বংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কিত একটি বিশেষ নিবন্ধ ও একটি রিপোর্ট নিয়ে সচেতন সকল মহলে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছে। নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’তে আর রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের শীর্ষ মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’। ‘ফরেন পলিসি’র নিবন্ধে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়েছে, দেশটির সামনে এখন দুটি মাত্র মন্দ বিকল্প রয়েছে। একটি সামরিক অভ্যুত্থান, অন্যটি গৃহযুদ্ধ। নিবন্ধে এই বলে মন্তব্য করা হয়েছে যে, একবার গৃহযুদ্ধ শুরু হলে দেশটিকে ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে। নিবন্ধে এমন গুরুতর মন্তব্যের কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মূল কারণ হিসেবে এসেছে নির্বাচন ও সংবিধানসহ বিভিন্ন প্রশ্নে প্রধান দুটি রাজনৈতিক পক্ষের পরস্পর বিরোধী অবস্থান ও কর্মকা-, ক্ষমতাসীনদের ভোটারবিহীন নির্বাচন ও আবারও সরকার গঠন, দেশব্যাপী প্রচ- রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সবশেষে সরকারবিরোধীদের নির্মূল করে ফেলার ভয়ংকর চেষ্টা। নিবন্ধে প্রাসঙ্গিক অনেক তথ্য ও পরিসংখ্যানেরই উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু সঙ্গত কারণে আমরা এখনই সেদিকে যেতে চাই না। এখানে বরং ‘অধিকার’-এর রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করা দরকার। গত শুক্রবার প্রকাশিত এই রিপোর্টে ‘অধিকার’ জানিয়েছে, কেবল জানুয়ারি মাসেই অন্তত ৩৯ জনকে বিচারবহির্ভূত পন্থায় হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২০ জন কথিত ক্রসফায়ারে এবং ১৮ জন গুলীবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। পিটিয়েও হত্যা করা হয়েছে একজনকে। ক্রসফায়ারের সঙ্গে এনকাউন্টার এবং বন্দুকযুদ্ধ শব্দ দুটিরও ব্যবহার করেছে ‘অধিকার’। এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীসহ যৌথবাহিনী জড়িত রয়েছে বলে রিপোর্টটিতে উল্লেখ রয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-গুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক সহিংসতায়ও অন্তত ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও পত্রিকার প্রেসে তালা ঝুলানোসহ গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের সরকারি চেষ্টা সম্পর্কেও কিছু তথ্য জানিয়েছে অধিকার। তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ আইনের নিবর্তনমূলক ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে ‘অধিকার’ আইনটি বাতিলের জন্যও দাবি জানিয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- সম্পর্কে অধিকারের রিপোর্টে যেসব তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের প্রবল প্রতিবাদের মুখেও এ হত্যাকা- অব্যাহত রয়েছে, যার শিকার হচ্ছেন বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও যুবদল এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ দল দুটির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাও হত্যাকা-ে মারা যাচ্ছেন। এসবের নাম কখনো দেয়া হচ্ছে ক্রসফায়ার, কখনো এনকাউন্টার। ইদানীং আবার বেশি বলা হচ্ছে বন্দুকযুদ্ধ। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বেছে বেছে এমন সব নেতা-কর্মীকেই হত্যা করা হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে যারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন এবং ভবিষ্যতেও যাদের নেতৃত্ব দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রতিটি হত্যাকা-ের পরই সরকারের পক্ষ থেকে একই ভাষায় জানানো হচ্ছে, সন্ত্রাসে জড়িত অন্য আসামীদের গ্রেফতার করার জন্য নিহত নেতা বা কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালাতে গিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল বলেই র্যাব ও পুলিশ নাকি ‘বাধ্য হয়ে’ গুলী ছুঁড়েছে এবং এতেই মৃত্যু ঘটেছে ওই নেতা-কর্মীদের! মেহেরপুর জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল তারিক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের মতো অনেকের বেলায়ও একই গল্প বানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ২০ জানুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশ তারিক মুহাম্মদকে মেহেরপুর শহর থেকে সাধারণ মানুষের সামনে গ্রেফতার করেছিল কিন্তু তার লাশ পাওয়া গেছে রাত দেড়টার দিকে। পুলিশ দাবি করেছে, তারিক মুহাম্মদ নাকি সন্ত্রাস-বোমাবাজির মতো কথিত অপরাধের দোষ স্বীকার করেছিলেন। দলের অন্য বোমাবাজ-সন্ত্রাসীদের আস্তানা দেখিয়ে দেয়ার জন্য তাকে নিয়ে শ্মশানঘাট এলাকায় গেলে পুলিশ নাকি প্রতিরোধের মুখে পড়ে। উভয় পক্ষের গোলাগুলীতেই নাকি প্রাণ হারিয়েছেন এই জামায়াত নেতা! এ ধরনের আরো অনেক হত্যাকা-ের খবরও শোনা যাচ্ছে। গত ১৮ জানুয়ারি একদিনেই দেশের বিভিন্নস্থানে ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, প্রথমে র্যাব, পুলিশ বা সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা বেছে বেছে নেতা-কর্মীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর দু’একদিন পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এবং সবশেষে তাদের মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে যেখানে-সেখানে। প্রতিটি হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে যৌথবাহিনীর নাম।
‘অধিকার’-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে বলে শুধু নয়, আসলেও প্রমাণিত সত্য হলো, রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের জন্য গুম ও হত্যার ব্যাপারে সরকার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বস্তুত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়ে আবারও সরকার গঠন করার পর বিরোধী দলকে দমনে ‘যতটা দরকার ততটা’ কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই এ হত্যাকা-কে উৎসাহিত করেছেন। তার এ ঘোষণার পরপরই নতুন উদ্যমে হত্যার অভিযানে নেমেছে যৌথবাহিনী। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেয়ার পর হত্যাকা- বেড়ে গেছে বলেই তার নিজের এবং সরকারের পক্ষে দায় এড়ানোর সুযোগ থাকতে পারে না। সামনে পুলিশ ও র্যাবকে রাখা হলেও পেছনে আসলে রয়েছে সরকার। গণতন্ত্রে এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, হত্যা ও গুমের মতো ভয়ঙ্কর পন্থায় সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করা কিংবা জনগণের আন্দোলন প্রতিহত করা সম্ভব নয়। আমরা তাই মনে করি, সরকারের উচিত অবিলম্বে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করা। না হলে দেশ এগিয়ে যাবে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকেÑ যে বিষয়ে মার্কিন সাময়িকী মন্তব্য করেছে। কোনো মন্তব্য করার পরিবর্তে আমরা শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করি যে, বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো চরম ফ্যাসিবাদী নিষ্ঠুর পন্থায় বিরোধী দলকে নির্মূলের চেষ্টা চালানো হলে মূল্য শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদেরই অনেক বেশি গুণতে হতে পারে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন