বিদ্যুৎ এখন শুধু উন্নয়নের বিষয় নয়, জীবনযাপনেরও বিষয়। বিদ্যুৎ ছাড়া কলকারখানা চলে না, কৃষি চলে না, জীবনযাপনও হয়ে পড়ে অচল। জীবনের সাথে বিদ্যুৎ এতটাই জড়িয়ে পড়েছে যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্রা ও মূল্য এখন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সব বিষয় আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে থাকে। আমরা জানি যে, একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে সরকার ২০০৯ সালে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে এবং বেশি দামের বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী এ বছর থেকেই বিদ্যুতের দাম কমার কথা। অথচ ১ মার্চ থেকে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সরকার তার মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপন করে অপেক্ষাকৃত কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যর্থ হয়েছে। এই কারণেই এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম. তামিম প্রথম আলোকে বলেন, গত ৫ বছরে বিদ্যুৎখাতে সরকারের সাফল্য প্রধানত তরল জ্বালানিনির্ভর ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ও পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে। তবে এসব কেন্দ্রের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে। অপেক্ষাকৃত কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় এখন এই কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে। ফলে বিদ্যুতের দামও বাড়ছে। সার্বিকভাবে এর ফল শুভ হবে না। বলে ম. তামিম মন্তব্য করেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০৯ সালে সমন্বিত পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্টভাবে হিসেব করে দেখানো হয়েছিল যে- তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক, দ্রুত ভাড়াভিত্তিক ও পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র করায় বিদ্যুতের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে ২০১২-১৩ সালে। এর পর গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে চালু হতে থাকলে ২০১৩-১৪ সাল থেকে বিদ্যুতের দাম কমবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তৎকালীন চেয়ারম্যান এস. এম. আলমগীর কবীর হিসেব করে দেখিয়েছিলেন, ২০১৩-১৪ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় হবে ৪ টাকা ৩২ পয়সা। এর পরের বছর তা কমে হবে ৩ টাকা ৯৮ পয়সা। অথচ পিডিবির সর্বশেষ অভ্যন্তরীণ প্রাক্কলন অনুযায়ী আগামী বছর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে হবে ৬ টাকা ২৭ পয়সা। সরকার এখন চাইছে, একদফা দাম বাড়িয়ে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য উৎপাদন ব্যয়ের কাছাকাছি নিয়ে যেতে, যাতে এই খাতে ভর্তুকি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনা যায়। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কর্মকর্তারা জানান, গত সপ্তাহে ৫টি বিতরণ কোম্পানি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আগামী ৪, ৫ ও ৬ মার্চ ওই প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ১ মার্চ থেকে দাম বৃদ্ধি কার্যকর হতে পারে। বিতরণ কেম্পানিগুলো গড়ে ১৫ শতাংশের বেশি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
নতুন সরকারের আমলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হলো। এর আগে ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আড়াই বছরে পাইকারী ও খুচরা পর্যায়ে ৫ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে মোট ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ দাম বেড়ে প্রতি ইউনিটের বিদ্যুতের গড় মূল্য হয়েছে এখন ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। আর প্রতি ইউনিটের উৎপাদন মূল্য এখন ৬ টাকা ২২ পয়সার মত। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কেমন প্রভাব ফেলবে এ সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলা দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি। তাই রাজস্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দাম বাড়ানো অপরিহার্য নয়। তাছাড়া দেশে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে, বিনিয়োগও নেই। উৎপাদন পরিস্থিতি দুর্বল। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে দেশের অর্থনীতি বাড়তি চাপের মুখে পড়বে। কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া। গত মেয়াদে এ ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ হয়েছিল, নতুন মেয়াদেও যদি সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দেয় তাহলে জনগণের দুর্ভোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। তাই এখন সরকারের উচিত হবে সস্তা জনপ্রিয়তার বদলে বরং জনদুর্ভোগ দূর করা ও দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকার সঙ্গত ভূমিকা গ্রহণ করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন