গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়
ভোট দেয়া অন্যতম নাগরিক অধিকার। বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের। প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটার করা, ভোট বা নির্বাচনের ব্যবস্থা ও পরিবেশ সৃষ্টি করা সর্বোপরি ভোটাধিকার প্রয়োগের
নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে
স্বাধীন হলেও আমাদের দেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ। নির্বাচনের পরিবেশ
সৃষ্টি নয়, জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ নয়, বরং সরকারের নির্দেশ পালনকেই
নির্বাচন কমিশন জরুরি মনে করেছে। এ কারণে এরা বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ও জনগণের অংশগ্রহণ
ছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নামের প্রহসন করেছে। আর এ প্রহসনের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির
এক মহোৎসব হয়েছে। এতে ভোটার না হয়েও ভোট দেয়ার অবারিত সুযোগ পাওয়া গেছে। ভোটের হার
বাড়ানোর জন্য মৃত ব্যক্তির ভোটও হয়েছে, শিশুরাও ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছে।
ভোটারদের অনুপস্থিতিতে এ নির্বাচনে অনেক প্রিজাইডিং-পোলিং অফিসার, পুলিশ-আনসারও ভোট দিয়েছেন। এ নির্বাচনে যত খুশি তত ভোট দেয়ার সুযোগও মিলেছে।
অরাজক পরিস্থিতির কারণে এ নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসার, আনসার-পুলিশসহ প্রায় অর্ধশত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আর শতাধিক লোক আহত হয়েছে।
এ ছাড়া নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে অনেক লোক ও ঘরবাড়ি আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও সমর্থকদের হামলা
ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। এতে ঢাকার দোহারে আওয়ামী জোট সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুল
মান্নান খানের লোকেরা জাতীয় পার্টির বিজয়ী প্রার্থী সালমা ইসলামের তিনজন সমর্থককে প্রকাশ্যে
কুপিয়ে হত্যা করেছে। আর যশোরের অভয়নগরে বিজয়ী রণজিৎ রায়ের সমর্থকদের বাড়িঘরে আওয়ামী
লীগ দলের সাবেক হুইপ আব্দুল ওয়াহাবের লোকজন হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে। লালমনিরহাট ও
জামালপুরে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপির নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর
করেছে। এমনিভাবে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এ নির্বাচনী
প্রহসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সূচিত হয়েছে। অধিকন্তু
এর মাধ্যমে সরকারকে ফ্যাসিবাদী হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
দশম জাতীয়
সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার অনেক আগে থেকেই দেশের প্রধান বিরোধী দলসহ দেশের বেশির
ভাগ রাজনৈতিক দল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি করে আসছে।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন জনগণের এ দাবি উপেক্ষা করে দলীয় সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচনের
তফসিল ঘোষণা করে। এতে প্রধান বিরোধী দলসহ দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ঘোষিত তফসিল
স্থগিতের দাবি জানিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ
১৫৩টি আসনে সরকারি দলের প্রার্থীরা (প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়) খালি মাঠে গোল দিয়েছেন।
আর বাকি আসনগুলোতেও শুধু মহাজোট সরকারের নেতাকর্মীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এ কারণে
ভারত-ভুটান ছাড়া আর কোনো দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। তবে
সরকারি প্ররোচণায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এসব বিষয়কে গুরুত্ব
দেননি, তিনি বরং সরকারের সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এতে দেশ-বিদেশে
এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
বেসরকারি
অনেক টিভি চ্যানেল এবারের নির্বাচনী চিত্র সরাসরি প্রচার করেছে। এতে বেশির ভাগ টিভি
চ্যানেল ভোটার সংখ্যা বেশি দেখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্র ভোটারশূন্য
দেখা গেছে। এ জন্য প্রতিবেদক নির্বাচন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে শীতের তীব্রতাকে দায়ী
করেছেন। অধিকন্তু এরা দর্শকদের বেলা বাড়ার সাথে ভোটার বাড়ার আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু
আশ্বাসের ওপর বিশ্বাস করেও কাজ হয়নি শেষে। কারণ দুপুরেও নির্বাচন কেন্দ্রের অবস্থা
অপরিবর্তিত থেকেছে। আর বিকেল ৪টায় বেশির ভাগ কেন্দ্রে ২০-১০০টি ভোট পড়েছে বলে উল্লেখ
করা হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। এ ছাড়া অনেক কেন্দ্রে কোনো ভোটার ভোট দিতেই আসেননি। এটিএন
নিউজ চ্যানেলে বিকেল ৪টার আগমুহূর্তে দেখা গেছে ভোটকেন্দ্রে ভোটার না পেয়ে রাজধানীর
কড়াইলের এক ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিক মুন্নী সাহা ভোটকেন্দ্রের বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের
লিফলেট বিতরণকারী শিশুদের সাথে মজা করছেন। এমনিভাবে সারা দিন বিভিন্ন চ্যানেলের সরাসরি
প্রচারে ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্রের দৃশ্য দেখা গেছে। কিন্তু বিস্মিত হতে হয়েছে রাতে নির্বাচিতদের
প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা দেখে। এ সময় নির্বাচিতদের অনেকেই লক্ষাধিক ভোটে বিজয়ী হয়েছেন
মর্মে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সারা দিন বিভিন্ন চ্যানেলে সরাসরি ভোটকেন্দ্র ও ভোটার উপস্থিতি
দেখে মনে হয়নি গড়ে ৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। ৭ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস কাবের সংবাদ সম্মেলনে
ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা
চৌধুরী দাবি করেছেন এবারের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন (দৈনিক প্রথম
আলো, ৮ জানুয়ারি ২০১৪, বুধবার)। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা
গড়ে ৫-১০ শতাংশের বেশি ভোট হবে না বলে মন্তব্য করেছেন। ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের
(ফেমা) দাবি মতে, ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি মর্মে দাবি করেছে। অথচ নির্বাচনের পরদিন
অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিলেন ৩৯.৮১ শতাংশ ভোট হয়েছে। এর একদিন পর
৭ তারিখে তা আরো ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৪০.৫৬ করেছেন। আর সরকার প্রয়োজন বোধ করলে নির্বাচন
কমিশন এর মাত্রা আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিতেও পারেন। নিশ্চয়ই এর পেছনে কাজী রকিব উদ্দীনের
বিশেষ কেরামতি আছে। আর সে কেরামতি জানা গেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও প্রিজাইডিং-পোলিং
অফিসারদের কাছ থেকে। যেমন বগুড়া-৬ আসনে শাহজাহানপুর উপজেলায় ১২ কেন্দ্রের ভোট গণনা
না করেই প্রিজাইডিং অফিসারদের স্বাক্ষর নিয়ে ভোট গণনার সিট জমা নেয়া হয়েছে; যাতে পরদিন (৬ জানুয়ারি) সহকারী রিটার্নিং অফিস থেকে ইচ্ছা অনুসারে ভোটার সংখ্যা
বসিয়ে দেয়া হয়েছে (দৈনিক প্রথম আলো, ৭ জানুয়ারি ২০১৪, মঙ্গলবার)। এ ছাড়া নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী প্রিজাইডিং-পোলিং অফিসার, পোলিং এজেন্ট ও সংবাদমাধ্যমের একই ধরনের অভিযোগ আছে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনার নির্বাচনী (রংপুর-৬) আসনে। পত্রিকার প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘পীরগঞ্জের ধুলগাড়ি উচ্চবিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার জানিয়েছেন, ওই কেন্দ্রে বেলা ১টা পর্যন্ত ২৩০০ ভোটের মধ্যে মাত্র ৮৫ ভোট পড়েছিল। কিন্তু
বেলা ১টার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রিজাইডিং-পোলিং
অফিসারদের জিম্মি করে নিজেরাই বিপুলসংখ্যক ভোট প্রদান করেছেন। এতে ভোট প্রদানের হার
দাঁড়ায় ৭৭ শতাংশে অর্থাৎ ১৮ শ’য়ের কাছে।’ (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৭ জানুয়ারি ২০১৪, মঙ্গলবার)। রাজশাহী-৩ ও ৪ আসনে জাল ভোট ও রেজাল্টশিট
পরিবর্তন করে ভোটের হার বাড়ানো হয়েছে। ঠাকুরগাঁও-১ আসনে সহকারী রিটার্নিং অফিসে ব্যালটে
সিল মারার অভিযোগ আছে। এ ছাড়া যশোর-২, নীলফামারীর দু’টি আসনেই সহকারী রিটার্নিং অফিসে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ দেয়া হয়েছে (দৈনিক নয়া
দিগন্ত, ৯ জানুয়ারি ২০১৪, বৃহস্পতিবার)। সারা দেশে এভাবেই
ভোটার ছাড়া ভোট পড়েছে এবং ভোট জালিয়াতির মহোৎসব হয়েছে। এসব কারণে পাবনা-১ আসনে স্বরাষ্ট্র
প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইদ, শেরপুর-২ আসনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী কৃষক লীগের কেন্দ্রীয়
নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বাদশা, ঢাকা-১৫ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক
সংসদ সদস্য এখলাস মোল্লাসহ দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী আসনের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও
স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন। এসব সত্ত্বেও প্রধান নির্বাচন
কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীনের কাছে ভোট অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দশম
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। এতে ভোটকেন্দ্রে ভোটার না থাকলেও কমিশন কর্তৃক
অস্বাভাবিক হারে ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয়েছে। এজন্য রসিকতা করে অনেকে বলছেন, ‘কাজীর (রকিবউদ্দীনের) ভোটার কেন্দ্রে ছিল না কমিশনে আছে।’
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন