বছর পরিক্রমায় আবার আমাদের মাঝে এসেছে পবিত্র নবী দিবস। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মত হওয়া যেমন একটি সৌভাগ্যের বিষয় তেমনি তার জন্ম স্মৃতি প্রাপ্তিও একটি সৌভাগ্যের বিষয়। কেননা তিনি সেই মহান ব্যক্তিত্ব যাঁর মাধ্যমে মহান আল্লাহ নবুওয়াতের ন্যায় মস্তবড় নেয়ামতের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। তারপর আর কোনো নবী আসবেন না। তিনিই আখেরী নবী। ইহ-পারলৌকিক মুক্তির সনদ বিশ্ব মানবের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত শেষ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা ইসলাম ও নবী মোস্তফা (সাঃ)-এর মাধ্যমেই এসেছে। কাজেই পৃথিবীতে সেসব মানুষই সবচাইতে বেশী ভাগ্যবান যারা এ জীবন বিধানের যথার্থ অনুসারী এবং নিজ ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনে আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের অনুকরণে ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে সক্ষম। এদিক থেকে পবিত্র নবী দিবস একটি আত্মজিজ্ঞাসার দিন। এদিন প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য, মহান আল্লাহ মানুষের ইহ-পরকালীন মুক্তি, কল্যাণ ও পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য মহানবীকে যেই ‘উসওয়া-এ-হাসানা’ বা সুন্দরতম আদর্শ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন আমাদের সকলের ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনকে সেই আদর্শ মাফিক আমরা গড়ে তুলছি কি না অথবা আমরা তার বিপরীত ধারায় নিজেদের ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনকে পরিচালিত করে শয়তানকেই খুশি করছি? যার পরিণতি হলো, এই দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানেই আমাদের চরম দুর্গতি?
পবিত্র নবী দিবসে উল্লেখিত এই আত্মজিজ্ঞাসার তীব্র প্রয়োজন এ দেশে আজ নানান কারণে দেখা দিয়েছে। প্রথম কারণতো হলো এ জন্য যেÑ আমাদের এই দেশ, এই জনপদ ১৬ কোটি তাওহিদী জনতার দেশ। ফলে আমরা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের যেই স্তরে যারাই অবস্থান করছি, যারা যেই দায়িত্বে আছি, এর যেই স্তরে যার যেই কর্তৃত্ব, সেখানকার খোদায়ী বিধানের কোনো ব্যতিক্রম ঘটলে এবং সংশ্লিষ্ট স্তরে কোনো অন্যায়ের দরুন মানুষের কোনো কষ্ট হলে, সে জন্যে প্রত্যেক স্তরের কর্তৃত্বশালীরাই দায়ী হবেন। অনুরূপ সামগ্রিকভাবে সকলের ঊর্ধ্বে নীতি নির্ধারক যারা থাকবেন, সেখানকার কোনো অন্যায় বা নবী আদর্শবিরোধী কোনো কাজের জন্যে তাদেরকেই দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এভাবে সমাজের তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতির শীর্ষ পর্যায়ের সকলকেই নবীর আদর্শ পরিপন্থী সংঘটিত কার্যাবলীর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। নবী দিবস ও এ জাতীয় পবিত্র ধর্মীয় দিবস এবং জাতীয় দিবস আসলে আমাদের বড় বড় দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ মিডিয়ায় বিভিন্ন ভাষণ ও তাতে অনেক নীতিবাক্য উচ্চারণ করেন। নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য শেষ করেন। যদিও সেই নীতিবাক্য মাফিক দেশে বাস্তব কাজ হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা এতো বৃদ্ধি পেতো না। এ জন্যে জনদুর্গতিও এতো বাড়তো না। সামগ্রিক আত্মজিজ্ঞাসাকালে গণতন্ত্রের যুগে আমাদের সকলের এদিকেও বিশেষ লক্ষ্য দেয়া কর্তব্য যে, দেশের নেতা, হর্তা-কর্তা, আইন প্রণেতা নির্বাচনকালে সব তওহিদী জনতা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন প্রাক্কালে তাদেরকে একথা বলেন যে, নির্বাচিত হয়ে আপনারা রাষ্ট্র পরিচালনা ও নেতৃত্বে নবী জীবনের কোনো আদর্শবিরোধী কাজ করবেন না। অন্যথায় ভোটদাতা হিসেবে যেহেতু আমরাও তাতে শরীকদার হয়ে যাই সেজন্য আপনাদের মধ্যে এমন প্রার্থী হওয়া উচিত এবং এসব কাজই করা উচিত যা আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর নবী জীবনের আদর্শের অনুকূলে।
নবী দিবসের আত্মজিজ্ঞাসাকালে আজ নানান কারণে, আরেকটি বিষয়ও এই বাংলাদেশের কোটি কোটি তওহিদী জনতার নতুন করে চিন্তা করার দরকার হয়ে পড়েছে। সেটি হলোÑ এ দেশে এতো কোটি কোটি মুসলমান, হাজারো, লাখো ওলামা-মাশায়েখ থাকা সত্ত্বেও উল্লেখিত বিষয়টি নতুন করে চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে দেখা দিলো কেন? তা এ জন্য নয় কি যেÑ এ ভূখ-ের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী তওহিদবাদী হওয়া সত্ত্বেও নানান কারণে অনেকেই ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার বদলে খ-িত জীবনব্যবস্থা মনে করে। ইসলাম সম্পর্কে অগভীর চিন্তার শিক্ষিতদের কথা দূরে থাক দ্বীনের খাদেম অনেক নিষ্ঠাবান আলেমও কার্যত এটাই মনে করেন। ফলে এটি আজ আনুষ্ঠানিক কার্যাবলীবিশিষ্ট তথাকথিত ধর্মে পরিণত হয়ে গেছে এবং কতিপয় নির্দেশ পালন ব্যতীত জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের যেসব বিষয় পুরো কুরআন মজিদে ও নবী জীবনের আদর্শে রয়েছে সেগুলো আমলের কোনো ব্যবস্থা হয় না। বিশেষ করে দেশের বিচার বিভাগ, আইন আদালত, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, রাজনীতি ও অন্যান্য জরুরি বিষয়Ñ ঐগুলো বাস্তবায়নের প্রতি কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই।
অথচ আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহর নিকট একমাত্র ইসলামই মানুষের জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম ছাড়া জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কেউ অন্য কিছু অন্বেষণ করলে তা কখনও গ্রহণযোগ্য হবে না।” এমন কি আমরা বর্তমানে যেভাবে খ-িত ও আংশিকভাবে ইসলাম পালন করছি, এটাও আল্লাহর বাণীর আলোকে চিন্তা করলে দেখা যায়, তার পছন্দনীয় নয়। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, আফা তু’মিনুনা বিবা’দ্বিল কিতাবে ওয়া তাকফুরুনা বিবা’দ” অর্থাৎ তোমরা কি আমার বিধান গ্রন্থের কিছু অংশ বিশ্বাস করো আর কিছু অংশ অবিশ্বাস করো? সুতরাং মুসলমান কিছুতেই ইসলামকে খ-িতভাবে পালনে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। বিশেষ করে যেখানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং নিজেরাই আইনপ্রণেতা এবং শাসন-প্রশাসনের কর্মকর্তা, সেখানে তাদের বিশেষভাবে সচেষ্ট হওয়া উচিত, যেন ইসলাম ও নবী জীবনের পরিপূর্ণভাবে অনুসারি হতে পারে। বলাবাহুল্য, পবিত্র নবী দিবসে যদি এ দেশের ওপর ক্ষমতাসীন, ক্ষমতাহীন সকল স্তরের মানুষ মহানবীর আদর্শে ও মূল্যবোধে নিজেদের ব্যক্তি ও সমাজ কাঠামো গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে, তাহলে অতি স্বল্প সময়েই আমরা নিজেদের দেশ ও সমাজকে শোষণমুক্ত আদর্শ সমাজে পরিণত করতে সক্ষম হবো।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন