মঙ্গলবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

গণতন্ত্রের গণবিলাপ


বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণের সময় ক্যাম্পাসে একজন বৃদ্ধের নিকট একটি গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি হল- এক দেশে এক রাজার একটি ঘোড়া জোলাদের ড্রাম থেকে সুতা প্যাচানোর কাঠের যন্ত্র কাঠঘোড়াতে পড়ে মারা গিয়েছিল। রাজা ঘোষণা করলেন তাঁর ঘোড়াটি মরে গেছে রাজ্যের কেউ তা রাজাকে বলতে পারবে না। যদি কেউ ঘোড়াটি মরার কথা রাজাকে বলে তাহলে তাকেও মরতে হবে। যে কারণে রাজ্যের কোন মানুষই রাজাকে তাঁর ঘোড়াটি মরার কথা বলতে গেল না। এক সময় ঘোড়াটি মরে পচে দুর্গন্ধ ছুটতে লাগলো। আশপাশের লোকজন মুখ বুঁজে দুর্গন্ধ সহ্য করলো অথচ কেউ মুখ খুলে প্রাণ ভয়ে ঘোড়াটি মরার খবর রাজাকে বললো না। কিন্তু একজন সচেতন নাগরিক মানুষের এহেন অবস্থা দেখে সাহস করে রাজার কাছে গেলেন এবং রাজাকে কৌশল করে ছড়া কেটে বললেন-
রাজা হইছে যেমনি,
প্রজা হইছে তেমনি,
কাঠঘোড়াতে ঘোড়া পইড়া
ঠ্যাং করেছে এমনি।
সেদিন গল্পটি শুধু শুনেছিলাম আর হো হো করে হেসেছিলাম। আমার হাসিতে বৃদ্ধটি খুব একটা সুখী আর খুশী হতে পারলো না বলেই মনে হয়েছিল। অর্থাৎ গল্পটির দর্শনগত দিকটি আমি বুঝতে না পারার কারণেই বৃদ্ধটির এমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। সেটা এখন বুঝতে পারছি। দেশে বিরোধীদের প্রতি শাসক শ্রেণীর বৈরিতা ও শাসক শ্রেণীর মদদে শাসক দলের পেশী শক্তির নেতিবাচক প্রদর্শন এবং বিরোধীদলের লাগাতার হরতাল অবরোধসহ নানামুখী কঠোর আন্দোলনে সাধারণ মানুষ শংকিত ও দিশেহারা। বিশেষ করে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর অবস্থা মারাত্মকভাবে সংকটাপূর্ণ। তাদের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মানুষ নিজেদের স্বাধীন মতামত দেবার সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে এক গন্তব্যহীন পথে ছুটছে। কোনই কূল কিনারা মিলছে না। ব্যক্তি স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে মা, মাটি ও মানুষের জন্য সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক স্বার্থের জন্য কেউ এগিয়ে আসছে না। গণতন্ত্রের কথা বলে যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে শাসক শ্রেণী। শাসক শ্রেণীর সাথে সুর মিলিয়ে সুবিধাভোগী একশ্রেণী পেটুক বুদ্ধিজীবী সাফাই গেয়ে যাচ্ছে লেখনি ও গলাবাজিতে। আসল কথা বলবার ক্ষমতা কারো নেই। কেউ কোন কথা বললেই সাথে সাথে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। মামলা দিয়ে রিমা-ে নিয়ে নাস্তানাবুদ করা হচ্ছে। পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। এদিকে দেশের কারাগারগুলোও ভরাট হয়ে উপচে পড়ার উপক্রম হয়েছে। কারাগুলো মানুষে মানুষে টইটম্বুর। এতো কিছুর পরেও শাসক শ্রেণী ঘোষণা দিয়েছে তাদের নতুন কথিত সরকার গঠনের পর প্রথম ও প্রধান কাজ হবে বিরোধীদের জেলে পাঠানো। এ মুহূর্তে তাহলে শাসক শ্রেণীর প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত নতুন কারাগার স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। আর তা এখনই বাস্তবায়ন করতে না পারলে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোসহ রাজধানীর বেশ কিছু ফ্লাট বা বাড়ি ভাড়া নিয়ে কারাগার হিসাবে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা। তা না হলে আর কোন উপায় নেই। তারপর দ্বিতীয় কাজটি হোক বিরোধীদের জেলে পাঠানো। বিরোধীরা অন্তত ফেরারী হয়ে বা আত্মগোপনে না থেকে জেলখানা বা কারাগারে শান্তি না পাক একটু স্বস্তিতে থাকতে পারবে। অন্যদিকে শাসক শ্রেণী ও গণতন্ত্রের চর্চা (?) অব্যাহত রেখে সংবিধানকে সমুন্নত রেখে স্বৈরাচারের কিংবদন্তী জাতীয় পুতুল এরশাদকে নিয়ে একদলীয় শাসনের খায়েশ মিটাতে পারবে। এতে জনসমর্থন থাক না থাক তাতে কিছু যায় আসে না। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে এদেশটি এখন সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে যার পর নাই সংকটাপন্নভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দেশের এই ক্রান্তিকালে বৃদ্ধটির সেই ছড়াটি খুব মনে পড়ছে। বৃদ্ধের সাথে আজ ছড়া মিলিয়ে বলতেই হচ্ছে-
রাজা হইছে যেমনি
প্রজা হইছে তেমনি,
দলের চিপায় গণতন্ত্র পইড়া
ঠ্যাং করেছে এমনি।
অবশ্য- বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও টিভি টকশোতে কিছু কিছু সাহসী সৈনিককে এ বিষয়ে যখন কথা বলতে দেখি তখন নিরাশার আঁধার ঘরে কিছুটা আলোর ফুলকি চোখে পড়ে। কিন্তু দু-একদিন পরেই আবার শাসক শ্রেণীর নিকট বলতে শুনি টিভি টকশোতে যারা সরকারের বিরুদ্ধে বলে তারা গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করেনা এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয়। তার মানে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। সহজ কথায় রাজাকার। তখন যারপর নাই কষ্ট পাই মনে। শাসক শ্রেণীর এ অবস্থা দেখে জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা মনে পড়ছে-
যারা প্রচ- ঠা-ামাথায় গণতন্ত্র ধ্বংস করছে- তাদের কাছ থেকে নিতে হচ্ছে গণতন্ত্রের ছবক। দুর্নীতিগ্রস্তদের নিকট থেকে নিতে হচ্ছে- দুর্নীতি প্রতিরোধের ও দুর্নীতিকে না বলার ছবক। সন্ত্রাসের জন্মদাতাদের নিকট থেকে নিতে হচ্ছে- সন্ত্রাস না করার ছবক। পরিবেশ ধ্বংসকারীদের নিকট থেকে নিতে হচ্ছে- গাছ না কাটা ও পাখি না মারার ছবক। যারা কূটকৌশলে সমঝোতার পথ বন্ধ করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে জনমনে অশান্তি সৃষ্টি করছে - তাদের কাছ থেকে নিতে হচ্ছে- সমঝোতার ছবক।
আজকে দেশের মধ্যে যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলো ঘটছে তা কেবল একটিমাত্র বিষয়ের সমাধান না হওয়ার জন্য। আর সেটা হলো নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা না করতে পারা। অথচ দেশের রাজকীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত জরিপে দেশের ৯০% লোকের নির্ভেজাল সমর্থন ছিল তাতে। দেশের অধিকাংশ মানুষের এমন গুরুত্বপূর্ণ মতামতের কোন তোয়াক্কা না করে সরকারের অধীনে একতরফা প্রহসনের নির্বাচন ঘটানো হলো। এই একটি বিষয়ের সমাধান না করার জন্য হাজারও ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এসমস্ত ঘটনা ঐ একটি মাত্র বিষয়ের সমাধান না করার প্রতিক্রিয়ার ফল। কাজেই ঐ ক্রিয়াটির বা বিষয়টির সমাধান যারা করেনি-পরবর্তী সামগ্রিক প্রতিক্রিয়ার জন্য মূলত তারাই দায়ী। এটা যে কেউ স্বীকার করে নেবে। শাসক শ্রেণী এর দায় এড়াতে পারবেন না।
শাসক শ্রেণী অবশ্য নানাভাবে এ দায় থেকে বাঁচার জন্য এবং টিকে থাকার জন্য বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারা বলছে- নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। সংবিধান মত হয়েছে এবং সকল আইনী প্রক্রিয়াই সরকার গঠন হয়েছে। বিরোধীরা গণতন্ত্রকে সমর্থন না করে নির্বাচনে না এসে দেশে পর্যায়ক্রমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। একটি বৈধ সংগঠনকে জঙ্গি অ্যাখায়িত করে বিদেশীদের কাছে সমর্থন লাভের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারের প্রকাশ্য নির্লজ্জ মদদে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে সরকারি দলের ক্যাডারদের দিয়ে মঞ্চায়ন করা হচ্ছে টিকে থাকার নানা গরম মসলার নাটক।
বর্তমানে শুরু হওয়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায়ও ঐ সংগঠনটির ওপর ব্যাপকভাবে চাপানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি দোষ চাপানো হচ্ছে বিরোধীদের উপর এবং এটিকে মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার করে বিদেশীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। বাঁক ঘুরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে আলোচনার। এ বিষয়টিকে হিটলারের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
হিটলার যেমন তার প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য রাইখসট্যাগে আগুন দিয়ে ভাষণে বলেছিলেন- কমিউনিস্টরা গণতন্ত্র ধ্বংস করতে চাচ্ছে। আর তারপরই হিটলার কমিউনিস্ট দমনের জন্য তৎপরতা শুরু করলেন। একথা বললাম এই জন্য যে, যৌথ বাহিনীতে সারা দেশ সয়লাব। শাসকদলের লাঠিয়াল বাহিনীরা তৎপর। ডিজিটাল সময়। তাহলে এঘটনাগুলো কি করে ঘটছে? যাই হোক বিদেশীরা তো আর এত কিছু উপলদ্ধি করছে না। কাজেই গৃহপালিত মিডিয়া ও শাসক দলের রক্ত চক্ষুর ভয় প্লাবিত মিডিয়াগুলোর সম্প্রচারে অনেকটাই এবিষয়ে সফলতা পেয়েছে শাসক শ্রেণী।
ভারত অবশ্য এ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং বলেছেন বর্তমান সরকারকে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে (?)
এখন প্রশ্ন হলো যে সরকার নিজে গণতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় সে সরকার রাষ্ট্রেয় সব প্রতিষ্ঠানে কি করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। যাই হোক বর্তমান শাসকদলের বেশী বন্ধু প্রতিম দেশ হবার জন্য অথবা রাজনৈতিক কৌশলের কারণে হয়ত ভারত এমনটি বলেছেন। রাশিয়া সমর্থন দিয়েছে কি কারণে? অস্ত্র কেনার কারণে? রাশিয়া ও ভারতকে ভুলে গেলে চলবে না যে সরকার বাংলাদেশের জনগণের ভোটের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নয় সে সরকারকে শুধুমাত্র নিজেদের কিছু স্বার্থের জন্য নির্ভেজাল সমর্থন জানানোটা বাংলাদেশের জনগণকে তাচ্ছিল্য করার সামিল। জনগণ সময় সাপেক্ষে এর জবাব দিবে। তাই যে সরকারের প্রতি দেশের মানুষের জনসমর্থন নেই সেই সরকারকে সমর্থন জানানো থেকে বিরত থাকাই তাদের যৌক্তিক হবে মনে হয়। বরং তাদের কাজ হওয়া উচিত দেশকে একটি শান্তিময় স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য তড়িৎ গতিতে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দিনক্ষণ ঘোষণা করে একটি তাৎপূর্যপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে কার্যকরী সময় উপযোগী পরামর্শ দেয়া। আর সরকার তথা শাসকদলের উচিত হবে একগুঁয়েমিভাব তাদের পরিহার করে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে ও নিজেদের দলের মধ্যে কার্যকরী ও ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশের অভিভাবক ও মাতৃসংগঠন হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা ও প্রমাণ করা।
পরিশেষে বিবেকের তাড়নায় বলতে চাই- এদেশ আমাদের। আমরা সবাই এদেশের সন্তান। আওয়ামী লীগ বলি, বিএনপি বলি, জাতীয় পার্টি বা জামায়াতই বলি আমরা সবাই একই পরিবারের মানুষ। নিজেদের মধ্যে নিজেরা কলহ করে নিজেদের পায়ে কেন নিজেরা কুড়াল মারছি। আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কলহ করে কেন আমরা দেখছি বাবা মায়ের রক্তাক্ত লাশ। ভাই দেখছে বোনের লাশ। বোন দেখছে ভাইয়ের লাশ। স্বামী দেখছে স্ত্রীর লাশ। স্ত্রী দেখছে স্বামীর লাশ। বাবা মা দেখছে সন্তানের বীভৎস লাশ। আমরা কি পারিনা সবার ভুলগুলো ক্ষমা করে দিয়ে একটি কার্যকরী সমঝোতায় পৌঁছে পরিবার তথা দেশের সবাইকে নিয়ে একটি কাক্সিক্ষত নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সরকার গঠনের মাধ্যমে পরিবার তথা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। পারিনা যেখানে থাকবে না কোন প্রতিশোধ বা হিংসাত্মক কাজকর্মের অপ্রত্যাশিত জঘন্য নগ্ন প্রকাশ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads