় আচরণের কালা-পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ছে সব কিছু; শুভবোধ ও সুচিন্তা। অথচ রাজনীতির প্রধান কাজই হলো মানুষকে রক্ষা করা। যে ধারায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের কি হবে? সামাজিক শান্তি ও সৌহার্দ্যরে কি হবে? সবাই মিলে একসঙ্গে থাকার পরিবেশের কি হবে? গণতান্ত্রিক অধিকারের কি হবে?
ক্ষমতার লিপ্সা, রাজনৈতিক হিংসা ও আক্রমণের গতিমুখ বন্ধ করা না হলে সেটা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে; অবিশ্বাস, হিংসার আগুন দাবানল হয়ে জ্বলে উঠবে। আর আগুনের ধর্মই হলো, সে কাউকে রেহ্ইা দেয় না। যে আগুন জ্বালায়, তাকেও না। না মানুষ, না অন্যকিছু, কেউই হিংসার আগুনের সামনে নিরাপদ নয়। মানুষ ও সমাজের এমন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই গত বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম চলতে চলতে নতুন বছরেও প্রবেশ করেছে। ২০১৪ নামের নতুন এই বছরটিও শুরু হয়েছে অবরোধের স্তব্ধতায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে হত্যা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের নারকীয় ঘটনা। এরই মধ্যে চলছে গণতন্ত্রের একাকী যাত্রা, নিঃসঙ্গ ক্ষমতার রথ, সর্বাংশে প্রশ্নবিদ্ধ ও রক্তলিপ্ত নির্বাচনী প্রহসন। এরই মধ্যে মানুষের অধিকার, মর্যাদা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শান্তির জন্য বাণী দেওয়া হচ্ছে। বাস্তব অবস্থা আর প্রদত্ত বাণীর মধ্যে যে সামান্যতম সম্পর্কও নেই, সেটা লক্ষ্য করে অবাক হচ্ছে দেশ ও বিশ্ব। শুধু অবাক হচ্ছে না ক্ষমতার মোহান্ধ-চোখ।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি ও সঙ্কট সম্পর্কে পরামর্শ ও সতর্কতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের জন্য পবিত্র হাদিস থেকে মহানবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দু’টি দিক-নির্দেশনামূলক বাণী উদ্ধৃত করা যায়:
১. মহানবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আলেমদের পদস্খলন, আল্লাহর কিতাব নিয়ে মোনাফিকদের বিতর্ক এবং পথভ্রষ্ট শাসকদের শাসন ইসলামকে ধ্বংস করবে।’ (দারিমী, মুকাদ্দিমা, নং ২১৪)
২. মহানবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘আমি আমার উম্মাতের ব্যাপারে অধিক ভয় করি পথভ্রষ্ট শাসকদের।’ (দারিমী, নং ২০৯, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজা, মুসনাদ আহমাদ)।
পথভ্রষ্ট শাসকদের কারণে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতির কথা মহানবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যাদের দ্বারা খোদ ইসলাম ও মুসলমানরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বা হচ্ছে, তাদের কাছে গণতন্ত্র, মানুষের মূল্য ও অধিকার, জান-মাল-ইজ্জতের ক্ষতি করা তো খুবই ছোট কাজ। অতএব পথভ্রষ্ট শাসকদের সম্পর্কে বর্তমান বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চোখ-কান খোলা রেখে সকল নাগরিকেরই চূড়ান্ত সতর্ক থাকা দরকার।
ধর্মীয় উদাহরণের পর ইতিহাস-নির্ভর একটি বাস্তব তথ্য-প্রমাণ এখানে উল্লেখ করছি। ১৯৮০-‘৯০-এর দশকে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের পেরুতে শাসক গোষ্ঠীর ভ্রষ্টতা, ক্ষমতা লিপ্সা, অন্যায়ের কারণে অভ্যুত্থান, পাল্টা-অভ্যুত্থান এবং সে সবকে রোখার প্রয়াস ক্রমেই এক রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। সেই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে পেরুর ঔপন্যাসিক সান্তিয়াগো রনসালিওলো ‘রেড এপ্রিল’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করে সাহিত্যের সম্মানীয় পুরস্কার ‘ইন্ডিপেনডেন্ট ফরেন ফিকশন প্রাইজ’ পেয়েছিলেন। পেরুর ঘটনা শাসকদের ভ্রষ্টতা, স্খলন ও ব্যর্থতার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসের বিভিন্ন সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরও অনেক আছে। অতএব পথভ্রষ্ট শাসকদের সম্পর্কে নিজেদের রক্ষার প্রয়োজনেই নাগরিকদের চূড়ান্ত সতর্ক থাকা দরকার।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন