১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সালের মতো আরেকটি
কলঙ্কিত অধ্যায়ে কি প্রবেশ করল বাংলাদেশ? ’৮২ সালের ২৪ মার্চ বেতার-টেলিভিশনে
ঘোষণা দিয়ে গদিতে বসেছিলেন এইচ এম এরশাদ। ’৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে
৬ ডিসেম্বর সচিবের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে পতাকাবিহীন গাড়িতে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি।
এই ৯ বছর শাসনামলে তিনি রাজনীতিবিদদের এমন গণতন্ত্র শেখাতে চাইলেন যা ইতিহাস হয়ে থাকবে; কিন্তু বেরসিক জনগণ তাকে পতিত স্বৈরাচার বলেই গালি দিতে লাগল। মরিয়ম-মমতাজ, জিনাত প্রমুখ ঘোষিত-অঘোষিত ফার্স্ট লেডিরা তার চারিত্রিক স্খলন আর নৈতিক অবক্ষয়ের
একেকটি দৃষ্টান্তরূপে গণ্য হতে লাগল। সেই সাথে পাল্লা দিচ্ছিল সীমাহীন দুর্নীতি। ক্যামব্রিজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত
একনায়কদের প্রথম ১০ জনের মধ্যে ছিল এরশাদের নাম (অ্যা কম্পারেটিভ রিসার্চ-’৯১ সিইউ)। সকাল-বিকেল সিদ্ধান্ত পাল্টানোর জন্য এক সময় তার পদবি ছিল ‘আইসিএমএলডি’ অর্থাৎ আই ক্যান্সেল মাই লাস্ট ডিসিশন। মহাজোটের
পাঁচ বছর ‘আছি, নাই, আছি’ বলে কানামাছি খেলে এবার থুথু কাব্যের পর দিলেন সুইসাইডের হুমকি। পরিশেষে জীবনের
শেষ শপথ করলেন (কথা দিলেন) দেশবাসীর কাছে, সব দল না এলে নির্বাচন করবই না।
জীবনের শেষ শপথও ভাঙলেন যথারীতি, চুপিচুপি সংসদে গিয়ে শপথ নিলেন সংসদ সদস্য হিসেবে।
এক মাস র্যাবের তত্ত্বাবধানে বাধ্যতামূলক অসুস্থতা কাটিয়ে সিএমএইচ থেকে বাসায় ফিরলেন
‘দূত’ হিসেবে। তিনি নাকি কিছুই জানতেন না। টেলিভিশন দেখে
নিশ্চিত হয়েছেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। তবে চিঠি পাঠিয়ে
নেত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে দেরি করেননি। লোকে বলে, অতি চালাকের গলায় দড়ি। অতি চালাকি
আর সিদ্ধান্তহীনতায় আম-ছালা দুটোই যেতে বসেছে এরশাদের। তার কথা শুনে মনোনয়ন প্রত্যাহার
করা ১৮৩ জন তার ওপর ুব্ধ আর বিজয়ীরা সংসদীয় দলের প্রধান নির্বাচন করেছেন সাবেক ফার্স্ট
লেডি রওশনকে। এখন দলে তার কর্তৃত্ব অকার্যকর হতে বসেছে। হয়তো এ জন্যই কবি শামসুর রাহমান
লিখেছিলেন, ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। আর বর্তমান অবস্থা দেখলে তিনি একই কথা বলতেন। শিল্পী কামরুল হাসান দেখেশুনে
ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন ‘বিশ্ববেহায়া’।
স্বৈরাচারের
শোষণকে বৈধতা দিতে এবং তার শাসনকাল দীর্ঘায়িত করতে ’৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। সেই আঁতাতের নির্বাচনে অংশ নিয়ে আত্মস্বীকৃত জাতীয় বেঈমানে পরিণত হন এর
নেতানেত্রীরা। ১/১১-তে পীর হাবিবুর রহমান লিখেছেন, ‘জাতির জনকের কন্যা এরশাদের কাছ
থেকে তিন কোটি টাকা নিয়ে ’৮৬ সালের নির্বাচন করেছেন।’ ’৮৬-এর সেই দলটিই ভোটবঞ্চিত করে আবার প্রতারণা করল সোয়া ৯ কোটি ভোটারের সাথে।
প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে রেখে একদলীয় শাসন কায়েম করে কার্যত অবমাননা
করল সংসদ ও ১৬ কোটি সাধারণ মানুষ। ইচ্ছেমতো সংশোধন করা সংবিধান বারবার লঙ্ঘন করে অমর্যাদা
করল পবিত্র সংবিধানের। স্বৈরাচারের সাথে আঁতাত করে স্বেচ্ছাতন্ত্র কায়েম করে আওয়ামী
লীগ স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনে প্রাণ উৎসর্গকারী সেলিম, দেলোয়ার, জয়নাল, জাফর, দীপালি, কাঞ্চন, রাউফুল বসুনিয়া, নূর হোসেন ও ডা: মিলনের রক্তের
সাথে বেঈমানি করেছে।
‘অনির্বাচিত’ অজুহাত দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করাল। বিচারপতি খায়রুল হক জানালেন, অনির্বাচিতদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকবে, এটা মেনে নিতে পারেননি বলেই নাকি
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করতে তিনি ‘বাধ্য হয়েছেন’; কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! দশম সংসদে বেশির ভাগ সংসদ সদস্য এখন অনির্বাচিত।
যিনি শপথ পড়ালেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, তিনিও সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন।
দেশের মানুষ, সংসদ, সংবিধান সব কিছু পরিহাসের পাত্রে পরিণত করে দেশের
সম্মান ভূলুণ্ঠিত করা হলো। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য জি এম কাদের এই সরকারকে বলেছেন
জগাখিচুড়ি, আ স ম রবেরও একই মত। এক কলামিস্ট একধাপ এগিয়ে বলেছেন ভুনাখিচুড়ি।
টিপ্পনি কেটেছেন, ‘হয়তো বাঙালির খিচুড়ি পছন্দ বলেই ইংরেজি নববর্ষে
এই উপহার।’ আর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত লেজেগোবরে
সরকার বাদ দিয়ে ‘নির্ভেজাল’ বিরোধী দল চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মাথা সরকারে, লেজ বিরোধী দলের অথবা মাথা-লেজ বিরোধী দলে আর পেট
সরকারি দলের, এটাও হবে না।’ আর অর্থমন্ত্রীর হয়েছে স্টিংকিং
ফিলিংস (দুর্গন্ধযুক্ত অনুভূতি)। (১২-০১-১৪ বাংলাদেশ প্রতিদিন, নয়া দিগন্ত, কালের কণ্ঠ)। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এটাকে আখ্যা
দিয়েছেন বেনিফিশিয়ারি ডেমোক্র্যাসি বা সুবিধাবাদী গণতন্ত্র। তিনি বলেন, ‘অন্য কোনো দেশে সব দল মিলে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের নজির আছে বলে আমার জানা
নেই। থাকলে সেটাকে গণতন্ত্র বলব না, সেটা হতে পারে পাগলামি। পাগলের
দেশে সেটা হতে পারে, কিন্তু আমরা তেমন পাগল হইনি।’ (১৩-০১-১৪ বাংলাদেশ প্রতিদিন); কিন্তু হতভাগা এই জাতির অনেক
স্তাবক বলেছেন, এটা নাকি ‘গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র’। জাবির পরিত্যক্ত ও পদত্যাগী ভিসি দৈনিক ইত্তেফাকে ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ শক্তিকে চিরতরে পরাজিত করতে এই ‘গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র’ বহাল রাখতে প্রধানমন্ত্রীকে নসিহত
করে নিজেদের অগণতান্ত্রিক মানসিকতা প্রকাশ করে দিয়েছেন। এমন লোকেরই আবেগ আর প্রতিহিংসার
কারণে দেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে এবং একনায়কতন্ত্রের শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু
যখন লালবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, একদলীয় শাসন কায়েমে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; তখনো কিন্তু ‘বাহ কী চমৎকার’ বলার লোকের অভাব ছিল না। তখন
নাকি পরনের জামা দিয়ে প্লেট মুছে বঙ্গবন্ধুকে খাবার পরিবেশন করতেন খন্দকার মোশতাক গং; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ওই সিদ্ধান্তে বেদনাহত হয়েছিলেন তার আদর্শের কর্মীরা। মুক্তিযুদ্ধকালীন
অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী মুক্তিনায়ক তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল গঠনের প্রতিবাদ করেছিলেন
সাথে সাথে। এ নিয়ে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সাথে তার তপ্ত বাক্যবিনিময়ও হয়েছিল। বাদানুবাদের
একটি কথা তাজউদ্দীন সাহেবের একান্ত সচিব আবু সাইদ চৌধুরীর কাছে দৈববাণী মনে হয়েছিল।
তিনি লিখেছেন, তর্কবিতর্কের একেবারে শেষে এসে তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ‘বাই টেকিং দিস স্টেপ (বাকশাল) ইউ আর কোজিং অল দ্য ডোরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি
ফ্রম ইওর পজিশন (এই পদক্ষেপ নেয়ার মধ্য দিয়ে আপনি আপনার অবস্থান থেকে আপনাকে শান্তিপূর্ণভাবে
সরানোর সবগুলো দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন)।’ তাজউদ্দীন আবেগে থরথর গলায় বললেন ‘মুজিব ভাই, আমি সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, কেউ যদি আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায় তাহলে সে এরপর কী করবে? আপনি তো আপনাকে সরানোর সব পথ নিজেই বন্ধ করে দিচ্ছেন। এরপর আপনাকে সরানোর একটা
পথই খোলা থাকে।’ শেখ মুজিব তার কথা শুনে প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন। চিৎকার-হুঙ্কার
দিয়ে কথা বলতে লাগলেন, যা টেলিফোন থেকে দূরে বসে থাকা কর্মকর্তা আবু সাইদ
চৌধুরীর কানেও ভেসে আসছিল; কিন্তু সব কথাকে ছাপিয়ে আবারো ভেসে উঠল তাজউদ্দীনের
কণ্ঠ ‘কিন্তু মুজিব ভাই, সবচাইতে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা কী ঘটবে জানেন, আপনাকে এত নিষেধের পরও এটা করায়
আপনার সাথে ওই বন্দুকের গুলিতে আমরাও মারা যাবো।’ লাল ফোনের সেই বিতর্কের কয়েক
দিন পরই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ পেয়েছিলেন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ।
(সূত্র : তাজউদ্দীন নিঃসঙ্গ এক মুক্তিনায়ক ইমতিয়ার শামীম, প্রকাশনা বাংলা প্রকাশ, পৃষ্ঠা-৯৪)। লাল টেলিফোনের সেই
দৈববাণীটি সত্য হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করার সেই গুলিতে কিছু
দিন পরই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সৈনিক তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতা কেন্দ্রীয় কারাগারে
প্রাণ বিসর্জন দিলেও মোশতাকরা কিন্তু সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়েই রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।
আজো লাল টেলিফোনটা আছে ঠিকই, কিন্তু অভাব কেবল একজন দেশপ্রেমিক তাজউদ্দীনের কণ্ঠের।
কারণ চার পাশে কেবল কপটচারী মোসাহেবের দল। তাই বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বলব, বর্ণচোরা দালাল কমরেড মুনাফেকদের দয়া করে একটু চেনার চেষ্টা করবেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন