বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মার্কিন সিনেটের শুনানি ও নতুন নির্বাচনের তাগিদ


মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির এক শুনানিতে বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনকে ‘অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ’ এবং ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর রবার্ট মেনেন্দেজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শুনানিতে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল তার রিপোর্টে বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো অংশ নেয়নি, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররাও এতে ভোট দেননি। তারও আগে ক্ষমতাসীন দল ও জোটের প্রার্থীরা অর্ধেকের বেশি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। শুনানিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য ওবামা প্রশাসনের প্রতিও আহবান জানিয়েছে কমিটি। সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত বছরের নবেম্বরে নিজের বাংলাদেশ সফর এবং সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বর্ণনা দিয়ে জানিয়েছেন, দুই নেত্রীকেই তিনি সংলাপের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পন্থা উদ্ভাবনের এবং সে অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার সে আহবান অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজন করেনি সরকার। মূলত ক্ষমতাসীনদের অনড় অবস্থানের কারণে নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের নেয়া সমঝোতার উদ্যোগও ব্যর্থ হয়ে গেছে। এসব কারণেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরপর মার্কিন সরকার খুব দ্রুত আরো একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের জন্য তাগিদ দিয়েছে, যাতে জনগণ তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়। শুনানিতে সংসদ নির্বাচন এবং সহিংসতা ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ডসহ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে। কমিটি অবিলম্বে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। বলেছে, গণতন্ত্রে সহিংসতা কাম্য নয়। এদিকে ঢাকায়ও একই আহবান জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। মঙ্গলবার ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএইড)-এর নতুন মিশন প্রধান জ্যানিনা জ্যারুজেলস্কিকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক বৈঠক শেষে রাষ্ট্রদূত মজিনা বলেছেন, সরকারের উচিত সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনের আয়োজন করা।
আমরা মনে করি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নে মার্কিন সিনেটের এই শুনানির বক্তব্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। বরং স্পষ্ট ভাষাতেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, নির্বাচনটি নিয়ে মার্কিন সরকার মোটেই সন্তুষ্ট নয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দেয়ার মধ্য দিয়েও মার্কিন সরকারের একই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। তারা শুধু এটুকু বলতেই বাকি রেখেছেন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ভিত্তিতে গঠিত বর্তমান সরকার কোনো বৈধ সরকার নয়। কথাটা আনুষ্ঠানিকভাবে না বললেও নতুন সরকারের সঙ্গে অতি শীতল ব্যবহার এবং র‌্যাব-এর প্রশিক্ষণের জন্য অর্থিক সহায়তা নিষিদ্ধ করার মতো বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছে, দ্বিতীয় মেয়াদে আগত সরকারের ব্যাপারে দেশটির যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। বস্তুত পর্যালোচনায় দেখা যাবে, মার্কিন সিনেটের শুনানিতে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য স্পষ্ট এবং কঠোর বার্তাই এসেছে। ক্ষমতাসীনদের উচিত এই বার্তার মূলকথা অনুধাবন করা এবং পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করার কল্পনাবিলাস পরিত্যাগ করে যত দ্রুত সম্ভব নতুন সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। একথাও বিশেষভাবে বুঝতে হবে যে, একমাত্র ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য মনে করেনি। ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাতেই প্রতিক্রিয়া Ÿ্যক্ত করেছে। ব্রিটেন এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সাহায্য-সহায়তা স্থগিত ও বন্ধ করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে। অন্য দেশগুলোও পর্যায়ক্রমে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সব দেশ সত্যিই তেমন অবস্থানে চলে গেলে  কোনো ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ই সরকারকে রক্ষা করতে পারবে না। অমন সম্বাবনার আলোকেই ক্ষমতাসীনদের উচিত মার্কিন সিনেটের আহ্বানে সাড়া দেয়া এবং বিশেষ করে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন করে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। এজন্য শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তই যথেষ্ট হবে না, সরকারকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের বিধানও সংবিধানে যুক্ত করতে হবে। নির্বাচনটি এমন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হতে হবে, যাতে কোনো রকম সহিংসতা না ঘটে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর যাতে দমন-নির্যাতন না চালানো হয় এবং যাতে সব দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। মার্কিন সিনেটের শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, অবিলম্বে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads