র্যাব কিংবা পুলিশের ‘ক্রসফায়ার’ বন্দুকযুদ্ধ এখন এক আন্তর্জাতিক ইস্যু। পৃথিবীর কোনো মানবাধিকার সংগঠন, কোনো শিষ্টাচারিত রাষ্ট্র এই ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ মেনে নিতে নারাজ। তাদের বক্তব্য হলো, আসামী পুলিশ বা র্যাবের হেফাজতেই ছিল। তারপরও তারা কি করে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’র গুলীতে নিহত হয়। আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার এই যে, আসামীর সহযোগীদের গুলী যখন লাগে, তখন কোনো পুলিশের গায়ে লাগে না। কেবলই আসামীর গায়ে লাগে। দুনিয়ার মানুষ ঘাস খায় না, ভাত-রুটি বা আলু খায়। র্যাব-পুলিশ কখনও কখনও বলে, ঐ কথিত বন্দুকযুদ্ধে তাদের দু-একজন সদস্য আহত হয়েছে। এরকম হলে প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের শাসকশ্রেণী একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাসপাতালে তাদের দেখতে যান। টেলিভিশনে অনেক সহমর্মিতা, অনেক রকম উক্তি, বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপ এগুলো আমরা শুনতে পাই, দেখতে পাই।
এগুলো করতে করতে সরকার এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, সাধারণ মানুষ প্রতিদিনই তা অবিশ্বাস করছে। সরকারের কোনো ভাষ্যই তারা স্বীকার করছে না বা মেনে নিচ্ছে না। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি গাড়ির কিছু কাগজপত্র সংশোধনের জন্য দুপুরের দিকে বাংলাদেশ রোড ট্র্যান্সপোর্ট অথরিটির অফিসে গিয়েছিলাম। তখন অনেকেই জেএমবির মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামীদের অপহরণের কথা জেনে গেছেন। আমি সাধারণ মানুষের একজন। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ‘হেল্প ডেক্স’ বন্ধ। বন্ধ কেন? স্যারেরা লাঞ্চে গেছেন। ডজন ডজন মানুষ লাইনে দাঁড়ানো। চিৎকার-চেঁচামেচি, হৈ-হল্লা। কেউ বলছেন, গত রাত ১টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ বলছেন, তার টাইম ১১টায়। এসেছেন ৯টায়। এখনও কারও কোনো খোঁজ-খবর নেই।
এর মধ্যে যে কোনো কারণেই হোক, কেউ কেউ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনে ফেললেন। আর অভিযোগ করতে থাকলেন যে, ভাই আপনারা মিডিয়ায় কাজ করেন। আমাদের এই দুর্ভোগের কথা কিছুই লেখেন না। আজকে তো নিজেও দুর্ভোগে পড়েছেন। দয়া করে কিছু লিখবেন। আমি নির্বাক। স্মিত হাসিতে বিষয়টি উপেক্ষা করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কাজ হলো না। লাইনে দাঁড়ানো একাধিক ব্যক্তি সামনে চলে এলেন। বললেন, আপনারা মিডিয়ার লোক। আপনাদের একটা দায়িত্ব আছে না? আমি বোঝাতে চাইলাম। ভাই আমার যেমন দায়িত্ব আছে, দায়িত্ব আপনাদেরও আছে। যদি মনে করেন, প্রতিবাদ করবেন, করুন। আমি তো সরকারকে সংশোধন করার চেষ্টা করেই যাচ্ছি। আমাকে কেন খামোখা দোষ দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে যারা ততক্ষণে জেএমবির ঘটনা অবহিত হয়েছেন, তারা সমস্বরে বললেন, দেখছেন কি আশ্চর্য নাটক! সরকারই এই নাটক সাজিয়েছে। এই যে নবেম্বরে আল জাওয়াহিরির বক্তব্য আপলোড হয়েছে, সেটা নিয়ে ফেব্রুয়ারির শেষে এসে সরকার কেন তোলপাড় করছে, বুঝতে পারেন না? আমি বললাম, ভাই, এ নিয়ে আপনারা যা বোঝেন, আমিও তাই বুঝি। উদাসীন সরকারের মনের কথা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই।
তারা সন্তুষ্ট হলেন না। আমার তো বলার কিছু নেই। আমি এক ধরনের অবরুদ্ধ বোধ করছিলাম। মিডিয়ায় কাজ করি বলে সব মানুষ আমার বা আমাদের কাছে সমাধান চায়। তাই কি সম্ভব? সমাধান জনগণের হাতে। সমাধান করতে পারেন একমাত্র তারাই। মিডিয়ার লোকেরা নয়। অধিকাংশ মিডিয়াই এখন সরকার অনুরাগী। সেভাবেই তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। কথার সামান্য ব্যত্যয় কিংবা সরকারের পছন্দ নয়Ñ এমন কিছু ঘটলেই মিডিয়া বন্ধ। সেভাবেই বন্ধ ‘আমার দেশ’। বন্ধ হয়েছিল দৈনিক ইনকিলাব। বন্ধ আছে দিগন্ত টিভি। বন্ধ আছে চ্যানেল ওয়ান। আসতে পারছে না যমুনা টিভি। তারও আগে বন্ধ হয়ে গেছে সিএসবি নামক জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল। মিডিয়া কতটুকু করতে পারে? কিন্তু জনগণের আশা কেন যেন অনেক বেশি। অথচ টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলো দাসানুদাস। জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সংস্কৃতি রক্ষায় তাদের যে বিশাল ভূমিকা থাকার কথা ছিল, তার শূন্যমাত্র নেই।
এরই মধ্যে এক ভয়ঙ্কর সংবাদ এলো যে, জামায়াতে মুজাহিদুল ইসলামী বাংলাদেশ বা জেএমবির মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত তাদের তিন সদস্যকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে। তাদের নেয়া হচ্ছিল ডা-াবেড়ি পরা অবস্থায় কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ আদালতে আরও মামলার শুনানির জন্য। এদের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা। অনেকগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে। অনেকগুলো এখনও চলছে। জেএমবির মূল সদস্যদের বিএনপির শাসনামলেই বিচার করা হয় এবং আদালতের রায়ে যাদের মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল, সে দ- কার্যকারও করা হয়। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের মৃত্যুদ- কার্যকরও হয়ে গেছে।
এরপর ঘটল ২৩ তারিখের জেএমবি অপহরণ ঘটনা। তার আগে অনেক কা- হয়ে গেছে। বাংলাদেশে আল কায়দা প্রধান জাওয়াহিরির এক ‘কল্পিত’ বার্তা প্রচার হয়েছে। সেটি ভিডিও বার্তা ছিল না। ছিল অডিও বার্তা। গত নবেম্বরে আমেরিকার আরিজোনা থেকে বার্তাটি প্রথম আপলোড করা হয়। আর মিডিয়ার এই যুগে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কখন ছড়িয়ে পড়ে? যখন উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের কাছে চরম ভরাডুবির শিকার হয়েছে। অর্থাৎ যেখানে সামান্য বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আছে, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন আছে, সেখানেই আওয়ামী লীগের বা শাসকগোষ্ঠীর করুণ ভরাডুবি। এর কৌশল হিসেবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিজেরা সহিংসতা চালিয়ে বিএনপি-জামায়াতকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। সে কৌশল ধোপে টেকেনি। বাংলাদেশের মানুষ তো বটেই পৃথিবীর কেউ বিশ্বাস করেনি যে, এই সহিংসতা বিএনপি-জামায়াতের সৃষ্টি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগের নির্যাতন সহ্য করতে করতে শেষ পর্যন্ত ফুঁসে উঠেছে। তারা সাংবাদিক সম্মেলন করে, মানববন্ধন করে বলেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী প্রহসনের পর তাদের ওপর নির্যাতন করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের রক্ষা করেছে বিএনপি-জামায়াত।
এতে দিশেহারা হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা সম্প্রতি বিরোধী দলীয় নেত্রী সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তাতে কুরুচির এতটাই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, এ নিয়ে আলোচনা করতেও মন সায় দেয় না। তিনি সম্ভবত ধরেই নিয়েছেন যে, এই বাংলাদেশ তার বাপ-দাদার তালুক-মুলুক। কিন্তু বাংলাদেশের মালিক এদেশের জনগণ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণ সংগতভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছে। ৫ শতাংশ লোকও ভোট দেয়নি। এমনকি প্রায় ৫০টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগেরও কেউ ভোট দেয়নি। একটিও ভোট পড়েনি। সামান্যতম লজ্জা থাকলে সরকার অনুতাপ করত। তা তারা করেনি।
কিন্তু মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত তিন আসামীর ছিনতাইয়ের ঘটনা বিরাট রহস্যের সৃষ্টি করেছে। প্রথমত, মৃত্যুদ-প্রাপ্ত এমন আসামীদের কেন মাত্র তিনজন পুলিশ দিয়ে ময়মনসিংহ পাঠানো হচ্ছিল, সেটিও বোঝা দুষ্কর। তারা সবাই ছিল ডা-াবেড়ি পরিহিত। কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে তাদের যারা পথরোধ করে তারা সবাই ছিল র্যাবের মতো কালো পোশাক পরিহিত। মুখে কালো কাপড় বাঁধা। তারা নাকি সংখ্যায় ছিল ১০-১২ জন। দুটি মাইক্রোবাসে তারা এসেছিল। একটি মাইক্রোবাসের মুখ ছিল ঢাকার দিকে। আর একটি তার উল্টো দিকে। একটি কালো মাইক্রোবাস। একটি সাদা মাইক্রোবাস। তারা চার থেকে মিনিটের মধ্যে অপারেশন সম্পন্ন করে জেএমবি সদস্যদের দুটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। আহত একজন পুলিশ জানিয়েছে, তারা ছিল পুলিশের চেয়েও উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পরনে ছিল কালো পোশাক। মুখে ছিল কালো মুখোশ। বিভিন্ন পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, অতি দ্রুত তারা কাজটি সম্পন্ন করে। এরকম আসামীদের পরিবহনের ক্ষেত্রে মাত্র তিনজন নিরাপত্তারক্ষীর ঘটনা বিস্ময়কর। চালকও পুলিশ বাহিনীর সদস্য। কিন্তু তিনি পুলিশের পোশাকে ছিলেন না। সেটাও আরেক রহস্য। একজন পুলিশ অফিসার খুন হলেন। দুজন আহত হলেন। চালক অক্ষত থাকলেন। এটাও রহস্য। তারপর কি হলো? পুলিশ ঠিক ঠিক একজন পলাতক জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে ফেলল। এক্ষেত্রে আমাদের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দেয়া ছাড়া আর কিছু বলার নেই। আমরা ভাবলাম, যেহেতু অন্তত একজন গ্রেফতার হয়েছে, তবে তার ভাষ্য থেকে জানা যাবে, কারা তাদের উদ্ধার করেছে, তাদের ঠিকানা-পরিচয় কী? বিএনপি যেভাবে জেএমবির উত্থান ঠেকিয়ে দিয়েছিল, এবারও সম্ভবত সে উত্থান ঠেকানো হবে।
কিন্তু তা হলো না। এরপর ঘটল এক বিয়োগান্ত ঘটনা। অপ্রত্যাশিত। অবিশ্বাস্য। পুলিশ রাকিব হাসানকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’র নামে তার হত্যার খবর প্রচার করল। তাহলে সাধারণ মানুষের মনে সঙ্গত কারণেই এই প্রশ্ন উত্থাপিত হবে আটক রাকিব হাসান তো পুলিশের হেফাজতেই ছিলেন। তার কাছ থেকে অনেক তথ্যই পাওয়া যেত। কিন্তু তাকে হত্যার মাধ্যমে সে তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা চিরতরে মুছে দেয়া হলো। আমাদের আশঙ্কা জেএমবির বাকি দুই সদস্যও ধরা পড়বে এবং আদালতের রায়ে নয়, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ তাদের মৃত্যু হবে। এ আশঙ্কা আমার নয়। এটা সাধারণ মানুষের।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্ভবত সঠিকভাবেই বলেছেন যে, ঘটনা ধামাচাপা দিতেই সরকার রাকিবকে হত্যা করেছে। সাজিয়েছে ক্রসফায়ার নাটক। সরকার যে সাজায়নি, সেটা সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে। নরহত্যার রাজনীতির ব্যাপারে সরকারের বোধহয় একটা সিদ্ধান্তে সময় উপনীত হয়েছে।
পাদটীকা :
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় স্থগিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেখানে বিএনপি প্রার্থী জিতে গিয়েছেন। জিতে গেলেই কি হয়? সরকারি পেশিশক্তির অধিকারীরা গোটা এলাকায় তা-ব সৃষ্টি করে এমন এক অবস্থা তৈরি করেছে যে, যেন ফলই দেয়া না যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এভাবে পৃথিবীর কোনো স্বৈরশাসক ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। আপনার কি মনে হয় পারবেন?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন