নানা বিতর্ক আর জনমতের বিরুদ্ধে, সেই সাথে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের মতামত উপেক্ষা করে ৫ জানুয়ারির নিয়ম
রক্ষার নির্বাচন যেনতেনভাবে সম্পন্ন করার পর সরকার এখন পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে
বিভোর। আওয়ামী লীগের শীর্ষসারির নেতারা জোর গলায় বলতে শুরু করেছেন বিএনপি জাতীয় নির্বাচনী ট্রেন ফেল করেছে। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের জন্য তাদের
পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আর সে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে শেখ হাসিনার দলীয় সরকারের
অধীনেই। অতএব এই পাঁচ বছরের আগে বিএনপির সাথে কোনো সংলাপও নয়, নির্বাচনও নয়। আওয়ামী লীগ সরকার সে ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিয়েই যেন এখন এর
যাবতীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ৫ জানুয়ারির একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনের পরও যখন
দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে সব দলের অংশগ্রহণে সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তাগিদ
এখনো আগের মতোই অব্যাহত, সে দিকে নজর না দিয়ে সরকার অনেকটা হঠাৎ করেই উপজেলা
পরিষদ নির্বাচনে নেমে পড়েছে। অনেকটা তাড়াহুড়ো করে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন দেয়ার পেছনে
সরকারের দু’টি উদ্দেশ্য কাজ করেছে। প্রথমত, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি
ও এর নেতৃত্বাধীন জোট অনেকটা দুর্বলতর অবস্থা। তখন উপজেলা নির্বাচন দিয়ে সরকার তৃণমূল
পর্যায়ে এর জনভিত্তি জোরদার করতে চায়। এতে ১৯ দলীয় জোট অংশ না নিলে একতরফাভাবে নির্বাচন
করে উপজেলা পরিষদ দুর্গেও শতভাগ দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারবে সহজেই। আর ১৯ দলীয় জোট অংশ
নিলেও এ জোট সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে আপাতত দূরে থাকবে। অর্থাৎ ১৯ দলীয় জোটের আন্দোলনকে
ভিন্নমুখী করার এটি শাসকদের একটি প্রয়াস। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ইসি কয়েক দফায় উপজেলা
নির্বাচন সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে এবং প্রথম দফায় ৯৭টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় দফায় ১১৭ উপজেলায় ভোট ২৭ ফেব্রুয়ারি। তৃতীয় দফায় ৮৩টি উপজেলায়
ভোট ১৫ মার্চ। চতুর্থ দফায় ৯২টি উপজেলায় ভোট ২৩ মার্চ আর সর্বশেষ পঞ্চম দফায় ৭৪টি উপজেলায়
ভোট হবে ৩১ মার্চ।
সরকার
ও ইসি বলে আসছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। সরকার ও ইসি
এবার ঘোষণা করে উপজেলা নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। বিএনপি ও
এর নেতৃত্বাধীন জোট উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে এরই মধ্যে প্রথম
দফার ৯৭টি উপজেলার নির্বাচনে অংশ নেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন ছিল এই ৯৭ উপজেলার নির্বাচন।
আমরা দেখেছি, এ নির্বাচনের আগেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ওপর
মামলা, হামলা, গুম, হত্যা চলেছে আগের মতোই। বিএনপির
পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ তোলা হয়েছে; সরকারপক্ষ ও ইসি তাতে কান দেয়নি। সরকারের কথা, যৌথবাহিনী সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালিয়েছে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। ইসির কথা, তারা লিখিতভাবে কারো কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পায়নি। অথচ প্রথম পর্বের ৯৭ উপজেলার
ভোটের দিন ১৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক কালের কণ্ঠের শীর্ষ সংবাদের শিরোনাম ছিল এরূপ : ‘আজ ৯৭ উপজেলায় নির্বাচন : অভিযোগের স্তূপ, নির্বিকার ইসি, এমপির বাড়িতে গোপন বৈঠকও’। রিপোর্ট মতে, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর
অভিযোগ, বগুড়া-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানের বাড়িতে
উপজেলা নির্বাচনের আগে রাতে ‘৭০টি কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ২৫টির প্রিজাইডিং অফিসার
গোপন বৈঠক করেন। বৈঠকে এই এমপির স্ত্রী ও সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি
মিসেস মান্নানও উপস্থিত ছিলেন।’ আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শাহজাহান আলীর অভিযোগ, এমপির এই গোপন বৈঠকের ব্যাপারে তিনি প্রশাসনের বিভিন্নপর্যায়ে অভিযোগ করে কোনো
সাড়া পাননি।
প্রথম
দফায় ১৯ ফেব্রুয়ারির ভোটের পরদিন প্রথম আলোর এই নির্বাচনসংক্রান্ত খবরের শিরোনাম ছিল
: ‘কেন্দ্র দখল করে সিল, ব্যালট ছিনতাই, সংঘর্ষ, ১৬ উপজেলার ৬৫ কেন্দ্রে অনিয়ম, অনিয়মের অভিযোগে ভোটের পরদিন
১১ উপজেলায় হরতাল ডেকেছে স্থানীয় বিএনপি।’ এসব শিরোনাম থেকে প্রথম দফার
উপজেলা নির্বাচনী চিত্রটি সহজেই অনুমেয়। ২২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক মানবজমিনের এ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট
একটি খবরের শিরোনাম : ‘বাজিতপুরে এমপির নেতৃত্বে ৩০ কেন্দ্রে ভোট ডাকাতি’, ৪৮ ঘণ্টার হরতাল। একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেশবাসী দেখেছেন ভোটে পুলিশের সরাসরি
হস্তক্ষেপের নগ্ন দৃশ্য। পুলিশের লোক কয়েকটি ব্যালট বই নির্বাচনী কর্মকর্তার কাছ থেকে
ছিনিয়ে নিয়ে বাইরে গিয়ে তা সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ফেলার জন্য কেন্দ্রের ভোটকক্ষে ঢোকার
সময়ে টেলিভিশন সাংবাদিক তাকে আটকে দেন। এ সময় তাকে পুলিশের সাথে ধাক্কাধাক্কি করতে
দেখা যায়। এ সময় ব্যালট পেপারগুলো তার হাত থেকে মাটিতে পড়ে যায়। পরে এসব ব্যালট পেপার
সম্পর্কে নির্বাচনী কর্মকর্তা বক্তব্য দেন পুলিশ এ ব্যালট বইগুলো তার কাছ
থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সংবাদপত্রে ছাপা ছবিতে দেখা যায়, নির্বাচনী কর্মকর্তারা ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করছেন, সহজেই অনুমেয় সরকারি দলের প্রার্থীর অনুকূলেই তা করা হচ্ছিল। আর অসংখ্য কেন্দ্রে
পোলিং এজেন্ট বের করে দিয়ে সরকারি দলের লোকজন সিল মেরে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করার অভিযোগ
তো এন্তার। এরপর নির্বাচন কমিশন ও সরকারি দলের নেতাদের দাবি উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তাদের দাবি প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব; কিন্তু বিবেকবানদের প্রশ্ন এটি যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের সংজ্ঞা
কী? অনেক জায়গায় বিএনপিসমর্থিত প্রার্থী, বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দিয়ে
আওয়ামী লীগের লোকেরা ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মেরে বাক্সভর্তি করার অভিযোগ তোলা
হয়েছে, বিুব্ধ প্রার্থী দিনের প্রথম ভাগেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর
ঘোষণাও দিয়েছেন। অভিযোগ আছে, নির্বাচনী কেন্দ্রে যেতে ভোটারদের বাধা দেয়া হয়েছে।
প্রশাসন
ও দলীয় লোকদের এই পক্ষপাতদুষ্ট পরিবেশেও নির্বাচনী ফলাফল যা বেরিয়ে এসেছে, তা ৫ জানুয়ারির একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী দলটির নেতানেত্রীদের মুখের
হাসি কেড়ে নিয়েছে। এখন ভোটের ফলাফল নিয়ে এরা অনেক মুখরক্ষামূলক মন্তব্য করছেন। প্রথম
পর্বে অনুষ্ঠিত ৯৭টি উপজেলার নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপির ৪৪ জন, আওয়ামী লীগের ৩৪ জন, জামায়াতে ইসলামীর ১৩ জন, জাতীয় পার্টির একজন, বাকিরা অন্যান্য দলের বা স্বতন্ত্র। প্রতিটি উপজেলায়
একজন করে পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যানের আসন রয়েছে। এর বাইরে আছে একজন করে সংরক্ষিত মহিলা
ভাইস চেয়ারম্যান। পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপির ৩২ জন, আওয়ামী লীগের ২৪ জন ও জামায়াতে ইসলামীর ২৩ জন। জাতীয় পার্টির তিনজন ও অন্যান্য ১০ জন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে বিএনপি ৩৪, আওয়ামী লীগ ৩৪, জামায়াত ১০, জাতীয় পার্টি এক ও অন্যান্য তিনজন।
মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর ১০ জন বিজয়ী হয়েছেন। বিজয়ী ১৯২ জন
মহিলা ও পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে বিএনপির ৭২ জন, আওয়ামী লীগের ৬৩ জন, জামায়াতের ৩৩ জন, জাতীয় পার্টির আটজন ও অন্যান্য
১৯ জন।
এই ৯৭টি
উপজেলার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী
লীগের ছিল ৬৬ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪
জনে। অপর দিকে ২০০৯ সালের ১৪ জন থেকে ২০১৪ সালে বিএনপির বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ জনে। জামায়াতের
এই সময়ে ৮ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ জনে। আর জাতীয় পার্টির তিন থেকে কমে হয়েছে একজন।
অন্য পাঁচজন থেকে বেড়ে হয়েছে ছয়জন।
২০১৪ সালের
উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬২.৪ শতাংশ। আওয়ামী লীগের ৩৪ প্রার্থী ভোট পেয়েছেন প্রায়
১৬ লাখ। অপর দিকে বিএনপির ৪৩ প্রার্থী ভোট পেয়েছেন প্রায় ২৪ লাখ। ফলাফল বিশ্লেষণমূলক
এক প্রতিবেদনে দৈনিক প্রথম আলো গত ২১ ফেব্রুয়ারি মন্তব্য করেছে ‘উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপেই হোঁচট খেলো ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর মিত্ররা।’ গত ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ফুরফুরে
মেজাজে থাকলেও উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে বেশ হতাশ জোট নেতারা। লক্ষণীয়, আওয়ামী লীগের মিত্র এবারের সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সমর্থিত
চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মাত্র একটি উপজেলায় বিজয়ী হয়েছেন। ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি
বা জাসদের সমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীরা কেউই বিজয়ী হতে পারেননি। লক্ষণীয় এই
যে, বাম দলের নেতারা বেগম জিয়াকে স্বাধীনতাবিরোধী ও গণবিচ্ছিন্ন আখ্যায়িত
করে একবার পাকিস্তান চলে যাওয়ার প্রেসক্রিপশন দেন। সে যাই হোক, আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ে মোট উপজেলার অন্তত অর্ধেকে বিজয়ী হওয়ার আশা করলেও
দলটি মাত্র এক-তৃতীয়াংশ উপজেলায় বিজয়ী হয়েছে। সদ্যসমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের
৩২ দুর্গে হানা দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এককভাবে বিএনপি ২৫ আর জামায়াত সাতটিতে
আওয়ামী লীগের কাছ থেকে চেয়ারম্যান পদ ছিনিয়ে নেয়। এ ছাড়া পুরুষ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান
পদে ক্ষমতাসীন দলকে ধরাশায়ী করেন বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা। হাটহাজারীতে আওয়ামী
লীগের প্রার্থীর চেয়ে তিন গুণ ভোট পেয়ে হেফাজতে ইসলাম সমর্থিত প্রার্থী উপজেলা পরিষদ
চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছেন ১৮ হাজারের মতো ভোট
আর হেফাজত সমর্থিত প্রার্থী পেয়েছেন ৫৪ হাজারের মতো ভোট। তা ছাড়া হাটহাজারীতে যে দুইজন
ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের একজন বিএনপি সমর্থিত আর
অন্যজন জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত প্রার্থী। অনেকেই বলছেন, সরকারি দল ও তাদের সমর্থক দল-জোট এবং সরকারের প্রশাসনযন্ত্র যত জোরেশোরেই জামায়াতে
ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে প্রচারণা চালাক, সাধারণ মানুষ তা মেনে নিচ্ছেন না। মেনে নিলে উপজেলা নির্বাচনে তাদের জনসমর্থন
এভাবে বাড়তে দেখা যেত না।
একটি জাতীয়
দৈনিকের সংবাদ প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে ‘অনেকেই বলেন, উপজেলা-টুপজেলা কিছু নয়; বুধবার ৯৭টি উপজেলায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একটি জনমত
জরিপ হলো। আর সরকার এতে হেরে গেছে। জয় পেয়েছে বিএনপি। গত ২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন-পরবর্তী
জনমত জরিপের ফলাফল উল্টে গেছে, ইউএসএইড ও ইউকেএইডের অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক
ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনাল নির্বাচনের পর একটি জনমত জরিপ চালায়। এতে বিস্ময়করভাবে
ধারণা আসে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ
সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত। তাই ‘বিদেশী সংস্থার জরিপ’ ফল দেখিয়ে শাসক শিবিরে উল্লাস চলছিল। এখন কেউ কেউ বলছেন, ভাগ্যিস এ জরিপ-ফল প্রকাশিত হয়েছিল, না হলে এত সহজে উপজেলা নির্বাচন
নাও হতে পারত।
এই জাতীয়
দৈনিকটি এর আগের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি আরেকটি মন্তব্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করে ভোটারেরা হচ্ছেন এক দিনের বাদশা। পাঁচ বছরে একবার ব্যালটের মাধ্যমে জানান দেন
নিজেদের ক্ষমতার। দেশের মালিকেরা দেখলেন, তাদের কোনো কিছু না জানিয়ে ৫
জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সরকার গঠন হয়ে গেছে। তবে উপজেলা নির্বাচনের
অসহায় জনগণ তাদের ক্ষমতার বিষয়টি জানান দেয়ার সুযোগ পান। অন্য একটি দৈনিকের ভাষায় ‘এ যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো।’ ক্ষমতার কেন্দ্রে এ নির্বাচন
কোনো পরিবর্তন আনবে না। তবুও আপাত অসহায়, পর্যুদস্ত ভোটারেরা প্রমাণ করলেন, এরা নিজ সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন। দশম সংসদ নির্বাচনের পর যে বিএনপি-জামায়াত
জোটকে রাজনীতি থেকে আউট মনে হচ্ছিল, উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বে
সে জোটই সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজেলায় বিজয়ী হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা
বলছেন, প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে ১৯ দলীয় জোটের বড় ধরনের জয় হয়েছে।
অপর দিকে ১৯ দলীয় জোটবিরোধী শত অপপ্রচারের মধ্যেও সরকারের জনপ্রিয়তা যে কমেছে, সে বার্তা পাওয়া গেছে। তাদের অভিমত, এ নির্বাচনের ফলাফল শিগগিরই সব
দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১৯ দলীয় জোটের ও অন্যান্য
আরো রাজনৈতিক দল ও দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল ও সুশীলসমাজের দাবিকে আরো জোরালোভাবে যৌক্তিক
করে তুলল। জানি না, সরকারি দল এবার এ ব্যাপারে কী ধরনের সাড়া দেয়। এ-ও
জানা নেই, সরকার জনমতের প্রতি ইতিবাচক সাড়া দেবে, না নতুন কোনো অপকৌশল খুঁজবে, এই বিতর্কিত সরকার নিয়েই পাঁচ
বছর ক্ষমতায় থাকার জন্য অপচেষ্টায় নামবে, পরবর্তী উপজেলা নির্বাচনকে আরো
বিতর্কিত করে তোলার জন্য আরো বেশি অনিয়মের আশ্রয় নেবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
প্রথম
পর্বের উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল দেখে শাসক দল ও জোট বিব্রতকর পরিস্থিতিতে যে পড়েছে, সে কথা সহজেই অনুমেয়। ফলে পরবর্তী আরো কয়েক দফা নির্বাচনে শাসক দল ইমেজ রক্ষায়
যে মরিয়া হয়ে উঠবে, তেমনটি উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর এ ক্ষেত্রে শাসক দলের
সমর্থকেরা কেন্দ্র দখল, ব্যালটবাক্স ছিনতাই, ব্যালট ছিনিয়ে ইচ্ছেমতো সিল মারা, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্র
থেকে বের করে দেয়া, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নানামুখী
চাপের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল পাল্টে দেয়ার মতো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকবে, এমন আশঙ্কাও করছেন অনেকে। এখন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এসব আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে অবশিষ্ট পর্বের উপজেলা নির্বাচনগুলোকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ রাখার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। নির্বাচন আচরণবিধি
কঠোরভাবে যাতে সব পক্ষ মেনে চলে, সে বিষয়টি সরকারপক্ষ ও ইসিকেই কার্যত নিশ্চিত করতে
হবে। প্রথম পর্বে সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাসক দলের অনুকূলে পক্ষপাতমূলক আচরণের যে
অভিযোগ উঠেছে, তেমনটি যেন আর না ঘটে; ইসিকে তা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ
মানুষ যেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মুখ থেকে না শোনেন ‘এত বড় নির্বাচন, সেখানে অনিয়ম কিছু ঘটবেই।’ সরকারকে সচেতনতার সাথে মনে রাখতে হবে, তেমনটি যদি আবারো জনগণ ঘটতে দেখে, তবে শাসক দলের জনপ্রিয়তা আরো কমবে বৈ বাড়বে না।
এবার জাতীয়
সংসদে বিতর্কিত প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা কোন তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে, তা এ দলের নেতাকর্মীদের নতুন করে ভেবে দেখতে হবে। এ নির্বাচনে প্রমাণ হয়ে গেছে, জাতীয় পার্টি ‘সরকারেও আছে, বিরোধী দলেও আছে’ এমন অবস্থান নিয়ে কার্যত আওয়ামী লীগের পেটের ভেতর চলে গেছে। এবার হজম হয়ে বর্জ্য
হওয়ার পালা। এখনো সতর্ক না হলে অদূর ভবিষ্যতে দলটি অস্তিত্বহারা হলেও অবাক হওয়ার কিছু
থাকবে না। তা ছাড়া প্রথম পর্বে একটি মাত্র উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির বিজয়ী
হওয়ার পর এ দলটির সুবিধাবাদী অপকৌশলী নেতা রওশন এরশাদের বিরোধীদলীয় নেতা থাকার নৈতিক
অধিকারটিই তিনি হারিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার দলের লোকেরা সরকারে থাকলেও
সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকা তিনি পালন করবেন। যদি তাই হয়, তবে তার উচিত জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এখনই তার বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে
পদত্যাগ করে শিগগিরই একটি জাতীয় নির্বাচনের দাবি সরকারের কাছে তোলা, যে নির্বাচন হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সব দল তাতে অংশ নেবে।
আরেকটি
বিষয় এ উপজেলা নির্বাচনে প্রমাণ হলো, সরকারপক্ষের মতলবি প্রচার অনুযায়ী
জামায়াত কোনো জনবিচ্ছিন্ন দল নয়, বরং এটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক জনসংশ্লিষ্ট দল।
আর একটি জনসংশ্লিষ্ট দলকে কখনোই আদালতের রায়ে বা সরকারের নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা
কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে না। সমস্যাটি রাজনৈতিক। জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল।
এর ভালো-মন্দ থাকবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সেই ভালো-মন্দ বিচার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়ই
সম্পন্ন করতে হয়। আর সেখানে মুখ্য বিচারক হচ্ছে দেশের মালিক জনগণ, প্রতিপক্ষ দলবিশেষ নয়। এখানে আরেকটি বিষয়, জনধারণা ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে
ইসলামি ধারার দলগুলোকে বারবার সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী আখ্যায়িত
করে সরকার কার্যত বামপন্থীদের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করে চলেছে। বিষয়টি দেশের সাধারণ মানুষ
স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামকেও সরকার একটি সন্ত্রাসবাদী দল হিসেবে
প্রমাণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। বিষয়টি অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে আহত করে।
এ মুহূর্তে
বিএনপি ও এ দলের নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটকে শতভাগ সতর্ক থাকতে হবে অবশিষ্ট উপজেলাগুলোর
নির্বাচনে শাসক দল যেন ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, ব্যালটপেপার কিংবা ব্যালটবাক্স ছিনতাই ও কোনো কেন্দ্রের ফলাফল পাল্টাতে না
পারে।
আরেকটি
বিষয়, বর্তমান সরকার বিগত পাঁচ বছর কার্যত উপজেলা পরিষদকে অকার্যকর করে
রেখেছে। উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করে রাখা হয়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্যকে এবং
উপজেলা পরিষদকে এই এমপি উপদেষ্টার উপদেশ শোনা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে আইন করে।
এবার যেহেতু সব এমপিই আওয়ামী লীগের কিংবা এর মিত্র দলের, অতএব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান যে হোন তাকে
বাধ্যতামূলকভাবে চলতে হবে এই সরকারি এমপির অঙ্গুলি হেলনে। নির্বাচিত প্রতনিধি দিয়ে
গঠিত একটি জনপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের আশা-আকাক্সার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য যে ধরনের
আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা থাকা দরকার, সেটুকু উপজেলা পরিষদের নেই। মাঠপর্যায়ের
সরকারি কর্মকর্তাদের তাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে
উপজেলা প্রশাসনের ওপর এমপিদের দায়িত্বে বসানো হলো কোন যুক্তিতে; তা ছাড়া তা কতটুকু গণতান্ত্রিক সে এক ভিন্ন প্রশ্ন। তা ছাড়া বর্তমান শাসকপক্ষ
অগণতান্ত্রিক আইন করে কিভাবে উপজেলা প্রশাসনকে অকার্যকর করে রাখার বিষয়টি পাকাপোক্ত
করে রেখেছে সে এক লম্বা ফিরিস্তি। সেই ফিরিস্তিতে যাওয়ার অবকাশ এখানে একদম
নেই। অতএব, আজ এখানেই থামতে হচ্ছে। তবে শেষ প্রত্যাশা, সরকার ও ইসি যেন অন্তত অবশিষ্ট উপজেলা নির্বাচনগুলোতে জনমতের প্রতিফলন নিশ্চিত
করার ব্যাপারে যথাসচেতন হন।
সবশেষে
একটি রূপক গল্প। এক ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে একদম সহ্য করতে পারেন না। একদিন শুনলেন, প্রতিবেশীর ছেলে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এই ব্যক্তি বললেন, স্কুলে ভর্তি হলেও পাস করতে পারবে না। ছেলেটি স্কুলের সব কাস পাস করল। ওই ব্যক্তি
বললেন স্কুল পাস দিলেও কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। ছেলেটি কলেজে ভর্তি
ও পাস করল। ওই ব্যক্তি যথারীতি বললেন কলেজে পাস করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি হতে পারবে না; কিন্তু ছেলেটি যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও পাঠ
শেষ করল। ওই ব্যক্তি বললেন বিশ্ববিদ্যালয় পাস করলেও চাকরি পাবে না। ছেলেটি
যথারীতি চাকরিও পেল। ওই ব্যক্তি বললেনÑ চাকরি পেলেও বেতন পাবে না। কাউকে
সহ্য করতে না পারার কী নিদারুণ উদাহরণ। তেমনি আমার আওয়ামী সমর্থক এক বন্ধু বললেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বিএনপি-জামায়াতের যতজনই পাস করুক, এরা বাধ্যতামূলকভাবে আমাদের আওয়ামী এমপিদের উপদেশই শুনতে বাধ্য হবেন। আইন তাদের
মানতেই হবে।
গোলাপ মুনীর
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন