বিএনপি চেয়ারপারসন ও ১৯ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের উচিত অবিলম্বে পদত্যাগ করা এবং জাতীয় সংসদের নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়া। নিজের এই দাবির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেগম জিয়া বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোটারও ভোট দিতে যায়নি। সুতরাং অমন একটি নির্বাচন যেমন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না তেমনি ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আগত সরকারও বৈধতা পেতে পারে না। বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, বর্তমান সভ্য বিশ্বে কেবলই দু-একটি দেশের ‘সার্টিফিকেট’ জোগাড় করে কোনো অবৈধ সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে না। সুতরাং অবিলম্বে এই সরকারকে বিদায় নিতে বাধ্য করতে হবে এবং দেশকে যে কোনো উপায়ে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। পরবর্তী নির্বাচন প্রসঙ্গে বেগম জিয়া বলেছেন, সে নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যাওয়ার এবং ফ্যাসিবাদী হঠকারিতার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কেও ক্ষমতাসীনদের সতর্ক করেছেন খালেদা জিয়া। বলেছেন, ভাববেন না, আমরা অনির্দিষ্টকাল ধরে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে যাবো। জনগণও বেশিদিন সমঝোতার জন্য অপেক্ষা করবে না। এজন্যই সময় থাকতে সরকারকে সমঝোতায় আসতে বলেছেন তিনি। দেশজুড়ে চলমান গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এবং দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতারের অভিযানও বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন বেগম জিয়া। বলেছেন, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তাকে গ্রেফতার করে বিচারে সোপর্দ করা যায়। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এগোচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের পথে। এভাবে রাষ্ট্রীয় ও ক্ষমতাসীনদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানবাধিকারের চরম লংঘন করে দেশে মানবিক বিপর্যয় ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। এর ফলে চরমপন্থী ও জঙ্গিবাদী শক্তির উত্থানের পথ প্রশস্ত হচ্ছে। প্রতিবাদী তারুণ্যকে উগ্রবাদী পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহারের মাধ্যমে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করে তাদের ঘাতক বাহিনীতে পরিণত করছে সরকার। ‘বাইরের’ নির্দেশনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিরোধী দল নির্মূলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সীমান্ত অরক্ষিত রেখে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিকেও সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের কাজে ব্যবহার করছে। অবস্থা এতটাই বিপদজনক হয়ে পড়েছে যে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও আজকাল গুম, হত্যা ও গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বেগম খালেদা জিয়া অবিলম্বে এসব ফ্যাসিবাদী কর্মকা- বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে পরিচালিত আন্দোলন থেকে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন, সংখ্যালঘুদের ওপর সুপরিকল্পিত হামলা এবং গুম-খুন, দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতার পর্যন্ত জাতীয় জীবনের প্রতিটি বিষয়েই বলেছেন বেগম খালেদা জিয়া। বিরোধী দলকে নির্মূল করে ফেলার লক্ষ্যে চলমান ভয়ঙ্কর চেষ্টা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সরকারকে সতর্কও করেছেন তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না, কোনো একটি বিষয়েই সামান্য বাড়িয়ে বলেননি এই দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেত্রী। বস্তুত, বেগম জিয়া বলেছেন বলে নয়, পর্যালোচনায় দেখা যাবে, আসলেও একমাত্র ভারতের সমর্থন নিয়েই আবারও ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। জনসমর্থন পায়নি, জনসমর্থনের তোয়াক্কাও করেনি। অথচ জনসমর্থন এবং নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের প্রধান পূর্বশর্ত। অন্যদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ র্যাব ও পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর এবং ভারতের সমর্থনের ওপর নির্ভর করেছে। উদ্দেশ্যে অসততা রয়েছে বলেই নির্বাচনের পর মুহূর্ত থেকেই সরকার গুপ্তহত্যা এবং দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতারের মাধ্যমে বিরোধী দলকে নির্মূল করার পথে পা বাড়িয়েছে। এই অভিযানের শিকার হচ্ছেন বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সংগ্রামী ও দেশপ্রেমিক নেতা-কর্মীরা। এটা গণতন্ত্রবিরোধী এমন একটি পন্থা, যার পরিণতিতে দেশ এমনকি গৃহযুদ্ধের দিকেও এগিয়ে যেতে পারে। এমন গুরুতর মন্তব্য করেছেন বিদেশী গবেষকরা। আমরাও মনে করি, বেগম খালেদা জিয়া পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়নই উপস্থাপন করেছেন। কারণ, ভোটারদের অনুপস্থিতিই প্রমাণ করেছে, জনগণ ৫ জানুয়ারির প্রহসনের একদলীয় নির্বাচনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীনদের পরাজয়ই ঘটেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও একমাত্র ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রী সমর্থন জোগাড় করতে পারেননি। অনেক চেষ্টায় এবং ভারতের মধ্যস্থতায় দু-একটি দেশের ‘সার্টিফিকেট’ তিনি অবশ্য জোগাড় করেছেন, কিন্তু এ রকম ‘সার্টিফিকেট’ তার সরকারকে বৈধতা দিতে পারেনি। এর মধ্য দিয়ে বরং প্রমাণিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কোনো রাষ্ট্র ও সংস্থা নির্বাচনটিকে গ্রহণ করেনি। এমন প্রতিক্রিয়া সরকারের জন্য মোটেই শুভ হতে পারে না। সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য ও বিভিন্ন দাবিকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় বলে মনে করি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত সময় থাকতে বেগম খালেদা জিয়ার দাবি ও পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া। এজন্য গুম-খুন, দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে, খুলে দিতে হবে বন্ধ সব গণমাধ্যম। বড়কথা, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আরো একবার সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে। খালেদা জিয়ার দাবি ও পরামর্শ অনুযায়ী যত দ্রুত প্রধানমন্ত্রী এসব পদক্ষেপ নেবেন ততই দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য শুধু নয়, তাদের জন্যও মঙ্গল। আমরা মনে করি, একটি কথা প্রধানমন্ত্রীর অবশ্যই বিবেচনায় রাখা দরকারÑ যেখানে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, সমঝোতা ও সংলাপের জন্য তারা অনির্দিষ্টকাল ধরে আহ্বান জানিয়ে যাবেন না। জনগণও বেশিদিন অপেক্ষা করবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন