আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত মহান শহীদ দিবস। বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের মার্চে অধ্যাপক গোলাম আযম প্রমুখের নেতৃত্বে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৫২ সালের এই দিনে তার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল। সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেছিলেন। সে মিছিলের ওপর পুলিশ গুলী চালিয়েছিল। গুলীতে প্রাণ হারিয়েছিলেন রফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা কয়েকজন ভাষা-সংগ্রামী। মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাদের এই আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের পথ বেয়েই বাংলা রাষ্ট্রভাষার অবস্থান ও সম্মান অর্জন করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনেও রয়েছে ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা ও অবদান। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে গোটা বিশ্বকেও অনুপ্রাণিত করেছে। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে প্রায় ছয় হাজার ভাষা থাকলেও মাতৃভাষার স্বীকৃতি ও মর্যাদার জন্য বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশে আন্দোলনের উদাহরণ ও ইতিহাস নেই। এজন্যই আমাদের শহীদ দিবস তথা একুশে ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনন্য মর্যাদা। বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের সংগ্রাম ও অবদানের কথা স্মরণ করে দিনটি এখন পৃথিবীর সব দেশেই পালন করা হয়। একুশের চেতনায় এবং এর অন্তর্গত তাৎপর্যে বিশ্বের সব দেশের মানুষই এখন উজ্জীবিত হয়। তারাও নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার তাগিদ বোধ করে। ভাষা আন্দোলন এবং একুশে ফেব্রুয়ারির এই সফলতা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যার কৃতিত্ব এদেশের ভাষা-সংগ্রামী ছাত্র-জনতার।
আজকের দিনে গৌরবোজ্জ্বল সে ইতিহাস স্মরণ করার পাশাপাশি দুঃখ ও ক্ষোভের কথাও উল্লেখ করা দরকার। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয়টি দশক এবং স্বাধীনতা অর্জনের পর ৪২ বছর পেরিয়ে এলেও বাংলাভাষাকে এখনও যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ও সমৃদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। বরং এ বিষয়ে আমাদের রয়েছে শোচনীয় ব্যর্থতা। কারণ পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সবক্ষেত্রে বাংলাভাষার যথাযথ প্রচলন এখনও ঘটেনি। অথচ সবক্ষেত্রে প্রচলন ও প্রতিষ্ঠা ঘটানোর বুকভরা আশা নিয়েই ভাষাসৈনিকরা সংগ্রাম করেছিলেন, রক্ত ঝরিয়েছিলেন এবং জীবন দিয়েছিলেন। এ কথা সত্য, বাংলাদেশের সাহিত্য অনেক উন্নতি করেছে, বাংলাভাষাও ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলা ব্যাকরণ নিয়েও চলছে নিরন্তর গবেষণা। পাশাপাশি আবার এ সত্যও স্বীকার করতে হবে যে, এখনও আমরা সুনির্দিষ্ট এবং সর্বজনগ্রাহ্য একটি বানানরীতি অনুসরণ করার মতো উন্নত স্তরে পৌঁছাতে পারিনি। কাটিয়ে উঠতে পারিনি বহুমাত্রিক অভিধানের অভাবও। এমনকি বাংলা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বানানরীতিতে এখনও রয়েছে অনেক পার্থক্য। তারা একই বানানরীতি অনুসরণ করছে না। উচ্চারণের ক্ষেত্রেও চলছে বিশৃঙ্খল অবস্থা। টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের বানান ও উচ্চারণে মোটেই শৃঙ্খলা রক্ষা করা হচ্ছে না। তেমন চেষ্টাও নেয়া হচ্ছে না সরকারিভাবে। বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার বাধ্যবাধকতা যেমন মানা হচ্ছে না, তেমনি আদালতের রায়ও লেখা হচ্ছে ইংরেজিতে। বিভ্রান্তিকর ও বিশৃঙ্খল এ পরিস্থিতির কারণে বাংলাভাষার ক্রম অগ্রগতি ও সুষম বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসবেরই পাশাপাশি একদিকে আন্তর্জাতিকতার নামে ইংরেজির ব্যাপক চর্চা চলছে, অন্যদিকে বিগত কয়েক বছরে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দির ব্যবহার হয়েছে সর্বাত্মক। ভারতের স্যাটেলাইট টিভির একচেটিয়া দাপটে বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা পর্যন্ত আজকাল হিন্দিতে কথা বলছে। হিন্দি ভাষার শুধু নয়, ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতিরও অনুপ্রবেশ ঘটছে এদেশের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে। বলা যায়, পাকিস্তান যুগের উর্দুর স্থান দখল করে নিয়েছে হিন্দি ভাষা। অথচ এই ভাষার প্রশ্নে ভিন্নমত ছিল বলেই বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষা-সংগ্রামীরা জীবন পর্যন্ত দিয়েছিলেন, বছরের পর বছর ধরে আন্দোলন তো করেছিলেনই। তারা নিশ্চয়ই উর্দুর স্থলে হিন্দিকে নিয়ে আসার জন্য আন্দোলন করেননি। আমরা মনে করি, বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা ও পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। যে কোনো মূল্যে এখনই হিন্দির সর্বব্যাপী আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা চাইÑ হিন্দি ও ইংরেজির প্রভাব কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া হোক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রতিষ্ঠিত হোক মায়ের ভাষা বাংলা। এভাবেই ভাষা শহীদদের প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো এবং একুশে ফেব্রুয়ারির মূল চেতনার বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সে লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করতে হবে অনতিবিলম্বে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন