শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৪

গণতন্ত্রের অন্তিমযাত্রা ঠেকাতে হবেই


বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ১৫৩ জন এমপি। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়া আর ভোটছাড়া নির্বাচিত হওয়া কখনই এক হয় না। হতে পারে না। অনেকে ভোটছাড়া নির্বাচিতদের এমপি হিসেবে মানতে নারাজ। ‘নির্বাচিত’ এমনও বলতে চান না তারা। নির্বাচনই যেখানে হয়নি, সেখানে নির্বাচিত কিভাবে হবেন? তাই অনেকে নির্বাচন ছাড়া নির্বাচিতদের ‘মনোনীত’ বলেই অভিহিত করছেন। এমনটাই যৌক্তিক বলে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজেরও ধারণা। বাকি যারা তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন তারা যেমন স্বস্তিতে নেই, তেমনই জনগণও মনে করেন না তারা আসলেই নির্বাচিত। অদ্ভুত এবং অকল্পনীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তারা জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে শপথগ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে তাদের অনেকে মন্ত্রী হিসেবেও শপথবাক্য পাঠ করেছেন আনুষ্ঠানিকভাবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা নিজেরাও সেদিন প্রত্যক্ষ করেছেন ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা ভোট দিতে যাননি। ভোট কেন্দ্রগুলো প্রায় সারাদিন ছিল ভোটারবিহীন। ভোটগ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ভোটকেন্দ্রে বসে বসে খোশগল্পে মেতে ছিলেন। কেউ কেউ ঝিমাচ্ছিলেন। অনেক ভোটকেন্দ্রে ভোট পড়েছে দু-তিনটা করে। এছাড়া বহু কেন্দ্রে একটিও ভোট পড়েনি এমন নজির স্থাপিত হয়েছে সেদিন। বিএনপিসহ অনেকের তরফ থেকে বলা হয়েছে ভোট পড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। কারুর কারুর মতে এর হার আরেকটু বেশি। তবে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের দেয়া এ তথ্য অনেকেই মানতে নারাজ। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা অবধি ভোটকেন্দ্রগুলো যেখানে ছিল প্রায় ভোটারশূন্য, সেখানে ৪০ শতাংশ ভোট ব্যালট বাক্সে ঢুকলো কোন দিক থেকে এবং কিভাবে তা কেবল নির্বাচন কমিশনই জানে। অনেকে মনে করছেন নির্বাচন সম্পর্কে জনগণের সঙ্গে কমিশনের এটা এক ধরনের মশকরা বৈ কিছু নয়।
আমরা মনে করি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ও প্রহসনের মাধ্যমে প্রধান বিরোধী জোটকে বাইরে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দেশে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়েছে। নির্বাচন যে সুষ্ঠু, স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য হয়নি তা মহাজোটের নেতারাও মনে করেন। এ জন্য তারা এ নির্বাচনকে ‘নিয়ম রক্ষার’, ‘সাংবিধানিক’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করেছেন দ্বিধাহীনভাবে। নির্বাচনের করুণ অবস্থা লক্ষ্য করে নির্বাচিতদের অনেকের মধ্যেই তেমন ‘উৎসাহ’ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেশ উৎফুল্লই মনে হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি যেভাবে উল্লসিত ও হরষিত ছিলেন তা অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অবশ্য বিরোধী জোটের এত আন্দোলন, অবরোধ ও হরতালের মধ্যে শেষমেশ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনে সক্ষম হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। বিরোধী জোট যেখানে নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল, সেখানে যে করেই হোক নির্বাচন একটা তো হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ, প্রহসনের, অগ্রহণযোগ্য, তামাশার প্রভৃতি অভিধায় অভিহিত করলেও নির্বাচন থেমে থাকেনি। ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন সত্যি সত্যি ‘সুষ্ঠুভাবেই’ নির্বাচনটি পার করতে পেরেছে। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে ‘ধন্যবাদ’ না জানিয়ে আর কি পারা যায়? তবে এতে যে গণতন্ত্রের অন্তিমযাত্রা সম্পন্ন হয়েছে সে কথা আর না বলাই ভালো। দেশের ৫২ শতাংশ মানুষকে ভোটাধিকার বঞ্চিত করে এবং বাকিদের মাত্র ৫ থেকে ১০ বা ১৫ শতাংশ ভোটে যারা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেন তারা প্রকৃত অর্থেই ভাগ্যবান এবং ‘কপালি’। কপালি শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাই নন, মহাজোটের অনেকেই। এমনকি জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদও কিন্তু কম ‘কপালি’ নন। নানা নাটক ও সিনেমা দেখালেও জাতীয় পার্টির যে কপাল খুলে গেছে, তা আসলে বলতেই হবে। তবে এতে গণতন্ত্রের বারোটা বেজেছে কি না তা দেশ-বিদেশের অনেকের কাছেই স্পষ্ট।
বিনাভোটে এবং ইতিহাসের সবচাইতে কম ভোটে নির্বাচিতরা যখন জনমতকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সরকার গঠন করেন এবং ক্ষমতার মসনদ দখলের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন তখন গণতন্ত্রের জন্য করুণা হয় বৈকি। এ অন্তিমযাত্রার গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে এবং এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে ১৮ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তা অবিলম্বে বিবেচনায় আনতে হবে বৈকি। অন্যথায় গণতন্ত্রের অন্তিমযাত্রা ঠেকানো যাবে না কোনক্রমেই। যারা দেশপ্রেমিক এবং গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি মনে করেন তাদের এখন তামাশা দেখা বা বসার সময় নয়, কাজ করার সময়। এ প্রেক্ষিতে দেশ ও জাতির স্বার্থে সকলকে এগিয়ে আসার জন্য আমরা সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads