গত ৫ জানুয়ারি সারা বিশ্ব অবাক
বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল বাংলাদেশের একটি কলঙ্কিত নির্বাচন। ৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে
অনুষ্ঠিত এ কলঙ্কিত ও প্রহসনের নির্বাচন গণতন্ত্রের মুখে শুধু কালিমা লেপে দেয়নি, একে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। ভারত ও রাশিয়া ছাড়া এ নির্বাচনকে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের অভিমত হলো, এ নির্বাচনে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটেনি। কেননা নির্বাচনের আগেই ১৫৩ জন বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে ১৫৩টি নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা ভোটাধিকার
থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অন্য দিকে ১৪৭টি আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য অনুষ্ঠিত ৫
জানুয়ারির নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। অনেক কেন্দ্রেই
ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডাররা ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে। কোথাও কোথাও নির্বাচনী কর্মকর্তারাও
সিল মেরেছেন। এসব ভোট জালিয়াতি ও ভোট ডাকাতির সচিত্র সংবাদ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে।
সরকার ও নির্বাচন কমিশন তাদের মুখ রক্ষার্থে নির্বাচনকে জায়েজ করার জন্য ৫ শতাংশ ভোট
প্রদানকে ৪০ শতাংশ বানিয়ে নির্বাচনের দু’দিন পর তা প্রকাশ করেছে। প্রহসনের
এ নির্বাচন আবার প্রমাণ করল যে, নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো
বিকল্প নেই। এ নির্বাচন এটাও প্রমাণ করল যে, আওয়ামী লীগের অধীনে কখনো সুষ্ঠু
নির্বাচন সম্ভব নয় এবং আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিশ্বাসী নয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অনেকে নমিনেশন পেপার
দাখিল করতে পারেননি এবং অনেককে জোর করে হারিয়ে দেয়া হয়েছিলÑ যেমন মেজর (অব:) জলিল এবং কুমিল্লার ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশিদকে।
৫ জানুয়ারির
নির্বাচন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের পরম সুহৃদ ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা বলেছে, বাংলাদেশের কেউ বিজয়ী হয়নি। অন্য দিকে আনন্দবাজার পত্রিকা তার সম্পাদকীয়তে
বলেছে, বাংলাদেশে নতুন সরকার অবৈধ। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী
পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দলীয় শাসনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ।
এ দিকে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সরকার ও নির্বাচন
কমিশনের যৌথভাবে মঞ্চস্থ করা ট্রাজিকমিক বলে মন্তব্য করেছে।
আওয়ামী
লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, জামায়াত নির্বাচনে আসেনি বলে বিএনপি নির্বাচনে আসেনি।
এখানে প্রশ্ন হলোÑ অন্যান্য দল বিকল্প ধারা, জাসদ, কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ইসলামি দল কেন নির্বাচনে আসেনি? মূল কথা হলো, পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর থেকেই বিএনপি জোট তা
বাতিল ও নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করে আসছে, অন্যথায় তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল। একই অভিমত প্রকাশ
করে উপরোল্লিখিত দলগুলোও নির্বাচন বর্জন করেছে।
নিরপেক্ষ
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি জোট মিটিং-মিছিল
করতে চাইলে সরকার অনুমতি না দিয়ে স্বৈরাচারী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা
হরতাল, অবরোধ এবং সর্বশেষ কৌশল হিসেবে মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি দিলে সরকার
রাষ্ট্রক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ওই কর্মসূচি বানচাল করে দেয় এবং দমনপীড়নের পথ
বেছে নেয়।
শুধু তা-ই
নয়। কথা বললেই গ্রেফতার করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দলীয়
পেটোয়া বাহিনীর মতো আচরণ করে। ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের খুন-গুম করে দেশকে একটা সন্ত্রাসী
জনপদে পরিণত করেছে। এমন নির্যাতন-নিপীড়ন এবং সন্ত্রাস কেউ কখনো দেখেনি। এই কি গণতন্ত্রের
নমুনা? এই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?
তত্ত্বাবধায়ক
সরকারপদ্ধতি বাতিলের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে সম্প্রতি সাবেক প্রধান বিচারপতি এবি এম
খায়রুল হক বলেছেন, সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক বলে ওই পদ্ধতি বাতিলে তিনি
বাধ্য হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদের দ্বিতীয়
উপানুচ্ছেদে বলা হয়েছে : জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের
সর্বোচ্চ আইন...।
সব দলের
ও মতের লোকের সম্মতির ভিত্তিতেই তথা তাদের পরম অভিব্যক্তিরূপে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি প্রবর্তন
করা হয়েছিল। তাহলে এটা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলো কী করে? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে তাদের দলীয় মতাদর্শের এক লোক দিয়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা
বাতিলের লক্ষ্যে এক রিট মামলা দায়ের করায় এবং তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ও
আরো দু’জন বিচারপতি রিট দায়েরকারীর পক্ষে রায় দেয়, যা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি দায়িত্বহীন রায় এবং যা ছিল আওয়ামী লীগকে
সুবিধা পাইয়ে দেয়ার একটা সিদ্ধান্ত। এর খেসারত আজকে জাতিকে দিতে হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক
সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে যে এত প্রাণ অকালে ঝরে পড়েছে এর
দায় সরকারের পাশাপাশি বিচারপতি খায়রুল হককেও নিতে হবে।
সরকার
যেকোনো মূল্যে নিজের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং বিরোধী নেতাকর্মীদের
খুন-গুম করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ আঠারোদলীয় জোটকে সহিংসতার জন্য
অভিযুক্ত করা হয়েছে।
হেনরি
থোরের On civil Disobedience রচনার যা মহাত্মা গান্ধীর চিন্তাধারায়
দারুণ প্রভাব ফেলেছিল একটি বিখ্যাত উক্তি হলো : O be right is more honourable than to be law-abiding আন্দোলনের স্বাভাবিক তথা সাংবিধানিক
পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেই মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে। বিরোধী জোটকে মিটিং-মিছিল করতে দেয়া হচ্ছে
না। অথচ সরকারি দলের এবং এর অঙ্গসংগঠনের জন্য মিটিং-মিছিলে কোনো বিধিনিষেধ নেই। কখনো
মিটিং-মিছিল করার অনুমতি দেয়া হলেও নাশকতার অজুহাতে নানারকম শর্তারোপ করা হয়, যাতে লোকসমাগম কম হয়। মিটিং-মিছিলের আগে নেতাকর্মীদের পাইকারি হারে গ্রেফতার
করা হয়। এর ফাঁকে চলে গ্রেফতারবাণিজ্যও। আবার মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে দাবিদাওয়া করলে
সরকারের কানে পানি যায় না। হরতাল-অবরোধ করলেও সরকারের টনক নড়ে না। বাধ্য হয়েই অহিংস
জনতা সহিংস পন্থা অবলম্বন করে। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের
অধীনে নির্বাচন করলে তো হরতাল-অবরোধের প্রয়োজন হতো না। সহিংসতা এমনিতে বন্ধ হয়ে যেত।
সুতরাং রোগ সারাতে হলে রোগের কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
৫ জানুয়ারি
যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এই জনপদে এমন কলঙ্কিত নির্বাচন কেউ কখনো দেখেনি। নেহরু ডকট্রিন অনুসারে ভারত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে বশংবদ
রাখতে এবং এ অঞ্চলে তার প্রভাববলয় বিস্তার করতে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায়
রাখতে চায়। দিল্লির কুপরামর্শে আওয়ামী লীগ ভুল পথে চলছে। তাদের ভ্রান্তনীতির কারণে
আপাতত নগদ প্রাপ্তি ঘটলেও আখেরে তাদের পস্তাতে হবে।
৫ জানুয়ারির
নির্বাচন পিছিয়ে অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন করার দেশী-বিদেশী কোনো অনুরোধই প্রধানমন্ত্রীর
দম্ভ-অহমিকা এবং জেদের কাছে পাত্তা পায়নি। এ কারণে মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশ ছাড়া এ সরকারকে
কেউ অভিনন্দন জানায়নি। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘ ও বিদেশী রাষ্ট্রগুলোকে বিভ্রান্ত করতে
পারেনি। তারা বুঝতে পেরেছে যে যুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি রাজনৈতিক খেলা। আওয়ামী লীগ
ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক আরো অনেক দল আছে, যার মধ্যে বিএনপি বৃহত্তম দল।
প্রশ্ন
হলো এহেন একটি কলঙ্কিত নির্বাচন করে সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার কথা বলে কোন মুখে? সরকার কি বিবেক-অনুভূতিহীন হয়ে গেছে? সরকারের উপলব্ধি করা উচিত যে
ধোঁকাবাজি নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় থাকার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। এতে কোনো
গৌরব বা গর্ব নেই। নির্বাচন সম্পর্কে সুশীলসমাজের মন্তব্য হলোÑ দ্য অপারেশন ইজ সাকসেসফুল, বাট দ্য প্যাসেন্ট ইজ ডেড। এরশাদের
নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারেও আছে, আবার বিরোধী দলেও আছে; যে কারণে এ সরকার কিম্ভূতকিমাকার ধারণ করেছে।
৫ জানুয়ারি
যেনতেন একটি প্রহসনের নির্বাচন করে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটানো হয়েছে। এর দাফন
কখন, কিভাবে হবে তা দেখাই এখন বাকি। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বলেছে, এখন দেখার অপেক্ষায় এই জালিয়াতির নির্বাচন বাংলাদেশকে কতটুকু ডোবায়। জনভিত্তি
ও জনসমর্থনহীন সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, খালেদা জিয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের নেতা। যারা এ কথা বলছেন, তারা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তারা ভারতে শরণার্থী হিসেবে আমোদফুর্তিতে
দিন কাটিয়েছেন। অন্য দিকে খালেদা জিয়ার স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শুধু স্বাধীনতার
ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, রণাঙ্গনে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধও করেছেন
এবং পরে সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন।
সুষ্ঠু
ও সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার চেয়েও বেশি জরুরি সব দলের
অংশগ্রহণের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার দিয়ে দেশ পরিচালনা
করা। রাষ্ট্রযন্ত্র তথা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকা হবে
অনৈতিক ও অবৈধ। উল্লেখ্য, সব ক’টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে
জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের জনপ্রিয়তা বা জনসমর্থন এলো কোত্থেকে? সরকার যত হম্বিতম্বি করুক না কেন, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের
আয়োজন না করা পর্যন্ত সরকারকে একটি অপরাধবোধ নিয়েই সরকার পরিচালনা করতে হবে। এ থেকে
নিষ্কৃতির একমাত্র পথ হলো নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর সাথে অতিসত্বর সংলাপে বসে একটি
নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এটি যত দ্রুত করা যায় ততই মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন