আলফাজ আনাম
বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন
দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও সরকারের মন্ত্রীরা এখন জোর দিয়ে বলছেন, এই সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। বিরোধী দলের সাথে মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা
বা সংলাপের কোনো প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করেন না। সরকারের সবচেয়ে সিনিয়র মন্ত্রীদের
একজন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ভারত সফরে গিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, অদূরভবিষ্যতে তিনি বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখেন না। তিনি বলেছেনÑ নির্বাচন নয়, বরং আমাদের মাথায় এখন সুশাসনের চিন্তা। নির্বাচনের
আগে তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এই নির্বাচন
করতে হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এমন এক নির্বাচনের মাধ্যমে তারা বিজয়ী হয়েছেন, যার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত
হননি। এমন একটি দুর্বল সরকার নিয়ে তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছেন।
তিনি যদি তাতে সফল হন তাহলে দেশের মানুষের জন্য মঙ্গল; কিন্তু সুশাসনের কথা বলা যত সহজ প্রতিষ্টা তত
সহজ নয়।
অর্থমন্ত্রী
আবুল মাল আবদুল মুহিত আরেকজন প্রবীণ মন্ত্রী। তিনি এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। জীবনের
বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন দেশের বাইরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে; গণতন্ত্রের চর্চা হয় এমন দেশে। এ কারণে হয়তো নির্বাচনের পর বিবেকের তাড়নায়
তিনি বলেছিলেন, এই নির্বাচনে তারা জনগণের ম্যান্ডেট পাননি। ৮ জানুয়ারি তিনি একটি
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেনÑ বিরোধী দল নির্বাচনের বাইরে রইল, এটা একটা বড় দুঃখ। জনগণের ম্যান্ডেট পেলাম না তাই আমরা আবারো নির্বাচন চাচ্ছি।
আশা করছি, এই বছরেই নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দুই সপ্তাহ না যেতেই
এখন তিনি আবার উল্টে গেছেন; বলেছেন, আমরা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকব।
নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর।
নির্বাচনের
পর কোনো দেশের পক্ষ থেকেই বলা হয়নি এই নির্বাচনে দেশের মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে।
সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক ও এবারের নির্বাচনের অন্যতম রূপকার ভারতের পক্ষ থেকেও নির্বাচনকে
গ্রহণযোগ্য বলা হয়নি। নির্বাচনের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর
উদ্দিন বলেছেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এই নির্বাচন করতে হয়েছে।
ভারতকে আমরা এই নির্বাচনের রূপকার বলছি এ কারণে যে নির্বাচনের আগে দেশটির পররাষ্ট্র
সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফরে এসে কোনো প্রকার রাখঢাক না করেই বলেছেন, বেশিসংখ্যক দল নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে। সাংবাদিকেরা তাকে
প্রশ্ন করেছিলেন, প্রধান বিরোধী দল এই নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য
হবে কি না? তার জবাবে তিনি এই উত্তর দিয়েছিলেন। তবে সুজাতার জন্য দুর্ভাগ্য
যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও বেশিসংখ্যক দল এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। মাত্র ১৫টি দল নির্বাচনে
অংশ নিয়েছে। ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ৪১টি দল অংশ নিয়েছিলো। কমসংখ্যক আসুক
আর বেশিসংখ্যক আসুক না কেন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে দিল্লির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েছে।
আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে। দিল্লির আশা পূরণ হলেও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
এখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে
হতাশা বেড়েছে।
নির্বাচনের
পর ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত ৫০টি দেশের কূটনীতিক বৈঠক করেছিলেন নতুন পররাষ্ট্র
প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সাথে। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতেরা পরবর্তী
নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে কি না তা জানতে চেয়েছিলেন। আর মার্কিন
রাষ্ট্রদূত আগামী ছয় মাসের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন হওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করে। ব্রিটেন
ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত স্বচ্ছ অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য বিরোধী
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দ্রুত আলোচনা শুরু করার কথা বলেন। এরপর থেকে পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতেরা
প্রতিদিন কোনো না কোনো মন্ত্রীর সাথে দেখা করে বিরোধী দলের সাথে সংলাপ ও দ্রুত আরেকটি
নির্বাচনের জন্য তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। সরকারকে এরা স্পষ্ট করে বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়
১৫৩ জন নির্বাচিত হওয়ায় অর্ধেকের বেশি মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। বাকি যে
আসনগুলোতে ভোট হয়েছে তাতে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। স্বাভাবিকভাবেই এমন নির্বাচন
গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে সব দেশের কূটনীতিক যখন
এই নির্বাচন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তখন সেখানে ব্যতিক্রম ছিলেন একটি দেশের রাষ্ট্রদূত।
ভারত বা ভুটান নয়, দেশটি হচ্ছে মিসর। বাংলাদেশে নিযুক্ত মিসরের রাষ্ট্রদূত মাহমুদ
ইজ্জাত পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের সময় বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল ভেরি বিউটিফুল। তিনি আরো বলেন, তার দেশ এই নির্বাচনে ভেরি হ্যাপি। (দেখুন ডেইলি স্টার ১৭ জানুয়ারি)।
বিশ্বের
প্রায় সব দেশ যখন এই নির্বাচন নিয়ে খুশি হতে পারেননি তখন মিসর এত খুশি কেন? কারণ ভোটার ছাড়া নির্বাচনের এমন কৌশলে মিসরের সেনা শাসকেরা নতুন একজন সাথী
খুঁজে পেয়েছেন। বাংলাদেশে নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর মিসরে নতুন সংবিধানের ওপর গণভোট
হয়েছে। ১৪ জানুয়ারির এই নির্বাচনে যারা ভোট দিয়েছেন তাদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ সেনাসমর্থিত
সরকারের প্রণীত সংবিধানের পক্ষে হ্যাঁ-ভোট দিয়েছে। বিশ্বের আর কোনো নির্বাচনে প্রাপ্ত
ভোটের ৯৮ শতাংশ একপক্ষে ভোট দেয়, এমন নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন। মিসরের এই গণভোটে নাকি
ভোটার উপস্থিতি ছিল ৩৮ শতাংশ। অপর দিকে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন বলেছে, ৩৯ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে গিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন
দলের প্রার্থীরাই শুধু বিজয়ী হয়েছে। যদিও বিরোধী দল বলেছে, ৫ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দিতে যাননি। দেশী পর্যবেক্ষকেরা বলেছেন, ১০ শতাংশের বেশি নয়। আবার বিদেশী গণমাধ্যমগুলো বলেছে, ২০ শতাংশের কাছাকাছি লোক এই ভোটে অংশ নিয়েছেন। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এত কমসংখ্যক
প্রার্থী ও রাজনৈতিক দল আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এ ছাড়া ৪৩টি ভোটকেন্দ্রে একজনও
ভোট দেননি। আর ভোটের আগেই ভোট ছাড়া নির্বাচিত হয়েছেন ১৫৩ জন। এমন নির্বাচনও বিশ্বে
আরো ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাথে মিসরের
গণভোটের যথেষ্ট মিল রয়েছে। বিউটিফুল নির্বাচন বটে!
মিসরের
সেনাবাহিনীপ্রধান দেশটির প্রথম নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে নিজের ইচ্ছেমতো এক সংবিধান
প্রণয়ন করে তার পক্ষে সমর্থনের জন্য ভোটের আয়োজন করেছেন। জেনারেলরা ক্ষমতাগ্রহণের পর
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের সাথে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা মিসর সফর করেছেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং সরকারের ঘনিষ্ঠ নির্মূল
কমিটির নেতারা মিসর সফর করেন। রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনপীড়নে মিসর এখন বিশ্বের এক
নম্বরে উঠে এসেছে। মিসরে সেনাশাসন পাকাপোক্ত করতে নির্মূলের রাজনীতি চলছে। সেনাবিরোধী
বিক্ষোভে এক রাতে দুই হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশে নির্মূলের
রাজনীতির প্রবক্তারা বলছেন, লাখখানেক মানুষকে মেরে ফেললে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা
করা সম্ভব। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটছে তাতে
মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। বিরোধী নেতাকর্মীদের যেখানে-সেখানে লাশ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশও
এই নিপীড়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। নির্বাচনের পর বর্তমান সরকারকে এখন পর্যন্ত কোনো
আরব দেশ অভিনন্দন না জানালেও মিসরের সেনাশাসকদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন এসেছে। অবশ্য এর
আগে উত্তর কোরিয়া থেকে অভিনন্দন আসে।
মিসরের
সেনাশাসকেরা কত দিন ক্ষমতায় থাকবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নতুন সংবিধানের বলে সেনাপ্রধান
জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসির আর প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে কোনো বাধা থাকবে না। তার
পূর্বসূরি হোসনি মোবারক ক্ষমতায় ছিলেন ২৯ বছর। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরাও কত দিন ক্ষমতায়
থাকবেন তা-ও এখন অনিশ্চিত। বলতেই হবে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা জেনারেল
সিসির চেয়েও যথেষ্ট কৌশলী। সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন
করে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছেন। এখন মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়টি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে
মন্ত্রীদের কেউ ২০২১ সাল পর্যন্ত আবার কেউ ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার কথা বলছেন।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন অনেক নেতার মনে হয়তো এখন উঁকিঝুঁকি মারছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো দীর্ঘমেয়াদি দেশ শাসনের স্বপ্ন; কিন্তু মুশকিল হবে বাণিজ্যমন্ত্রীর সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে। এসব দেশে যারা দীর্ঘমেয়াদে
ক্ষমতায় ছিলেন তারা শুধু উন্নয়নকাজ করেননি, সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক
ধরনের কল্যাণমূলক শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। এ জন্য প্রথমেই তারা দেশের মানুষের
মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দেশকে নানাভাগে
বিভক্ত করে ফেলছেন। নির্মূলের রাজনীতির প্রবক্তারা যদি সরকারের প্রধান বুদ্ধিদাতা হয়, তাহলে এই বিভেদ ও বিভাজন দেশকে আরো রক্তাক্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
কারণ দমনপীড়ন বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বিরোধী রাজনীতি নিঃশেষ করা যায়
না। এ জন্য দরকার শক্ত আদর্শিক ভিত্তি ও সুশাসন। তা যদি করতে না পারেন তাহলে তাদের
ক্ষমতায় থাকার জন্য হয়তো জেনারেল আল সিসির পথ অনুসরণ করতে হবে। বিদ্যমান সংবিধান রক্ষার
জন্য যেভাবে নির্বাচনের আয়োজন করা হলো তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আরো বেশি সময় ক্ষমতায়
থাকা সম্ভব। শুধু এ দেশের মানুষকে ভোট না দিয়ে আরো কয়েকটি বিউটিফুল ইলেকশন দেখতে হবে।
গণতন্ত্রকে স্থায়ীভাবে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। নীলনদের দেশে আল সিসির পক্ষে যা সম্ভব, শত নদীর জোয়ার-ভাটার এ দেশে তা কি সম্ভব? ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। যদিও
সরকারের এক মাসের কর্মকাণ্ডে সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া নয়, মিসরের ছায়া আমরা দেখছি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন