গত ৫ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচন
দেশবাসী প্রত্য করেছে। ছয় শতাধিক ভোটকেন্দ্রে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বাধার মুখে নির্বাচন
কমিশন ভোট গ্রহণ স্থগিত করে রাখে। ভোটারদের উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা ও নজিরবিহীন। ১৪৭টি
আসনের প্রায় ৬১টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। এটা উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।
সরকার বিরোধী দলকে নানা কৌশলে নির্বাচন থেকে দূরে রাখে। নির্বাচনের ২ সপ্তাহ আগেই ১৫৩
আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ের ঢেকুর তুলেছে মহাজোট সরকার। নির্বাচনের নাটক মঞ্চায়ন
করে বিশ্ববাসীর কাছে হাসির খোরাকে পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক মহল পর্যবেক পাঠানো থেকে বিরত
থেকে নির্বাচন বয়কট করে। দেশীয় পর্যবেক ফেমার দাবি সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ
১০ শতাংশ ভোট পড়তে পারে আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেছেন ভোটের
হার ৫ শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন তিন দিন পরে ভোটারের উপস্থিতি
৪০ শতাংশ দাবি করেছে। কতজন ভোট দিতে গেছে তা দেশবাসীসহ বিশ্বের মানুষ গণমাধ্যমের বদৌলতে
দেখতে পেরেছেন। দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে এসব বিষয় ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী
মতা আঁকড়ে থাকতে চান বলে মন্তব্য করেছেন প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট। প্রতিবেদনে
বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনীতি পচে গেছে। আমেরিকা, ব্রিটিশ, জাতিসঙ্ঘসহ কোনো দেশ নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেয়নি, ফলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার অবৈধ। অনেক ভোট কেন্দ্রে ভোটার
বলতে কেউ ছিল না। তারপরও দিনের শেষ ভাগে সন্দেহজনকভাবে বিপুলভাবে ভোট পড়তে দেখা যায়।
রাজধানীতে ২০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৯টিতে নির্বাচন হয়েছে।
এতে বলা
হয়, বেগম খালেদা জিয়া অনেকটা গৃহবন্দী ছিলেন। এরশাদ বয়কটে যোগ দেয়ায়
তাকে সামরিক হাসপাতালে আটকে রাখা হয়। জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল নিষিদ্ধ।
১৮ দলীয় জোটের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলখানায় আটক। সহিংসতা বন্ধ করার অজুহাত হিসেবে
ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। শেখ হাসিনা ভারতের কিছুটা রাজনৈতিক সমর্থন পাচ্ছেন।
বৃহত্তম প্রতিবেশী ভারত নির্বাচনে মাত্র দু’জন পর্যবেক পাঠিয়েছে। ক্রমবর্ধমান
হারে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, ভারত শেখ হাসিনাকে অনেক বেশি সমর্থন করে, তবে এটা নিশ্চিত যে ভারত জামায়াত ও ইসলামী দলগুলোকে দুর্বল দেখতে চায়।
গণতন্ত্রের
মাপকাঠিতে নতুন সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ বলেছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার।
‘ভারতের দায়িত্ব’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লিখেছে, বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের বিষয়েও নয়াদিল্লির স্পষ্ট অবস্থানে আসা দরকার।
মাত্র ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে। গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে নতুন সরকারের বৈধতা প্রশ্নযোগ্য কিংবা
সরাসরি অবৈধ। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন তাদের অনাস্থা ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে। গণতান্ত্রিক
নীতিতে আমূল অঙ্গীকারবদ্ধ ভারতও স্বস্তিতে নেই।
আনন্দবাজার
লিখেছে, এ মুহূর্তে ভারতের অন্যতম বৃহৎ সঙ্কটের নাম বাংলাদেশ। ঢাকার নির্বাচন-পরবর্তী
ঘটনাক্রম দেখিয়ে দিচ্ছে, কয়েক মাস আগে থেকে যে, লাগাতার রাজনৈতিক সংঘর্ষে সে দেশ আচ্ছন্ন ছিল, সেই সংঘর্ষ অনেক তীব্র হয়েছে। একটি ভোট অনুষ্ঠান যেন রাতারাতি দেশটিকে দুই
যুযুধান শিবিরে বিভক্ত করে দিয়েছে। এক দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প, অন্য দিকে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সব বিরোধী প।
বাংলাদেশে
বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের ল্েয সংলাপের আহ্বান জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট প্রস্তাব
গ্রহণ করেছে। সিনেট বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিােভ প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া মানবাধিকার কর্মীদের
হয়রানি বন্ধ এবং গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়।
প্রস্তাবে
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে অবাধ, নিরপে, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরাসরি ও অর্থপূর্ণ সংলাপে
বসতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ
নিয়ে এবং শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের পথ সুগম করতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
নির্বাচনে পর্যবেকদের নিরাপত্তা এবং অবাধ গতিবিধির নিশ্চয়তা দিতে নেতাদের প্রতি আহ্বান
জানানো হয়েছে। (৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক পাঠায়নি) মতবিরোধ দূর করতে
জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিব তারানকোর উদ্যোগে শুরু হওয়া আলোচনার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে
সিনেট। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত, মানবাধিকার কর্মীদের হেনস্তা
বন্ধ এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ‘স্বাধীনতা’ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আহ্বান জানায়।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল খুবই সহিংস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বন্ধুপ্রতিম
দেশ হিসেবে চীন চরম উদ্বিগ্ন। চীন আশা করে, বাংলাদেশের দলগুলো দীর্ঘমেয়াদি
জাতীয় ও মৌলিক স্বার্থগুলোকে অগ্রাধিকার দেবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক
স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে আলোচনা করবে। সবার অংশগ্রহণমূলক একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া
চায় কোরিয়া। ঢাকায় রাষ্ট্রদূত লি ইউন ইয়ং বলেছেন, বন্ধুদেশ কোরিয়া মনে করে জনগণের
আশা-আকাক্সার প্রতিফলন ঘটে এমন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ সবার অংশগ্রহণমূলক
নির্বাচনে যত দ্রুত সম্ভব শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
সহিংসতা
পরিহার করে স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নতুন নির্বাচনের জন্য
প্রকৃত সংলাপ শুরু করতে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পররাষ্ট্রবিষয়ক
প্রধান ক্যাথরিন অ্যাস্টন এক বিবৃতিতে বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির
হার কম হওয়ার সংবাদ তারা বিবেচনায় নিয়েছেন। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের সময় সহিংসতা
বিশেষ করে নারী-শিশু, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠিগুলোর উপর হামলার
তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। জনগণের স্বার্থকে সবার আগে স্থান দেয়ার আহ্বান জানিয়ে গণতান্ত্রিক
জবাবদিহির ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য নতুন নির্বাচনের ল্েয প্রকৃত
সংলাপে নিয়োজিত হওয়ার জন্য সব দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বিরোধী
শক্তিকে নির্মূলের অভিযান বন্ধ করে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের
ল্েয সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগে সাড়া দিয়েছেন ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা
জিয়া। এখন শেখ হাসিনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি
করার। জনগণ নির্দলীয় ও নিরপে নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের আগামী দিনের নেতৃত্বকে বেছে
নেবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন