রবিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১৪

স্বৈরশাসকদের পরিণতি শুভ হয় না


দুনিয়ার ক্ষণকালের ক্ষমতা বা অক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করে কিছু মানুষকে মানবতার কল্যাণে বাছাই করতে চান। সে বাছাই পরীক্ষায় অনেকে অঙ্কুরে ঝরে যায়। ক্ষমতান্ধ হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে অবিবেচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশ, জাতি, সমাজ, পরিবারের উপর নিজের নিষ্ঠুরতাকে চাপিয়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। আর যারা অক্ষম তারা শাসকবর্গের আশ্রয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হয়, তাদেরকেও আল্লাহ ক্ষমতা না দিয়ে তাদের মনের অবস্থা নিরীক্ষণ করতে চান। যুগে যুগে অনেকে ক্ষমতাসীন হওয়ার সুবাদে দেশ-জাতিকে নিজের মত ভালবেসে জনগণের মনের মানুষ হিসেবে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। আর স্বৈরাচারী শাসকেরা ধরার বুকে অসাম্য ও অন্যায়ের দাবানলে দগ্ধ করে বনী আদমকে পদপিষ্ট করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে চরম নিষ্ঠুরতম পথ বাছাই করে নেয়। ফেরাউন ছিলেন প্রাচীন দুনিয়ার নিষ্ঠুরতম স্বৈরশাসক। তিনি নিজেকে পুরো দুনিয়ার মালিক বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন-“আনা রাব্বুকুমুল আলা”। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে নমরূদসহ অনেকে। ক্ষমতার উত্তাপ সবাই সহ্য করতে পারেনা। তাই ক্ষমতার উত্তাপে সবাইকে জ্বালিয়ে ছারখার করে ফেলতে চায়। তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে খুব কম মানুষ।
আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় নতুন করে অ্যাডলফ হিটলার স্বৈরতন্ত্রের সূচনা করেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নানা দেশ নানাভাবে স্বৈরতন্ত্রের শিকলে আবদ্ধ করে দুনিয়াকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে নব্য স্বৈরশাসকরা। কেউ ঘোষিত স্বৈরশাসক আবার কেউ বা গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরশাসক। স্বৈরশাসকদের শাসনে মানবতার অপমৃত্যু ঘটে। মুক্তিকামী মানুষ ফুঁসে উঠে। শুরু হয় শাসক ও শোষিতের লড়াই। কোথাও সমাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসক কোথাও বা তথাকথিত নির্বাচিত স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। যার শেষ পরিণতি হয় ভয়াবহ। শুরু হয় জনগণের রাষ্ট্রব্যবস্থা। শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে নির্বাচনে জালিয়াতি, নির্যাতন-নিপীড়নের পথকেই বাছাই করে নেয়। এক সময় প্রতিবাদী মানুষের লাশ, আন্দোলন ও বিদ্রোহে কেঁপে উঠে স্বৈরতন্ত্রের সালতানাত, নেংটি ইঁদুরের মত লেজ গুঁটিয়ে পালানোর পথ খুঁজে। স্বৈরশাসক মহারাজা-নবাব-বাদশাহগণ বিদায় নিতে বাধ্য হন। তাদের লাঞ্ছনা, অপমান, অপদস্থতা হয় জীবনের শেষ উপহার। দুনিয়ার স্বৈরশাসক হিসেবে যারা পরিচিত তারা বঞ্চিত-শোষিত মানবতার ঘৃণার পাত্র। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও এর থেকে মুক্তি পায়নি। সহজ সরল মানুষগুলোকে দাবার ঘুঁটি বানিয়ে ক্ষমতার যাঁতাকলে পিষ্ট করেছে শেখ মুজিব ও জেনারেল এরশাদ। এখন একই পথে হাঁটছেন শেখ হাসিনা! লোকে বলে শেখ হাসিনা হিটলারকেও হার মানিয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী! আসলে কি তাই? তাহলে শেষ গন্তব্য কোথায়?
দার্শনিক এ্যারিস্টটল বলেছেন, রাষ্ট্র মানুষের একটি স্বভাবগত কার্যক্রম। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক। মানুষের প্রকৃতিই তাকে রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি আরও বলেছেন, যে মানুষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রয়োজনবোধ করে না, সে হয়তো মানবেতর জীব, না হয় মানব প্রজাতির উর্ধ্বে কোন সত্তা। এরই ধারাবাহিকতায় সমাজ, গোষ্ঠী, কওম বা জাতির প্রধান সৃষ্টি। তারাই নিজেদের তৈরি আইনের মাধ্যমে পৃথিবীকে করালগ্রাস করতে চায়। পৃথিবীব্যাপী এমন কিছু স্বৈরশাসকের পরিচয়, শেষ পরিণতি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী নীতির সারসংক্ষেপ বর্ণনা মাত্র-
অ্যাডলফ হিটলার ছিলেন জার্মানীর সর্বকালের সেরা স্বৈরশাসক। ফ্যাসিবাদের জনক হিটলারের রাজ্যজয় ও বর্ণবাদী আগ্রাসনের কারণে লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। ৬০ লাখ ইহুদিকে পরিকল্পনা মাফিক হত্যা করা হয়। ইহুদি নিধনের এই ঘটনা ইতিহাসে হলোকস্ট নামে সবাই জানে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে হিটলার বার্লিনেই ছিলেন। রেড আর্মি যখন বার্লিন প্রায় দখল করে নিচ্ছিল সেরকম একটা সময়ে তিনি ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই তিনি ফিউরার বাংকারে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। তার ক্ষমতা আর দাম্ভিকতা তাকে শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
ইতালির মুসোলিনিও হিটলারের মত বক্রপথ অনুসরণ করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিণতি তাকেও বরণ করতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সবদিক থেকে বিধ্বস্ত ইতালির ভিক্টর ইমানুয়েলের গণতান্ত্রিক সরকার ও জার্মানির হিন্ডেনবার্গ সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনিও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর হিটলারের মতো তার চেহারাও পাল্টে যায়। পরবর্তীতে স্বৈরাচারী ও একনায়ক হিসাবে আবির্ভুত হন। মুসোলিনি সুইজারল্যান্ডে পালাবার সময় কম্যুনিস্ট প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন, পরে তাকে হত্যা করা হয়। দুজনের বিস্তার ও মৃত্যুর মধ্যে কি অসাধারণ মিল! আজ দু’জনের রাজনৈতিক দলই দুদেশে নিষিদ্ধ।
ফ্রান্সের নেপোলিয়ান, তার বিশাল সা¤্রাজ্যের বিস্তার ছিলো মাদ্রিদ থেকে মস্কো পর্যন্ত, স¤্রাট হন তিনি ফ্রান্স এবং অর্ধ পৃথিবীর। পৃথিবীর মানুষ তাকে মনে রাখবে একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে। কিন্তু কিছু মানুষ তাকে বেশিদিন রাজত্ব করতে দেয়নি এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। একটু ইতিহাসের পাতা থেকে ঘুরে আসলে দেখা যাবে, ফরাসী জাতি সারা বিশ্বে একটি সম্মানিত জাতি, ইউরোপের কেন্দ্রবিন্দু। আর ফ্রান্সের এই সফলতার একমাত্র নায়ক নেপোলিয়ান। নিজের দেশে স¤্রাট ছিলেন মর্যাদাবান। কিন্তু বাইরের দেশে তার রূপ ছিলো ভিন্ন। স¤্রাটের সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি অন্য দেশের জন্য হুমকি বলে মনে করা হত। তাই তারা তাকে ভাল দৃষ্টিতে দেখতে পারেনি । তাই স¤্রাটের বিরোধী দলগুলো জোট বাঁধে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে। নিজ দেশের জনমতকে উপেক্ষা করে তার সা¤্রাজ্য সম্প্রসারণের প্রধান শত্রু ব্রিটেন, ক্রোয়েশিয়া ও রাশিয়াকে ধ্বংস করে দেশ দখলের নিমিত্তে নেপোলিয়ান ৫ লাখ সৈন্য নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন। কিছু দেশ তার আয়ত্তে চলে আসে। রাশিয়া, ব্রিটেন ও ক্রোয়েশিয়া নেপোলিয়নের বেপরোয়া সা¤্রাজ্য সম্প্রসারণ ঠেকাতে চুক্তিবদ্ধ হয়। শত্রু বাহিনীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আক্রমণে নেপলিয়ান পরাজিত হয়ে পড়েন এবং এক সময় তিনি রাজত্ব হারান। ক্ষমতাধর নেপলিয়নের একনায়কতন্ত্রের মসনদ তাকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে অপদস্ত ও অপমানিত করে স্বৈরশাসকদের তালিকায় যুক্ত করেছে। ক্ষমতান্ধতা তার অভূতপূর্ব জনকল্যাণকর কাজসমূহকে ম্লান করে দেয়।
মিসরের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলীর পর হোসনী মোবারক সে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসক। আরব বিশ্বে লম্বা সময় দেশ শাসন করছেন অনেকে। হোসনী মোবারক তাদের অন্যতম। ১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর সেনাবাহিনী এক সদস্য কর্তৃক তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাত নিহত হওয়ার পর হোসনী মোবারক ক্ষমতায় আসেন। জাতীয় নির্বাচনে পার্লামেন্ট অনুমোদিত মাত্র একজন প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন সেই প্রার্থী ছিলেন হোসনী মোবারক। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার দায়ে বিশ্বজুড়ে তিনি নিন্দিত। মিসরে গণজাগরণের মাধ্যমে তাকে লাঞ্ছিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়। আর বর্তমান মিসরের রাজনৈতিক উত্তপ্ততার জন্য তাকেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দায়ী করছেন।
ইরাকের স্বৈরাচারী একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের পতন হয় ২০০৩ সালে। সে সময় ইরাকে বহু অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও রক্তক্ষয় দেখা গেছে। সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর তার হত্যাকা- নিয়ে মূল্যায়নের শেষ নেই। বলা হয়ে থাকে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ও অন্যান্য দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে গুরুত্ব না দেয়ায় তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে পশ্চিমা বিশ্ব। আর তাই তাকে জনমত নিয়ে জনসম্মুখে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। বিদেশী প্রভুদের যতই হস্তক্ষেপ থাকুক না কেন জনগণ যদি তার সাথে থাকত তাহলে হয়তবা এই পরিণতি হতনা। সাদ্দামের জনবিচ্ছিন্ন বেপরোয়া শাসননীতিতে মার্কিনীরা যেমন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সচেষ্ঠ হয় একিভাবে ইরাকী জনগণ ও তার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। তার স্বৈরনীতির শেষ ফল হিসেবে মার্কিন সেনারা তাকে টেনে হিঁচড়ে গর্ত থেকে বের করে এবং ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলায়। এ ধরনের শাসকরা তাদের স্বৈরনীতির কারণেই লাঞ্ছিত হয় বা মৃত্যুমুখে পতিত হয় শুধু তাই নয় বরং একটি জাতিকেও মেরুদ-হীন করে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দেয়।
লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি জনপ্রিয় ‘ব্রাদারলি লিডার হলেও তিনি মূলত একনায়ক, স্বৈরশাসক হিসেবেই পরিচিত। দীর্ঘ ৪২ বছর তিনি এক হাতে শাসন করেছেন উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া। দেশ-বিদেশে সুনামের পাশাপাশি তাকে নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। গাদ্দাফি ফিলিস্তিনের ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’র একজন ভক্ত হলেও পশ্চিমাবিরোধী নীতির কারণে গাদ্দাফিকে পশ্চিমারা সব সময়ই নেতিবাচক চোখে দেখেছে। কূটনৈতিক অঙ্গনেও তার প্রতি দৃষ্টি তেমনই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান নিজেই গাদ্দাফিকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের পাগলা কুকুর’ বলে অভিহিত করেন। তারা একাধিকবার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেষ্টা চালায়। সর্বশেষ বিদ্রোহীরা তার বাব আল আজিজিয়া প্রাসাদ দখল করে নেয়। সেখান থেকে তার আগেই পালিয়ে যান মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও তার পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্য দিয়েই মূলত গাদ্দাফির পতন ঘটে। তারপরও তার অনুগতরা লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। সর্বশেষ তারা তার জন্মশহর সির্তে অভিযান চালায়। সেই অভিযানেই গুলীবিদ্ধ হন গাদ্দাফি। দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন থাকার সুবাদে তার মাঝে স্বৈরতান্ত্রিকতা জেঁকে বসে। এমন সুযোগেই জেনারেল গাদ্দাফির পতনের জন্য তার কাছের লোকরাই শত্রুদের সাথে হাত মিলায়।
জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে, ১৯৮০ সালে দেশটি ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে মুগাবে শাসন ভার নিয়েছেন। ৩৩ বছর ধরে তার শাসনই চলে আসছে। নতুন সংবিধানের অধীনে প্রথম নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মুগাবে ৬১ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। যদিও বিরোধীরা এ নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন বলে দাবি করেছেন। দেশটিতে আবার সরকারবিরোধী আন্দোলন ও সহিংসতার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
সিরিয়ার বাশার আল আসাদ গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে বিরোধী সকল মতকে উপেক্ষা করে স্বীয় মতকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে আসাদ বিরোধীরা প্রতিবাদ করে। শুরু হয় তার দমন-পীড়ন। এমন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সা¤্রাজ্যবাদীরা তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য বিরোধীদের উস্কাতে থাকে এবং আসাদ সরকারকে পরাস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে সিরিয়াতে আসাদ সরকার ও বিরোধী জোট এক ভয়াবহ সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যদি আসাদ ও তার বিরোধী জোট সমস্যা সমাধানে না পৌঁছে তাহলে দেশটিতে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটবে এবং সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে মাথা ঘামাচ্ছে তাতে এর অবস্থা ইরাকের চাইতেও ভয়াবহ হবে। প্রতিনিয়ত সরকার ও বিরোধীদের সংর্ঘষে বেসামরিক বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এর সমাধানে আসাদের লক্ষ্যণীয় ভূমিকা না থাকায় দেশাভ্যন্তরে আসাদের বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠছে আবার অন্যদিকে বহির্বিশ্বও মাতব্বরি করছে। এতে স্পষ্ট যে আসাদের স্বৈরনীতিই তাকে অপদস্ত করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ক্ষমতা”্যুত করবে।
সাবেক সেনা শাসক হিসাবে সামরিক শাসন জারি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের কারণেই এইচ এম এরশাদের পতন হয়েছিল। যার বিচার বাংলাদেশের আদালতে হয়নি। বরং তিনি সংসদ সদস্য হিসাবে এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দুই যুগ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানোর পর এরশাদ গ্রেফতার হলে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না-আসা পর্যন্ত কারারুদ্ধ থাকেন। বিএনপি সরকার তার বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে কয়েকটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন। ছয় বছর অবরুদ্ধ থাকার পর ৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার মধ্যে মূল ধারার তিনি চেয়ারম্যান। দলের প্রবীণ নেতা প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক প্রধাণমন্ত্রী কাজী জাফরকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে আরো একভাগ হল এরশাদের জাতীয় পার্টি। এরশাদ বর্তমানে আওয়ামী জনবিচ্ছিন্ন পাতানো নির্বাচনে প্রকাশ্যে সমর্থন না দেয়ায় সরকারি হেফাজতে রুগী সাব্যস্ত করে সিএমএইচএ ভর্তি করিয়ে তার স্ত্রী রওশনকে এ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট বানিয়ে জাপাকে নির্বাচনে আনার হাস্যকর আয়োজন করে। জাতির সামনে তা দিবালোকের মত স্পষ্ট; যা ঘৃণার, লজ্জার ও অপমানের। আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় এরশাদ একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সত্য; কিন্তু তাই বলে তাঁর গায়ে লেগে থাকা স্বৈরশাসকের কালি একটুও মুছে যায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে যতগুলো দুর্নীতির মামলা ছিল, সবগুলোর বিচার হলে তাঁর কারাদ-ের মেয়াদ সবচেয়ে আলোচিত হত। আইন নিজস্ব গতিতে চলেনি বলেই একদা স্বৈরশাসক এখন গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক দল ও নেতা-নেত্রীদের প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়েছেন। নব্বইয়ের পর জাসদের নেতা ও বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তাঁর বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছিলেন। সেই মামলার খবর কী? গত দুই দশক স্বৈরাচারের হাত ধরে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় টিকে ছিল। আর তাই এরশাদ একবার একেকরকম কথা বলছেন। বছর খানেক ধরেই এরশাদ মহাজোটের বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তুলে আসছিলেন যে এ সরকার দুর্নীতিবাজ ও দেশ শাসনে ব্যর্থ। অতএব এ সরকারের সঙ্গে তার কোনো রকম আপস নেই। তিনি বহুবার মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেভাবে মহাজোট ছেড়েছেন, সেটি নাটক নয়, প্রহসনের অংশ। আওয়ামী লীগ মুলা ঝুলিয়ে তিনটি পূর্ণ, দুটি অর্ধমন্ত্রী এবং একটি উপদেষ্টার পদ তাদেরকে দিয়েছে। বর্তমানে প্রহসনের নির্বাচনে মূল বিরোধী দলকে বাইরে রেখে ক্ষমতায় যেতে আওয়ামী লীগ ৬টি মন্ত্রী পদ (!) দিয়েছে। ১৯৮৩ সালের ২৪ মে শুল্ক কর্তৃপক্ষ প্রতিরক্ষা বিভাগের আমদানি করা এক কোটি টাকা মূল্যের ১৭ হাজার ছয়টি ঘড়ি আটক করে। সেনা গোয়েন্দারা সংশ্লিষ্ট শুল্ক কর্মকর্তা আবদুর রউফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যান। এরপর রউফ রহস্যজনকভাবে মারা যান। তাঁকে অবশ্যই নির্যাতন করা হয়েছিল। সরকারের মুখপাত্র সব সংবাদপত্রকে সরকারের দেয়া প্রেস রিলিজ ছাপার নির্দেশ দেন। রউফের স্ত্রীকে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। ১৯৮৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সে বছর দেয়া শিল্পঋণের ৫০ ভাগই ২২ জন ব্যক্তির মধ্যে বণ্টন করা হয়, যারা এরশাদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৮৫ সালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির এক কোটি টন গমের এক-তৃতীয়াংশ এরশাদের রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মাধ্যমে তছরুপ করা হয়। নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এরশাদ পীরদের ব্যবহার করেছেন। আগের রাতে স্বপ্ন দেখে শুক্রবার বিভিন্ন মসজিদে যেতেন বলে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করেছেন। এরশাদ নিজের স্বার্থে এ অবৈধ কাজ করায় রাষ্ট্রের ৬৬.০৪ কোটি টাকা লোকসান করেছেন। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই এ মামলার কার্যক্রম শুরু হলেও এখন পর্যন্ত বিচারকাজ শেষ হয়নি। আমাদের সমাজে যে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ রয়েছে, তার কিছুই এরশাদের নেই। তিনি অনেক নারীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক করেছেন। এরশাদ সম্পর্কে তাঁরই একসময়ের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান লিখেছিলেন: ‘আমার সরল বিশ্বাসের সুযোগে সামরিক প্রশাসক কীভাবে তাহার প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়া স্বৈরতন্ত্র চিরস্থায়ী করিবার সমস্ত কৌশল নিয়োগ করিয়াছে এবং অন্যান্য স্বার্থবাদী মহলও জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে তাহার অনুকূলে সমর্থন জোগাইয়াছে তাহারই একটি চিত্র এই বইয়ে আঁকিবার চেষ্টা করিয়াছি।’ এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে যে স্বৈরশাসকের সঙ্গে সহাস্যবদনে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন, যাঁকে গণভবনে ডেকে আপ্যায়ন করেছেন, সেই শেখ হাসিনাই ১৯৯১ সালে বিরোধী দলের নেত্রী থাকতে তাঁকে অবিলম্বে জেলখানায় পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনার বক্তব্য ছিল এরূপ, ‘মাননীয় স্পিকার, সংসদ নেত্রী (খালেদা জিয়া) নির্বাচনের পূর্বে সাত দিনের মধ্যে এরশাদের বিচার এবং ফাঁসির দাবি করেছিলেন। এখন তিনিই প্রধানমন্ত্রী, আজকে আমরাও বলতে চাই তিনি এখনো কেন এরশাদকে শাস্তি দিতে পারেননি? শেখ হাসিনা এরশাদের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা নেননি বলে দাবি করেছেন। কিন্তু বিএনপি আমলে যাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জেলখানায় পাঠানো এবং বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁর দুই মেয়াদের পুরো সময়টাই তাঁকে কারাগারের বাইরে রেখেছেন। যদিও খালেদার প্রথম শাসনামলের পুরো সময়টাই তিনি জেলে ছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ আমলে এরশাদ বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোট করার পর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সব চোর এক হয়েছে। এখন সেই ‘সব চোরের’ পালের গোদাকে তিনিই সসম্মানে বরণ করে নিলেন। তাঁর দল থেকে ছয়জন মন্ত্রী এবং একজন উপদেষ্টাকে নিয়োগ দিলেন। নূর হোসেন-তাজুলদের আত্মা আপনাদের ক্ষমা করবে কি?
শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় ক্ষমতায় টিকে থাকার বাসনায় পাগলপারা। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য নিজের মত করে দলীয় আদর্শের ব্যক্তিবর্গকে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানে পদায়ন করেন, সংবিধানকে উলট-পালট করে আইনের বুলি আওড়িয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মানসে দেশকে চরম অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন শেখ হাসিনার আশেপাশে যারা আছেন তারা তাকে ঘিরে রেখেছেন, তৈলমর্দন করছেন ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে বাধ্য করছেন। কারণ সে কয়েকশ দলীয় ও আমলা ব্যক্তি এত বেশি দুর্নীতি ও অপকর্ম করেছেন যে ক্ষমতা হারালে কারো রক্ষা হবেনা বলে তারা ভয় করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলীতে এত লোকের হানাহানির ঘটনা কখনো ঘটেনি। হাসিনা সরকারের এহেন আচরণের বিরুদ্ধে কোন ধরণের প্রতিবাদও করার সুযোগ নেই। বিরোধীদলীয় অফিসগুলো বন্ধ করে রেখেছে মাসের পর মাস। সব বক্তব্য শুধু ওনাদের, শুধু ওনারাই বলবেন; বিরোধী দলগুলোর কিছুই বলার বা মতপ্রকাশের সুযোগ নেই। সভা-সমাবেশে গুলী, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এখন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করে নির্মম নির্যাতন এখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গুম-হত্যা এখন বিরোধী শিবিরের সকল নেতাকর্মী তাড়িয়ে বেড়ায়। রিমান্ডের নামে যে নির্যাতনের খড়গহস্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তাতে অনেক নিরপরাধ মানুষকে জীবনের তরে পঙ্গু বানিয়ে দেয়া হয়েছে। যা সভ্যসমাজে কখনো চিন্তাও করা যায় না। দেশের সকল বিরোধী মতকে দমনের জন্য হাজার হাজার সাজানো মামলায় জড়িয়ে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদ-ের ফ্রেমে পিষ্ট করছে। অতীতের যে কোন স্বৈরশাসককে হার মানিয়েছেন শেখ হাসিনা। বর্তমানে দেশাভ্যন্তরে আসন্ন ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে দেশ বাণিজ্যিক অবরোধের মুখে পড়তে পারে। ভারতনির্ভর শেখ হাসিনা তার অবস্থান কি তাহলে স্বৈরাচারীর তালিকায় এক নাম্বারে নাম লিখাতে চলছেন? হয়ত বা তার এমন পরিণিতির জন্য দেশবাসীকে আর ক’টা দিন অপেক্ষা করতে হবে। ইতিহাস এটিই বলে।
৭২-৭৫ এ দেশের রাজনীতিতে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো এখন হুবহু সেই পরিবেশই বিরাজ করছে। জীবন-যাপনের সকল উপকরণের ব্যাপক দাম বেড়েছে। কোথাও কেউ সরকারি নির্দেশ মানছে না। দেশের দশভাগ লোকের নেতারা ৯০ ভাগ মানুষের ধর্ম নিয়ে তামাশা শুরু করেছেন। একসময় মরহুম শেখ মুজিব বলেছিলেন বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। তিনিই ভারতের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও শেখ মুজিব সেটা আমলে নেননি। তিনি নিজেকে একজন মুসলমানই মনে করতেন। মুজিবকন্যা এখন যাদের দলে তুলে নিয়ে ক্ষমতায় এককভাবে টিকে আছেন তারা সবাই তার মেকি শুভাকাক্সক্ষী। তিনি কি ভুলে গেছেন? তার পিতার খুনের পর তার লাশ সিঁড়িতে ফেলে রেখে বিদেশ পালিয়ে তাকে ফেরাউন বলে গালি দিয়েছে। এছাড়া পৃথিবীব্যাপী যত স্বৈরশাসক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে জেঁকে বসেছিল, কারো পরিণতিই শুভকর হয়নি, শুধুমাত্র তাদের একগুঁয়েমি ও অগণতান্ত্রিক মানসিকতার জন্য। এদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু রয়েছে বাংলাদেশের। স্বৈরাচারী কোনো শাসক যখন একটি জনবসতির উপর কর্তৃত্ব লাভ করে তখন তারা সেই জনপদের মানুষদের ধ্বংস করে ফেলে। তারা সবচেয়ে বেশী অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে জনপদের সম্মানিত ব্যক্তিদের। আমরা আমাদের এই জনপদে অনেক স্বৈরশাসককে দেখেছি। আমাদের আশেপাশের দেশেও বহু অত্যাচারী স্বৈরশাসক ছিল। তারা কেউই আজ আর নেই। ইতিহাসের পাতা থেকেও আমরা বহু অত্যাচারী ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বৈরশাসকের কথা জেনেছি। ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য এখনও বহুদেশের শাসকরা যুদ্ধে নেমেছে। তারা কখনই সফল হবেনা। বাংলাদেশেও কোন শাসকের এই অপচেষ্টা সফল হবেনা। মহান আল্লাহ এই জনপদকে ইসলাম ও মুসলমানের জন্য তৈরী করেছেন। তিনিই মুসলমানদের কল্যাণে বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads