সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদ বৃদ্ধি ও নৈতিকতা প্রসঙ্গ


গতকালের পর
রাজিউদ্দিন আহমেদ
নরসিংদী-৫ আসনে এমপি সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের বার্ষিক আয় সম্মানী ভাতা ১৭ লাখ ২২ হাজার ৩০০ টাকা। তার চেয়ে তার স্ত্রীর সম্পদই অনেক বেশি।
রাজিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। পরে দেয়া হয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রীর দায়িত্ব। নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকা-ের পর তার ভাই ও সহকারী একান্ত সচিবের নাম আসায় সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে অভিযোগপত্র থেকে ছোট ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও মন্ত্রীর ব্যক্তিগত একান্ত সহকারী (এপিএস) মাসুদুর রহমানের নাম বাদ দিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া বিশেষ কয়েক জনকে দিয়ে দলকে কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা ও সার্কিট হাউসে সরকারি এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগও রয়েছে। এসব কারণে অনেক দিন এলাকায়ও যাননি তিনি। এরপরই তাঁকে কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে মামলার বাদী, লোকমানের ছোট ভাই বর্তমান পৌর মেয়র কামরুজ্জামান বলেন, ‘মন্ত্রীর কারণে আমার ভাইয়ের হত্যাকা-ে বিচার আজও হয়নি। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে হত্যাকারীদের (এজাহারনামীয়) অভিযোগপত্র থেকে বাদ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপিল করেছি।’ (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ২৩ ডিসেম্বর ২০১৩)
রাজিউদ্দিন আহমেদের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজের নগদ আছে ৫৭ লাখ ৮৭ হাজার ৯৮৩ টাকা। আর স্ত্রীর নগদ ৪৮ লাখ ৩৩ হাজার ৯৫৩ টাকা। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজের জমা আট লাখ ৫০ হাজার আর স্ত্রীর নামে ২০ লাখ। রাজুর ৯১ লাখ ৬০ হাজার টাকার দুটি জিপ গাড়ি আছে। নিজের ও স্ত্রীর স্বর্ণালংকার আছে ৬০ হাজার টাকার। ইলেকট্রনিক সামগ্রী আছে দেড় লাখ টাকার। আসবাবের মধ্যে নিজের আছে এক লাখ ২০ হাজার টাকার এবং স্ত্রীর ২০ হাজার টাকার। রাজুর একটি শটগান ও একটি রিভলবার আছে। আর স্থাবর সম্পদের মধ্যে যৌথ মালিকানায় নরসিংদীর রায়পুরায় ৩ দশমিক ৫ বিঘা কৃষিজমি আছে।
রাজিউদ্দিন আহমেদের স্ত্রীর নামেই একাধিক বাড়ি ও জমি রয়েছে। ধানমন্ডিতে একটি জমির দাম দেখানো হয়েছে ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৬৬৭ টাকা। এছাড়া স্ত্রীর নামে গুলশানে একটি ছয়তলা বাড়ি (এক-তৃতীয়াংশ) ও এলিফ্যান্ট রোডে আরেকটি তিনতলা বাড়ি রয়েছে। গুলশানের বাড়িটির দাম উল্লেখ করা হয়েছে ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। তবে বাস্তবে এসব জমি ও ভবনের দাম অনেক বেশি। রাজিউদ্দিন আহমেদের নামে বনানীতে যৌথ মালিকানায় ১৪ কাঠার ওপর দ্বিতল বাড়ি আছে।
৩০ জানুয়ারি ২০১৪ মন্ত্রীসহ ৬ সংসদ সদস্যের সত্যায়িত হলফনামার ফটোকপি চেয়ে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারদের চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ চিঠি সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারদের কাছে পাঠানো হয়েছে। ইসি সচিবালয়ের উপ-সচিব মিহির সারোয়ার মোরশেদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের চাহিদা অনুসারে মন্ত্রীসহ ৬ সংসদ সদস্যের বাতিলকৃত হলফনামার দুই সেট সত্যায়িত কপি বিশেষ দূত মারফত ৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাঠাতে অনুরোধ করা হল।
তারা হলেন, সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী অধ্যাপক ডাক্তার আ ফ ম রুহুল হক, সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সংসদ সদস্য মোঃ আসলামুল হক, আবদুর রহমান বদি, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহাবুবুর রহমান ও সাবেক সংসদ সদস্য মোঃ আবদুল জব্বার।
ইদানীং সংবাদপত্রে তথ্য আসছে, হিসাবে গরমিল পাওয়া গেলে ও অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেলে দুদক মামলা করবে। আর আয়কর ফাঁকি দিয়ে থাকলে মামলা করবে জাতীয় রাজস্ববোর্ড। আলোচিত মন্ত্রী-এমপির সম্পদের অনুসন্ধান করা ছাড়াও তাদের স্ত্রী, সন্তান, পরিবারে নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্পদেরও অনুসন্ধান করবে। সেই সঙ্গে গত দশ বছরে তারা কী পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন সেটাও হিসাব কষে দেখবে। ২০০৮ সালে কত সম্পদের মালিক ছিলেন এখন কেমন তাও দেখবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষতমদের ক্রমতালিকায় চিত্রিত করে একাধিক রিপোর্টে প্রকাশ করেছে। জার্মানভিত্তিক সংস্থা টিআই-এর জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের সাতটি খাতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বছরে সাত হাজার আশি কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে আদায় করে থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, পূর্ত, স্থানীয় সরকার, পুলিশ, কাস্টমসসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দুর্নীতিই এখন নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দুর্নীতি তার ম্যাজিক দেখিয়ে জ্যামিতিক নকশা অনুসারে ঠিকই ডালপালা বিস্তার করছে। কারণ, প্রতিটি দুর্নীতির মামলা উচ্চতর আদালতের নির্দেশে স্থগিত  অথবা নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে-এ অবস্থার কারণ কি? এর কারণ হলো, এদেশে কোনো দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। একমাত্র এরশাদ দুর্নীতির মামলার সাজা ভোগ করেছেন।
১৯৯৬-এর আওয়ামী সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলে যে, হাইকোর্ট এভাবে সব মামলা স্থগিত করলে কিভাবে দুর্নীতিবাজদের বিচার করা যাবে। পরবর্তীতে জোট সরকারের আমলে আওয়ামী আমলের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোতে যখন হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ জারি করছে তখন তিনি কোন মন্তব্য করেননি।
বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশ কিছু প্রশাসনিক জটিলতা বিদ্যমান রয়েছে বলে সচেতন মহলের ধারণা। যা নিরসন করা না গেলে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব। উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে-(ক) দুর্নীতির প্রতিরোধ সংক্রান্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না থাকা, (খ) কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা, (গ) প্রয়োজনীয় খড়মরংঃরপ ঝঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ-এর অভাব, (ঘ) অনুসন্ধান/তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাজের গুণগত নি¤œমান, (ঙ) দক্ষতার অভাব, (চ) বিশেষজ্ঞের অভাব, (ছ) গবেষণা সংক্রান্ত কোন ব্যবস্থা না থাকা, (জ) পিপিদের মামলা পরিচালনায় দুর্বলতা, (ঝ) বিচারকদের মামলার সাক্ষীর অভাব, (ঞ) রিট/রিভিশন সংক্রান্ত সমস্যা, (ট) জনসচেতনতার অভাব, (ঠ) রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, (ড) আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক চাপ এবং তদবির, (ঢ) প্রশাসনের সর্বস্তরে (সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো) সব লেবেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে অসৎ উপায়ে ঘুষ গ্রহণ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রচেষ্টা।
উপরোক্ত কারণগুলো ছাড়াও আরো কিছু কারণ আছে। তবে প্রাথমিকভাবে দুর্নীতি দমন করতে হলে উপরোক্ত বিষয়গুলো সনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়।
একটি স্বাধীন এবং কার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রত্যাশা ছিল দেশবাসীর। তারা এমন একটি কমিশন চেয়েছিলেন, যা শক্তিশালী, নিরপেক্ষ এবং দেশের বিরাজমান দুর্নীতি দমনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। বহু দাবি, দেনদরবার এবং দাতাগোষ্ঠীর চাপের ফলে কমিশন গঠিত হলো ঠিকই, কিন্তু এটা দুর্নীতি দমনে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না।
বর্তমান সরকারের সময় একটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সর্বমহল থেকেই মন্তব্য করা হচ্ছে, কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন। কারণ, তারা এই দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত নন। যদিও তারা এই অভিযোগ সর্বদাই অস্বীকার করে আসছেন। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন না এলে তারা জগদ্দল পাথরের মতো থেকেই গেছেন।
এখন তাদের দাবি সত্য নাকি আসলেই তারা ব্যর্থ, তা পরীক্ষা করা দরকার। কারণ, তারা যদি নিজেদের কারণেই ব্যর্থ হয়ে থাকেন, তাহলে তারা যে সরকারি অর্থের অপচয় করেছেন, সে জন্য তাঁদের দায়বদ্ধ করতে হবে।
এখন আমরা চাই সাহসী, স্বাধীন ও শক্তিশালী কমিশন। যেসব লোক কথায় নয় কাজে বিশ্বাস করেন, তাদের শীর্ষ পদে নিয়োগ দিতে হবে। যিনি কাজের পরিকল্পনা করে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারেন-এমন দক্ষ লোক চাই দুর্নীতি দমন কমিশনে। এই কমিশনেরও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সরকারি সিস্টেমের ডিসক্রিয়েশনকে রিডিউস করতে হবে। বহু আইন দুর্নীতির জন্ম দিয়েছে। সেসব আইন সংশোধন করা দরকার। আইন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে জবাবদিহিতা আনতে হবে। যেসব আইন কমিশনের তদন্তের আওতায় রাখা হয়নি সে আইনগুলো সংযোজন করতে হবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য কমিশনকে ক্ষমতা দেয়ার পাশাপাশি এখানে নিয়োগ দেয়ার সময় খুব বাছাই করে দিতে হবে। যাদের নিয়োগ দেয়া হবে তাদের কর্মকা- সবসময় নজরে রাখতে হবে। চেইনের মধ্যে অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কাজ দেখানোর জন্য রাঘববোয়ালদের ধরতে হবে। কতগুলো দুর্নীতি এমনিতেই চোখে পড়ে। ওয়েবসাইট খুলে দিতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়ার জন্য। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দুর্নীতির তথ্য চাওয়া যেতে পারে ।
এই প্রতিষ্ঠানে সৎ কর্মঠ ও পরিপক্ক লোক নিয়োগ দিতে হবে। প্রশাসনে সততার সঙ্গে চাকরি করছেন এমন উচ্চপর্যায়ের সাবেক-সচিবদের কাউকে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে উচ্চ পদে। পাশাপাশি মামলা তদন্তের জন্য অভিজ্ঞ, দক্ষ, সাহসী ও সৎ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। দুর্নীতির অভিযোগ আছে এমন কর্মকর্তাদের কমিশন থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করতে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করে অগ্রসর হতে হবে। বিচারের জন্য গঠন করতে হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। ফৌজদারি কার্যবিধির নিয়ম অনুসরণ করে রাজসাক্ষী প্রথাও চালু করা যেতে পারে। কোন মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি বের করতে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে ধরতে অতীতে অধীনস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আসামী করা হয়েছে। তবে আসামীদের মধ্য থেকে কাউকে রাজসাক্ষী করা হলে অপরাধী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আরও তথ্য পাওয়া যাবে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads