বছরের শুরুতে, ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং প্রবীণ সাংবাদিক-কূটনীতিক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মাহবুবুল আলমের বক্তব্য শুনছিলাম। স্বাভাবিক আগ্রহে শুধু নয়, রাত জেগে শোনার বিশেষ একটি কারণও ছিল। সেটা প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু কথাবার্তা যেগুলোর মাধ্যমে তিনি দেশের ‘বিশিষ্টজন’দের ঘায়েল ও তুলোধুনো করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আক্রান্ত ‘বিশিষ্টজন’দের তালিকায় রয়েছেন বলেই ব্যারিস্টার মইনুল ও মাহবুবুল আলমের বক্তব্য শুনতে বসেছিলাম। ধারণা ছিল, তারা নিশ্চয়ই কষেই প্রধানমন্ত্রীকে জবাব দেবেন। দিয়েছেনও। কিন্তু ওই যে, জ্ঞানী ও মূর্খ বা স্বল্প শিক্ষিতদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে বলেও তো একটা কথা আছে! সে কথাটাকেই আবারও সত্য প্রমাণ করেছেন ব্যারিস্টার মইনুল ও মাহবুবুল আলম। জবাব দু’জনে ঠিকই দিয়েছেন কিন্তু কিছুটা এদিক-সেদিক করে। যেমন ‘প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই’ ব্যারিস্টার মইনুল বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে সমস্যা চলছে তার সমাধান দেয়ার মতো অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, ট্রেনিং কিছুই তার নেই। ‘আইনের মানুষ’ বলেই ব্যারিস্টার মইনুল অবশ্য শেখ হাসিনার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়াকেও টেনে এনেছেন। বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক দুর্ঘটনার ফলে আমরা যে নেতৃত্ব পেয়েছি...’। অর্থাৎ শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার দলের নেতৃত্বে ও ক্ষমতায় আসাটা দেশ ও জনগণের জন্য ‘ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা’! এ পর্যন্ত এসেও শেষ করেননি ব্যারিস্টার মইনুল। তার মতে প্রধানমন্ত্রীর দরকার ‘শিক্ষিত সচেতন’ ব্যক্তিদের পরামর্শ নেয়া। কিন্তু চাটুকার ও দুর্নীতিবাজরা তাকে ঘেরাও করে রেখেছে। এজন্যই ‘বঙ্গবন্ধুর’ কন্যা হিসেবে রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমি থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে বলা সম্ভব হয়েছে যে, ‘আমি এক ইঞ্চিও নড়বো না’ (বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি ‘এক চুল’ও নড়বেন না)। অথচ ব্যারিস্টার মইনুলের মতে এটা তিনি বলতে পারেন না। কারণ, দেশ কারো সম্পত্তি নয়। দেশের স্বার্থে এক ইঞ্চি কেন, আরো বেশিও নড়তে হতে পারে।
ব্যারিস্টার মইনুল প্রসঙ্গক্রমে ‘দুর্ভাগ্যের’ কথা জানিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে যারা আছে তারাই সরকার চালাচ্ছে, কমিশন ভাগাভাগি করছে। সম্ভবত এইচ টি ইমামের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, কারো কারো কথা শুনে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী কে তিনি, না শেখ হাসিনা? তারাই ‘সব ঠিক আছে’ বলছেন, ঘোষণা দিচ্ছেন ‘কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’। ব্যারিস্টার মইনুল জানতে চেয়েছেন, কার বিরুদ্ধে কঠোর হবেনÑ এটা কি পাকিস্তান? ‘ওনারা বলেন, দেশ পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে’ সঞ্চালকের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, লড়াইটা সেখানেই। বাংলাদেশ কখনো পাকিস্তান যেমন হবে না তেমনি ভারতের কোনো রাজ্যও হবে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের একটা চেতনা নিয়ে এসেছে। তৈরি করেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি। মুক্তিযুদ্ধ তো সবাই মিলে করেছি। যারা ভারতে (কোলকাতায়) গেছে তারাই শুধু মুক্তিযুদ্ধ করেছিল? মারা গেলাম আমরা এখন তারা হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা! ব্যারিস্টার মইনুলের অভিমত, এটা আসলে সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধ বাধানোর একটা ফন্দি। তিনি প্রশ্ন করেছেন, তারা (মুক্তিযুদ্ধের চেতনাওয়ালারা) দেশকে রক্ষা করতে পারবে নাকি? দেশকে তো রক্ষা করবে জনগণ। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছেন, এই স্লোগানটা তিনি বোঝেন না। তার জিজ্ঞাসা, এটা কোন দেশের স্লোগান? কারণ, আমার দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। আপনি ‘জয় বাংলাদেশ’ বলুন। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটা বলেছি আমরা পাকিস্তানের বিরোধী অবস্থান থেকে। এখন তো বাংলাদেশ হয়ে গেছে। এভাবে আসলে চালাকি করা হচ্ছে। ব্যারিস্টার মইনুল বলিষ্ঠতার সঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশ মুসলিম কান্ট্রি, মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, ক’দিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বললেন, ‘এটা (বাংলাদেশ) আমাদের অঞ্চল, এ অঞ্চলের ভালোমন্দ আমরাই ভালো বুিঝ’ তখন কোথায় থাকে (বা ছিল) মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? আজ কথায় কথায় জামায়াতে ইসলামীর ভয় দেখানো হচ্ছে, পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে। এভাবে দেশকে আসলে সিভিল ওয়ারের দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন তারা।
চলমান রাজনৈতিক সংকট প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মইনুল বলেছেন, এতদিন পর এভাবে নির্বাচন নিয়ে সংকট হওযা উচিত ছিল না। তার জিজ্ঞাসা, এটা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের কেন যুদ্ধ-সংঘাত হবে? এজন্য কেন এত মানুষকে প্রাণ হারাতে হবে? সকলের কাছে গ্রহণীয় নির্বাচনকালীন সরকারের নাম কি হবে তত্ত্বাবধায়ক নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটা নিয়ে তো যুদ্ধ করার কিছু নেই। এজন্য যে দেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে, দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, ব্যবসায়ীরা হাহাকার করছেন এসবই অত্যন্ত দুঃখজনক। ব্যারিস্টার মইনুলের জিজ্ঞাসা ছিল, একটা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটা জাতি কেন এতটা অসহায় হয়ে পড়বে? প্রশ্নের উত্তরও নিজেই দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, সরকার যেমন নির্বাচিত, বিরোধী দলও তেমনি নির্বাচিত। সেই হিসেবে সরকারের দায়িত্ব জনগণ যাতে স্বাধীনভাবে, ভয়ভীতিমুক্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কথাটার মধ্য দিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল আসলে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছেন।
একই তাগিদ দিয়ে একই ধরনের কিছু কথা বলেছেন মাহবুবুল আলমও। তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ লোকের অভাব নেই। সবাই মিলেমিশে একটা সমাধান বের করা সম্ভব এবং সেটা করতেই হবে। ব্রিটেনের উদাহরণ দিয়ে মাহবুবুল আলম বলেছেন, সেখানে বিরোধী দলও সরকারের একটি ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশেও বিরোধী দল যাতে দায়িত্ব পালন করতে পারে এবং তারাও যাতে দায়িত্ব পালন করে সে ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষিণ অফ্রিকার উদাহরণ উল্লেখ করে মাহবুবুল আলম বলেছেন, দীর্ঘ ২৭ বছর জেলে কাটানো সত্ত্বেও নেলসন ম্যান্ডেলা শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে সমঝোতায় এসেছিলেন। তাদের এমনকি ক্ষমতায় অংশীদার বানিয়েছিলেন, মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন। এর পেছনে ছিল আপস ও সমঝোতার মনোভাব। এটাই গণতন্ত্রের কথা। কিন্তু জনগণের নির্বাচিত বিরোধী দলের নেত্রী যদি অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকেন তাহলে গণতন্ত্রের চর্চা বাধাগ্রস্ত হবেই। ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, এক মন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনের পর আরো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আরেক মন্ত্রী বলেছেন, দশম সংসদের নির্বাচন হয়ে গেলে আরেকটা নির্বাচন করা হবে যদি বিরোধী দল খুশি হয়। এ পর্যন্ত এসেই রাজনীতিবিদদের ‘ট্রেনিং দরকার’ বলে মন্তব্য করেছেন মাহবুবুল আলম। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে বলেছেন, ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত জিজ্ঞাসার জবাবে পাকিস্তানের একজন সিনিয়র বিচারপতি তাকে বলেছিলেন, রাজনীতি কোনো বিমান নয় যে, এয়ারপোর্টে গিয়ে একটি বিমানে উঠলেই কেউ রাজনীতিবিদ হয়ে যাবেন!
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনও কিন্তু এ কথাটাই কিছুটা ঘুরিয়ে বলেছেন, আমরা যে নেতৃত্ব পেয়েছি সেটা পেয়েছি ‘ঐতিহাসিক দুর্ঘটনার ফলে’। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে সমস্যা চলছে তার সমাধান দেয়ার মতো অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, ট্রেনিং কিছুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেই। তিনি অবশ্য শেখ হাসিনার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়াকেও টেনে এনেছেন। উল্লেখ্য, টকশো’র মূল কথায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং মাহবুবুল আলম দু’জনই বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য চর্চা ও সহনশীলতার কথা বলেছেন। এই বলে আশাও প্রকাশ করেছেন যে, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে দেশে এখনো শান্তি আনা যায়। ঠিক বর্তমান সময়ে এসেই তারা কেন কথাগুলো বলেছেন তার কারণ জানার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষও জানে, প্রধানমন্ত্রী কোনো বিষয় নিয়ে একবার বলা শুরু করলে সহজে থামার নাম করেন না। ১/১১ এবং ক্ষমতা দখলের কল্পিত ষড়যন্ত্রও তেমন একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি তার কল্পিত ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য রেখে চলেছেন। বলে বেড়াছেন, ১/১১-এর ‘কুশীলবরা’ নাকি আবারও তৎপর হয়ে উঠেছেন। নির্বাচন বন্ধ করার জন্য তারা শুধু ষড়যন্ত্রই করছেন না, অনেক কলাকৌশলও খাটাচ্ছেন। বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী ২০০৭ সালের কিছু তথ্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কারা ‘কিংস পার্টি’, ‘কুইনস পার্টি’ প্রভৃতি গঠন করে ১/১১ ঘটিয়েছিলেন, ইশারা-ইঙ্গিতে তাদের নাম-পরিচিতি জানাতে গিয়ে যথেষ্ট ব্যঙ্গাত্মকভাবে বলেছেন, তারা নিজেদের ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ হিসেবে দাবি করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফর্মুলা দেন। গণতন্ত্র থাকলে তাদের এক কানাকড়িরও মূল্য থাকে না এবং অসাংবিধানিক কিছু ঘটলে তাদের মূল্য বেড়ে যায় বলে এবারও তারা তৎপর হয়ে উঠেছেন। এ ধরনের ‘বিশিষ্ট নাগরিক’দের সমন্বয়ে গঠিত কোনো অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়। গণতন্ত্রকেও তারা নির্বাসনে পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর মতে সেজন্যই সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। অন্য একটি গুরুতর অভিযোগও হাজির করেছেন শেখ হাসিনা। বলেছেন, বর্তমান সময়ে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরও নাকি একই ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়েছে! তাদের উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার বানচাল করা। বিএনপি কেন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না তার কারণ জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে নির্বাচনে নিষিদ্ধ করেছে। জামায়াতের দুঃখেই নাকি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত রয়েছে!
ক্ষমতায় আছেন এবং বিরোধী দল বর্জন করায় একেবারে ‘ফাঁকা মাঠ’ পেয়ে গেছেন বলে মুখে যা আসছে তা-ই বলতে পারলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু সত্যের ধারেকাছেও যাননি। সহজবোধ্য কারণে তেমন ইচ্ছাও তার থাকার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘বিশিষ্টজন’ ও ১/১১-এর ‘কুশীলব’দের কথাই ধরা যাক। তিনি ঠিক কোন ‘বিশিষ্টজনদের’ দিকে আঙুল তুলেছেন সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত বলার দরকার পড়ে না। এখানে বরং সর্বশেষ একটি কারণ বা উপলক্ষের কথা বলা যাক। ক’দিন আগে চারটি সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত যে মতবিনিময় সভার আলোচকদের প্রধানমন্ত্রী তুলোধুনো করেছেন তাদের কেউই কিন্তু নির্বাচন বানচাল বা অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ওকালতি করেননি (ওই সভায় ব্যারিস্টার মইনুল ও মাহবুবুল আলমও ছিলেন)। তারা বরং সংবিধানের আলোকেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করে ২৪ জানুয়ারির পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে দশম সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছেন। উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জানিয়েছেন তারা। বলেছেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো যেহেতু অংশ নিচ্ছে না সেহেতু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন একদিকে দেশ-বিদেশের কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে না, অন্যদিকে রাজনৈতিক সংকটই কেবল মারাত্মক হয়ে উঠবে না, একই সঙ্গে নতুন নির্বাচনের দাবিও উঠতে থাকবে। পরিস্থিতি এমন হবে যখন স্বল্প সময়ের মধ্যে সরকারকেও নতুন নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে হবে। এর ফলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা যেমন বাধাগ্রস্ত হবে তেমনি রাষ্ট্রের বিপুল অর্থেরও অপচয় ঘটবে। মূলত এ দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘বিশিষ্টজনেরা’ নির্বাচন স্থগিত করার এবং বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে নতুন একটি তফসিল তৈরি করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেড়-দু’মাসের জন্য ছুটিতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে বিরোধী দল নির্বাচনে না আসার আর কোনো অজুহাত দেখাতে না পারে। কথাগুলোর ও পরামর্শের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানোর বা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শুধু ক্ষিপ্তই হয়ে ওঠেননি, ব্যঙ্গ-তামাশার মধ্য দিয়ে বিশিষ্টজনদের ১/১১-এর কুশীলবও বানিয়ে ছেড়েছেন!
এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রীর কথার পিঠে কথাও উঠেছে সঙ্গত কিছু কারণে। শেখ হাসিনা যা-ই বোঝাতে চান না কেন, এই সত্য কিন্তু প্রাথমিক দিনগুলোতেই প্রমাণিত হয়েছিল যে, আজ তিনি যাদের ‘কুশীলব’ বলে ব্যঙ্গ করছেন এবং যাদের ওপর ১/১১ ঘটানোসহ অসাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানোর দায় চাপাতে চাচ্ছেন, তাদের বদৌলতেই তিনি ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। ১/১১-এর মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকারীদের ঠিক কোন নেতা-নেত্রীরা গর্বের সঙ্গে নিজেদের ‘আন্দোলনের ফসল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন সে কথাও তো প্রধানমন্ত্রীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়! এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার পরিবর্তে একটি তথ্যের উল্লেখই যথেষ্ট হওয়া উচিত। সে তথ্যটি হলো, যাদের সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী চিৎকার করে বেড়াচ্ছেন সেই ১/১১-এর কোনো একজন নায়ক বা কুশীলবের বিরুদ্ধেও কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নায়ক ও কুশীলবদের সবাই শুধু আরাম-আয়েশে জীবনই যাপন করছেন না, কয়েকজন এখনো দেশে-বিদেশে সরকারি চাকরিতেও বহাল রয়েছেন। সময়ে সময়ে তাদের পদোন্নতিও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং এমন বোঝাতে চাওয়াটা মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যে, প্রধানমন্ত্রী আসলেও ১/১১-এর কথিত নায়ক ও কুশীলবদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য তিনি দীওয়ানা হয়ে উঠেছেন। নির্বাচন-পূর্ব বিভিন্ন জরিপ ও জনমতের পরিপ্রেক্ষিতে বরং এ অনুমানই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বিশেষ করে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিত এবং জামায়াতে ইসলামীকে যদি নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা না করা হতো তাহলে নৌকার তথা আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঠেকানো অসম্ভব হয়ে উঠতো। প্রধানমন্ত্রী আসলে নিশ্চিত সে ভরাডুবি ঠেকানোর এবং আবারও ক্ষমতায় আসার কৌশল হিসেবেই বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনও আপিলের সুযোগ না দিয়েই জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। এটাই সঠিক বিশ্লেষণ, তথ্যনিষ্ঠ ব্যাখ্যাও। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর উচিত সত্য স্বীকার করে নেয়া এবং মিথ্যাচার বন্ধ করা। বিএনপি ও জামায়াতসহ দেশের বিশিষ্টজনদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার সময়ও তার উচিত জিহ্বা সামাল দেয়া। শেখ হাসিনা সম্পর্কে যারা জানেন তারা অবশ্য কথাটা শুনে মোটেও আশান্বিত হবেন না। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, তিনি কোনো বিষয় নিয়ে একবার বলা শুরু করলে সহজে থামার নাম করেন না। একেবারে ‘ফাঁকা মাঠ’ পেয়ে যাওয়ায় এবং র্যাব, পুলিশ ও বিজিবিকে দিয়ে বিএনপিকে ‘ঠা-া’ করতে পারায় এখন তো বরং গলার স্বর তার ক্রমশ আরো চড়তে থাকবে। তা সত্ত্বেও বলা দরকার, প্রধানমন্ত্রী চাইলেই কিন্তু সবাইকে একইভাবে ‘ঠা-া’ করতে পারবেন নাÑ যেমনটি পারেননি তিনি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং মাহবুবুল আলমকে। কথার পিঠে কথা বরং বাড়তেই থাকবে। একযোগে প্রকাশিত হতে থাকবে এমন অনেক তথ্যওÑ যেগুলো এক সময় শেখ হাসিনার নিজের এবং তার দল ও পরিবার সদস্যদের জন্য অপ্রীতিকর, এমনকি লজ্জাকর ও বিপদজনকও হয়ে উঠতে পারে। প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চয়ই ‘ভাবিয়া করিও কাজ...’-যুক্ত প্রবাদ বাক্যটি স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন