সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার অজুহাত
দেখিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন
করতে অনড় থাকেন। বিরোধী দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে তিনি আহ্বান
জানান। অন্য দিকে বিরোধী দলবিহীন পাতানো নির্বাচন হলে দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি, জনগণের মৌলিক অধিকার, স্বাধীন মতপ্রকাশ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যাহত ও অবনতির কথা বিবেচনা করে জাতিসঙ্ঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসহ বিশ্বের প্রায় সব মহল থেকেই বিরোধী
দলের সাথে সংলাপ, আলোচনা ও সমঝোতার তাগিদ দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসঙ্ঘের
মহাসচিব বান কি মুনসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ লাল ফোনে কথা বলেন এবং বার্তা পাঠান। জাতিসঙ্ঘে
সহকারী মহাসচিব অস্কার ফারান্দেজ তারানকোর উপস্থিতিতে কয়েক দফা এবং তার ঢাকা ত্যাগের
পর সম্ভবত আরো দুই দফা সরকারবিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ হলেও কোনো ফলাফল ছাড়াই আলোচনা
থেমে যায়। সংলাপের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে।
নিরপেক্ষ, নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় বিরোধী দল নির্বাচন
বর্জন করে।
বিরোধী
দল নির্বাচন বয়কট করাতে সরকার তার মিত্রদের সাথে সমঝোতা করে ১৫৩ জন প্রার্থীকে জনগণের
সরাসরি ভোট ছাড়াই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন কমিশন বিজয়ী ঘোষণা করে দেয়। ১৫৩ জন
এমপি সিলেকটেড ঘোষিত হওয়ার পরে বিরোধী দলের সাথে সংলাপটি ছিল অর্থহীন। স্বাভাবিক কারণেই
সংলাপ মাঝপথেই থেমে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশিষ্ট জনের মতে, সরকার দশম জাতীয় সংসদে বিএনপি ১৮ দলের জোট আওয়ামী লীগের ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ
হলে ২০টির বেশি আসন প্রাপ্তি মহাজোটের পক্ষে অসম্ভব ছিল। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা অভ্যন্তরীণ
জরিপে নিশ্চিত হয়ে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে আলোচনা বা সংলাপের
নামে সময় ক্ষেপণই ছিল মূল লক্ষ্য। ফলে দেশবাসীকে ৫ জানুয়ারি একটি তামাশার নির্বাচনের
মুখোমুখি হতে হলো। রাজনীতির ইতিহাসে যা নজিরবিহীন নির্বাচন হিসেবে ১৬ কোটি মানুষের
কপালে কলঙ্কের তিলক পরিয়ে দিয়েছে। ১৯৮২ থেকে ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত জনগণের
ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনা দীর্ঘ আন্দোলন করেছিলেন স্বৈরাচার এরশাদের
বিরুদ্ধে। ভোট জালিয়াতি, কারচুপি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, পরাজিত প্রার্থীকে বিশেষ ব্যবস্থায় বিজয়ী ঘোষণা দেয়া, জোর করে প্রশাসনকে ব্যবহার করে ভয় দেখিয়ে, মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে
প্রার্থীদের নিবৃত্ত করতে এমন হেন অনৈতিক কাজ নেই যা স্বৈরাচার এরশাদ করেননি। গণতন্ত্র
ও নির্বাচনকে তিনি নিজের মর্জিমাফিক ব্যবহার করতেন। দুই নেত্রীর অসীম সাহসে রাজপথের
কঠোর আন্দোলনে এরশাদের পতন হয়েছিল নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। দেশবাসী স্বস্তির
নিঃশ্বাস ফেলেছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পেরে। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর শেখ হাসিনার অধীনে
৫ জানুয়ারির নির্বাচন আবারো সেই অতীতের ভয়াবহ নির্বাচনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে
দিলো।
নির্বাচনের
দিনটিতে যারা সারা দিন টিভি সেটের সামনে বসে স্যাটেলাইট চ্যানেলে বিভিন্ন জেলার ভোট
কেন্দ্রগুলোর লাইভ নিউজ দেখেছেন, ইন্টারনেট ও অনলাইন সংবাদপত্রে চোখ বুলিয়েছেন, ভোটগ্রহণ শেষে ফলাফল শুনে বিজয়ী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের হার দেখে আমার মতোই
তারা বিস্মিত। এটি কিভাবে সম্ভব? নির্বাচনের আগে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলেছিলেন, আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নের এই যুগে বাংলাদেশে ভোট কারচুপি, কেন্দ্রে সিলমারা, ফলাফল বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। ৫ জানুয়ারি নির্বাচন-পরবর্তী
ফলাফল প্রকাশ হতে থাকলে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম ১০ শতাংশ প্রাপ্ত ভোট মুহূর্তে ৪০
থেকে ৭০ শতাংশে পরিণত হলো। বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে তোফায়েল আহমেদ ও এইচ টি ইমাম অল্প
ভোট পড়ায় হতাশা প্রকাশ করলেও প্রিজাইডিং অফিসার কর্তৃক প্রকাশিত প্রাপ্ত ভোটের হারের
ভৌতিক বৃদ্ধির কোনো কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি উল্লিখিত আওয়ামী লীগ
নেতাদ্বয়। নির্বাচন কমিশন দীর্ঘ দুই দিন নীরব থাকার পর প্রথমে তারা ৩৭ শতাংশ ভোট পড়ার
কথা বললেও পরদিন ৪০ দশমিক ৫৮ শতাংশ ভোট পড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করলেন। দেশের একজন নাগরিক
হিসেবে আমার প্রশ্ন কোনটি আমরা বিশ্বাস করব? সারা দিন গণমাধ্যমে যা দেখলাম, পরদিন সব জাতীয় দৈনিকে ভোটের
যেসব তথ্য প্রকাশিত হয় সেটি, প্রিজাইডিং অফিসার প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে
তাদের প্রাপ্ত ভোটের যে তথ্য দিলেন সেগুলো, নাকি নির্বাচন কমিশনের দুই দিনের
৩৭ শতাংশ না ৪০ শতাংশ ভোট পাওয়ার তথ্য? সারা দিন টিভি সেটের সামনে বসে
কেন্দ্রগুলোতে ভোটারবিহীন খাঁ খাঁ চিত্রের সাথে, সংবাদপত্রের তথ্যের সাথে এত গরমিলের
কারণ হিসেবে সংবাদপত্র ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জালভোট, কেন্দ্র দখলের ছবিসহ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতেই অবশ্য স্পষ্ট হয়েছে ১০
শতাংশ কেমন করে ৭০ শতাংশে উন্নীত হলো।
৫ জানুয়ারি
জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মহাজোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে। জনগণের প্রতি ন্যূনতম আস্থা থাকলে, গণতন্ত্রের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা থাকলেও তারা এ অপকর্মটি করতে সাহস পেত
না। নির্বাচন কমিশনের মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন মেরুদণ্ডহীন সরকারের আজ্ঞা পালনে
‘সুবোধ বালকের’ তুলনা হয় না। আজিজ মার্কা নির্বাচন
কমিশন থেকে রাকিব মার্কা নির্বাচন কমিশনের পাল্লায় পড়েছে জনগণ। বিশ্ব অগ্রসর হচ্ছে
উন্নতির দিকে, আমরা যাচ্ছি ক্রমেই অবনতির দিকে।
যে স্বৈরাচারের
বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জাতি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরে পেয়েছিল, সেই পতিত স্বৈরাচারের একসময়ের সহযোগী ভোটারবিহীন নির্বাচনে রাষ্ট্রের নির্বাহীর
দায়িত্বে বসে আছেন আর পতিত স্বৈরাচার দখল করেছে প্রধান বিরোধী দলের আসনটি, বিতর্কিত ফার্স্ট লেডিকে দেয়া হয়েছে বিরোধীদলীয় নেতার পদটি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার
সংগ্রামের আপসহীন নেত্রীকে আবারো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে নামতে হয়েছে। কী বিচিত্র
আমাদের এ দেশ। স্বৈরাচার ও তার একসময়ের সহযোগী এখন চালকের আসনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার
আন্দোলনের সফল আপসহীন নেত্রী দুর্বৃত্তদের ষড়যন্ত্রের সাথে সমঝোতার পরিবর্তে বেছে নিলেন
চিরাচরিত স্বভাবসুলভ সেই আন্দোলন সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ অমসৃণ পথ। জনগণের ভোটাধিকার
প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তার পাশে আছে জনগণ। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে ‘পুকুরচুরির’ মতো বিজয়ী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ দেখে
আমরা লজ্জিত, এ লজ্জা থেকে উদ্ধার পেতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে শামিল
হতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন