শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

শিক্ষা, ধর্ম, রাষ্ট্র ও সেকুলারিজম


বিশ্ব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই বৈজ্ঞানিকদের মতে, প্রত্যেকটি সেল বা কোষের যেমন একটা নিউক্লিয়াস থাকে, তেমনি একটি আদর্শ হিসেবে সেকুলারিজমের উত্থানের আগে পর্যন্ত শিক্ষার নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্র ছিল ধর্ম। শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল একটি নৈতিক ভিত্তি সৃষ্টি করা, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি করা। এ কথা ইসলামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ইসলামী যুগের শুরুতে, মধ্যযুগে এবং অতি সম্প্রতিও ঔপনিবেশিক যুগের আগে পর্যন্ত, মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ছিল কুরআনের ওপর, হাদিস ও রাসূল (সা:)-এর সিরাতের ওপর বা ফিকহর ওপর। মোট কথা, এর সবগুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়ার সাথে সাথে ইতিহাস, ভূগোল, রাষ্ট্র পরিচালকদের কর্তব্য, সরকারি নীতিমালা অথবা শাসনকাজের নিয়ম-কানুন নিয়ে আলোচনা করা ও শিক্ষা দেয়া হয়েছে। হজরত আলী (রা:)-এর পক্ষ থেকে মালিক আল মুশতারকে পাঠানো চিঠিতে গভর্নর বা রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব কী, সে ব্যাপারে আলোকপাত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শুধু এ কথা প্রমাণ হয় যে, শিক্ষার মর্মমূলে ছিল ধর্ম বা ইসলাম তথা চরিত্র ও নৈতিকতা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞানের যা-ই শিক্ষা দেয়া হতো, তা ছিল এ মূলকে কেন্দ্র করে। বৌদ্ধদের ইতিহাসেও দেখা যায়, একই সত্যের পুনরাবৃত্তি। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষা দেয়া হতো তার মধ্যেও দেখা যায়, শিক্ষাব্যবস্থার মূলে ছিল চরিত্র বা বৌদ্ধধর্মের নৈতিকতা। এর সাথে এরা ভারতে প্রচলিত অন্যান্য বিদ্যাকেও শামিল করে নিয়েছিলেন। হিন্দুধর্মের প্রাথমিক যুগের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিদ্যা শিক্ষার মূল ছিল বেদ। ‘বেদ’ মানেই বিদ্যা। তাদের প্রাচীন দর্শনে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বেদ। অর্থাৎ শিক্ষার কেন্দ্র ছিল এই বেদই। এর সাথে যুদ্ধবিদ্যা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বা অর্থনীতি ও অন্যান্য শাস্ত্রও যোগ করা হয়েছিল প্রয়োজনকে সামনে রেখে।
খ্রিস্টানদের অতীতে গেলেও দেখা যায়, তাদের শিক্ষাও ছিল গির্জাকে কেন্দ্র করে। প্রত্যেকটা গির্জা একটা কলেজ বা শিক্ষালয় ছিল। সেখানে যা পড়ানো হতো, তার মূল ভিত্তি ছিল বাইবেল তথা ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট। এ থেকে একটা কথাই প্রমাণিত হয়, ১৮০০ শতাব্দীর শেষভাগে Enlightement Movement শুরু এবং যার ‘সন্তান’ হিসেবে সেকুলারিজমের উদ্ভব হয়। এর আগে পর্যন্ত শিক্ষা ওই রকমই ছিল। তার ফল এই দাঁড়িয়েছিল, বিভিন্ন বিদ্যার ক্ষেত্রে জানার পরিমাণ কমবেশি থাকলেও মানুষ নৈতিক দৃষ্টিতে ভালো ছিল। বেশিরভাগ মানুষ, তিনি হিন্দু হোন, বৌদ্ধ হোন, মানুষ হিসেবে দানশীল ছিলেন। অন্তত মানবিক গুণাবলির দৃষ্টিতে এরা আজকের চেয়ে ভালো মানুষ ছিলেন। অমানুষ ছিলেন না। ১৮০০ শতাব্দীর শেষে যে পরিবর্তন বা যে মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন হলো, তার আগে ইউরোপে দু’টি আন্দোলন হয়েছিল। প্রথমটি রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ। এটা ছিল আর্ট ও লিটারেচারের ক্ষেত্রে; ধর্ম বা রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়। এর পরেরটি হচ্ছে, রিফরমেশন মুভমেন্ট বা সংস্কার আন্দোলন। এর অর্থ, খ্রিস্টান চার্চের মধ্য থেকেই আপত্তি উঠল যে, পোপই কি বাইবেলের একমাত্র ব্যাখ্যাদাতা? এর কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলতে চাইÑ এরই ফলে চার্চ নানাভাবে বিভক্ত হলো, যেমন লুথারের নেতৃত্বে লুথারীয় চার্চ, কেলভিনের নেতৃত্বে কেলভিনবাদী চার্চ, ব্রিটিশ যাজকদের নেতৃত্বে অ্যাঙ্গলিকান চার্চ, বাপ্টিস্ট চার্চ ও অন্যান্য। এর সবগুলোকে একত্রে বলা হয়ে থাকে প্রটেস্টান্ট মুভমেন্ট, যেটা হলো রিফরমেশনের ফল। তৃতীয় যে আন্দোলন হলো সেটা হয়েছিল ফ্রান্সে। এর শুরু মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের নামে।
১৮০০ শতকের শেষে এবং ফরাসি বিপ্লবের আগে ও পরে এর প্রভাব বজায় রইল। যেকোনো কারণেই হোক, এই আন্দোলনের বেশিরভাগ নেতা ছিলেন নাস্তিক বা গুপ্তনাস্তিক কিংবা নাস্তিকের মতো। মানব ইতিহাসে এই প্রথম এরা এ দর্শন নিয়ে এলেন যে, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাজ থেকে ধর্মকে বিদায় করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ব্যাপারে ধর্মের কোনো ভূমিকা থাকবে না। ধর্ম থাকতে হলে কারো অন্তরে থাকবে, যদি কেউ রাখতে চায়। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আইনসভা এসব থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে হবে। এ আন্দোলনের মূল বক্তব্য ছিল ওহি নয়, যুক্তিই জীবনের ভিত্তি হবে এবং আল্লাহর শাসন কায়েম হবে না। যে কারণেই হোক, এই আন্দোলন ইউরোপের তৎকালীন নেতৃত্বকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। এটা মোটামুটি গৃহীত হয়ে যায় এবং ক্যাথলিক বা প্রটেস্টান্ট চার্চ এটাকে বাধা দিয়ে কুলাতে পারেনি। এর ফল হয় ভয়াবহ, যা এখন আলোচনা করব। প্রথম কুফল হলো, এই শিক্ষা থেকে ধর্মকে আলাদা করা হলো।
এভাবে যে স্কুল ব্যবস্থা গড়ে উঠল তাতে মানুষ নিতান্ত স্বার্থপর হয়ে গড়ে উঠল। তারা ভোগবাদী হয়ে পড়ল। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে গেল। যে ধর্মের দ্বারা কোনো ‘কাজ’ হয় না, তার প্রতি সম্মানও কমে গেল। নীতিবোধের যে শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রাধান্য তা-ও লোপ পেল। নীতিহীনতা, স্বার্থপরতা নিয়ে মানুষ গড়ে উঠল। এই স্কুলে জেনারেলরা গড়ে উঠলেন, পলিটিশিয়ান ও চিন্তাবিদরা তৈরি হলেন। তাদের মনের গভীরে এই মনোভাব স্থায়ী হলো, জনসমাজের জন্য ধর্মের প্রয়োজন নেই, চাই সেটা পার্লামেন্ট, মার্কেট, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্যাংক যা-ই হোক না কেনো। এই যে ব্যক্তিগত এক ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠল, তার ভিত্তিতে তাদের সামাজিক আচরণ তৈরি হলো। এর ফলে সব ক্ষেত্রে তার প্রভাব কার্যকর হলো। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সোশ্যাল ডারউইনিজম প্রবেশ করল অর্থাৎ Survival of the fittest-কে মূলমন্ত্র করে নেয়া হলো। কেবল যোগ্যতমই টিকে থাকবে। এর অর্থ, যারা যোগ্যতম নয় তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক, কিছু আসে যায় না। প্রাকৃতিক ক্রিয়াকে আমরা বাধা দেবো কেন? এভাবেই কোনো জাতি যদি এ উপমহাদেশের লোক হয়ে বা আফ্রিকা বা চীনের লোক হয়ে প্রতিযোগিতায় যোগ্যতম প্রমাণিত না হয় বা টিকতে না পারে, তারা হেরে যাবে। এখানে কোনো নীতিবোধ, দয়ামায়ার প্রয়োজন নেই। এটাই বরং যুক্তিযুক্ত যে, যোগ্যতমকে আমরা এগিয়ে দিলাম। এটাই ছিল সোশ্যাল ডারউইনিজম, যা ছিল খ্রিস্টান ধর্মের বিরোধী, ইসলামের বিরোধী। খ্রিস্টান ধর্ম বলেছে, তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাস, বলেছিল চ্যারিটির কথা। আর ইসলাম ‘ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে ব্যয়’ জাকাতের কথা বলেছে। এটা একটা বড় ব্যাপার। নিকটাত্মীয়দের প্রতি দায়িত্ববোধ একটা বড় ব্যাপার।
সেকুলারিজম বা মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন অর্থনীতির ক্ষেত্রে গডকে বাদ দিয়ে চিন্তা করার রীতি চালু করল। যে পুঁজিবাদ চালু হয়েছে ৫০০ বছর আগে, তা-ও বাস্তবে এত নীতিহীন ছিল না। খ্রিস্টান নীতিবোধ তার ক্রিয়াকে ‘মডারেট’ করত। অবশ্য তারা সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতাভিত্তিক মার্কেট চালু করেছিল। মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের আগ পর্যন্ত পুঁজিবাদের সেই ভয়াবহ চিত্র তৈরি হয়নি। কিন্তু পুঁজিবাদ যখন ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গী হলো, তখন ইউরোপে শ্রমিককে এমনভাবে শোষণ করা হলো, তাদের শুধু বেঁচে থাকার অবস্থায় রেখে দেয়া হলো; তা-ও শুধু উৎপাদনের স্বার্থে। পরে এর প্রতিক্রিয়াতেই কমিউনিজমের জন্ম হলো। সমাজতন্ত্রের উদ্ভব হলো। অর্থনীতির ক্ষেত্রে মুক্তবুদ্ধির মতবাদ বা সেকুলারিজম আরোপের ফল হলো, এই অর্থনীতির ক্ষেত্রে অমানবিকতা ও নীতিহীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং বলা হলো, এটা হচ্ছে পজিটিভ সায়েন্স; অর্থনীতি একটি অবিমিশ্র বিজ্ঞান; এর মধ্যে নীতিবোধ থাকবে না, নীতি থাকবে না। যেমনভাবে বাতাস বা পানির জন্য আমরা কোনো নীতি দিইনি, তেমনি অর্থনীতির কোনো নীতি থাকবে না। এটা নিজের গতিতে চলবে। এগুলোর পরিণাম অর্থনৈতিক সঙ্কট। এটা হয়েছে অতি লোভ ও অতি লোভের আকাক্সক্ষা থেকে এবং রিবা (সুদ) তাকে সাহায্য করেছে। সুদ না থাকলে এটা কখনোই হতো না। আমি এ পর্যন্ত মুক্তবুদ্ধি আন্দোলন ও সেকুলার আন্দোলনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছি। এর অন্য ফল হলো, মানুষ মুখে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ভ্রাতৃত্বের কথা বলল; কিন্তু একই সাথে সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানরা দুনিয়া বিজয়ে বের হয়ে গেল। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, হল্যান্ড প্রায় সারা দুনিয়া দখল করে নিলো। দুই আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফ্রিকার প্রায় ১০০ শতাংশ এবং এশিয়ার প্রায় ৭০ শতাংশ দখল হলো। তা করতে গিয়ে এরা পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হলো এবং ওইসব দেশের স্থানীয়দের সাথে পর্যন্ত যুদ্ধ করল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মুক্তবুদ্ধির অনুসারীরা সারা দুনিয়া জয় করল। তাদের নীতিহীনতা এই জয় এনে দিলো। কেননা, কোনো নীতিবাদী সমাজ এভাবে পররাজ্য আক্রমণ করতে পারে না, দখল করতে পারে না। এরা লুট করল বিশ্বকে। আফ্রিকার মতো একটা সমৃদ্ধ মহাদেশকে এরা বিরান করে ফেলল। লোহাসহ নানা ধরনের খনিজসম্পদ, স্বর্ণ, হীরা, সব কিছুই তারা লুট করে নিলো।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্পেনীয়রা লুট করল। ব্রিটিশ আমাদের বাংলাদেশকে লুট করল, যেমন আফ্রিকাকে করা হয়েছে। লুটতরাজ ছিল তাদের আসল কাজ। তার মানে হচ্ছে, সেকুলারিজমভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় তৈরি হওয়া লোকরা মানুষকে চরমভাবে শোষণ করল। তারপর এরা বলল, আমরা তাদের সিভিলাইজ করেছি। যারা নিজেরা সিভিলাইজড না তারা অন্যকে কিভাবে সিভিলাইজ করবে? তারা যখন বণিক হিসেবে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে এসেছিল, তখন মুঘল সম্রাটের যে কালচার, যে রিফাইনমেন্ট, যে এটিকুয়েটি ছিল, তার ধারে-কাছেও এ বণিকরা ছিল না। তাদের রাজনৈতিক আচরণটাই ছিল নীতিহীনতা। তারা পরস্পর মারামারি করল। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড ভারতের দখল নিতে চেষ্টা করল। শেষে ইংল্যান্ড একাই অঞ্চলটা দখল করল। অনুরূপভাবে আমেরিকায় ফ্রান্স, ব্রিটেন ও স্পেনীয়রা লড়াই করল। অবশেষে দক্ষিণ আমেরিকা স্পেনের আওতায় গেল। উত্তর আমেরিকা গেল ব্রিটিশের আওতায়। আফ্রিকায় ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি ও পর্তুগাল লড়াই করল। পর্তুগাল মোজাম্বিক এলাকা নিলো। ডাচরা সাউথ আফ্রিকাসহ কিছু এলাকা নিয়ে গেল। মাগরেব বা উত্তর আফ্রিকা নিলো ইতালি ও ফ্রান্স। ওমর মোখতারের ফিল্মে এর কাহিনী রয়েছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধর্মকে বাদ দিয়ে যে মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন করা হলো, তার মাধ্যমে কী ধরনের লোক তৈরি হলো। তারা দুনিয়া দখল করে বেড়াল। লুটতরাজ করল। নিজেদের মধ্যে লড়াই করল। কিন্তু শান্তি আনল না। এর ফল হলো, তারা দুনিয়াকে শান্তি দিতে পারল না। তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ করল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করল। পাশ্চাত্য সভ্যতার গর্ভ থেকে চারটি অত্যন্ত ক্ষতিকর মতবাদের জন্ম হয়েছে। ফ্যাসিজম, কমিউনিজম, ক্যাপিটালিজম ও সেকুলারিজম। এগুলো কেবল ডেমোক্র্যাসি ছাড়া ভালো কিছু করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। স্রষ্টাকে যারা কোনো স্থান দিতে রাজি নয়, তারা পরিবার ও জেন্ডার ইস্যুতে পশুর মতো হয়ে গেল। তারা মনে করল, পরিবারের গুরুত্ব নেই। এটি হলো নারীদের দাবিয়ে রাখার একটি প্রতিষ্ঠান তাদের দাস বানানোর জন্য। তারা বরং পশুর মতো থাকাই ভালো মনে করল। পরিবার করার কোনো প্রয়োজন নেই। তারপর যদি কেউ পরিবার গঠন করেও, তবে এটা হবে সন্তান জন্মদানের জন্য। তা পশুর মতোই হবে। এমন হতে পারে, একটা কমিউন হবে। সে কমিউনে ১০০ জন পুরুষ ১০০ জন নারী থাকবে। কার শিশু কেউ জানবে না। সবাই মিলে শিশুদের পালবে। তারা এমন একটা ধারণাও নিয়ে এলো যে, তত দিন পর্যন্ত একটা পশু তার বাচ্চা পালে, যত দিন পর্যন্ত নিজের খাবারটা নিজে খেতে না পারে। তত দিন পর্যন্ত বাঘও পালে, কুকুরও পালন করে যত দিন পর্যন্ত বাচ্চা নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে। মানুষকেও তা-ই করতে হবে। মনোভাব এমন, ‘কেন ৩০ বছর পর্যন্ত খাটব আমি? কেন আমি ত্যাগ স্বীকার করব? সন্তান জন্ম নিয়েছে এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে; সে এখন বড় হয়েছে। সে নিজের কাজ করে বেড়াক। আমার কোনো দায়িত্ব নেই। আমার স্বার্থ কেন ত্যাগ করব? আমি কেন আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাদ দেবো?’
সুতরাং পরিবারের যে বর্তমান দুর্দশা সেটা অনেকটা সেকুলার মতাদর্শের কারণেই। আরো খারাপ হতে পারত, কিন্তু খ্রিস্টবাদের যেটুকু প্রভাব এখনো রয়েছে, তার জন্য অতটা হয়নি। যতটা ভালো থাকল, তা সম্পূর্ণভাবে খ্রিস্টান মতাদর্শের কারণে। আর যতটা মন্দ হলো তা এই মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের কারণে; জীবন ও নৈতিকতাকে আলাদা করার সেকুলার মতাদর্শের কারণে। এর সমাধান কী? আমার জানা মতে, দু’ভাবে এর সমাধান হতে পারে। একটা হলো, মুসলিম হিসেবে আমরা আল্লাহর কাছে তার নিদর্শনার দিকে যাই বা নিজেদের সোপর্দ করি। সব সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে, মুক্তবুদ্ধির মিথ্যা দর্শন। তাদের কথা হচ্ছে, গডকে বাদ দাও। অথচ তাকেই সবচেয়ে কাছে রাখতে হবে। তাকে সব সময় অবলম্বন করতে হবে। তার ওপর আস্থা রেখেই জীবনযাপন করতে হবে। তার কাছে আমরা সবদিক দিয়ে আবদ্ধ, দায়বদ্ধ। তাকে বাদ দেয়া চলবে না। এটা হলো মুসলিম হিসেবে আমাদের বক্তব্য। হিন্দু হিসেবে যদি কেউ বলে, তাহলে বলতে হবে স্রষ্টার দিকে যাওয়া, নৈতিকতার দিকে, ধর্মের দিকে ফিরে যাওয়া। তাই সমাধান হিসেবে বলছি, যেভাবেই হোক, মানুষকে নৈতিক শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নৈতিক শিক্ষার জন্য ধর্ম ছাড়া আর কোনো ভিত্তি নেই। এ সঙ্গত উল্লেখযোগ্য সেকুলারিজমের সঠিক অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। এর অর্থ ধর্ম অসংশ্লিষ্টতা বা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্ম বর্জনবাদ। “মুসলিম দেশে ইসলামকে ভিত্তি করতে হবে এবং অমুসলিমদের বিকল্প থাকবে। অমুসলিমদের দেশে তাদের ধর্মকে কেন্দ্র করে তাদের নৈতিকতার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেখানে মুসলিমদের জন্য বিকল্প থাকবে বলে আশা করি।”
এভাবে যদি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তবে আশা করা যায়, ভালো মানুষ তৈরি হওয়া শুরু হবে। ভালো লোক তৈরি হলে সব ক্ষেত্রে ভালো ফল আসবে। সব ক্ষেত্রেই ভালো লোক তৈরি হবে। রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবার সব ক্ষেত্রে। শুধু থিওরি দিলেই কিছু হবে না। আর আমার কথাতেই সবকিছু বদলে যাবে না। তবে মানবতাকে পুনরুদ্ধারের কাজ তো শুরু করতে হবে। এ কথাও আমরা জানি, অসম্ভব বলে কিছু নেই। প্রাসঙ্গিক আরো কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বিজ্ঞানের বিরোধী ছিল বলে খ্রিস্টিয়ান চার্চের বিরুদ্ধে বক্তব্য, এটা কতটা প্রোপাগান্ডা আর কতটা সত্য, জানি না। এটা খতিয়ে দেখতে হবে। যদি এ রকম কিছু হয়ে থাকে, তাহলে তা ভুল ছিল। চীন ও ভারতে বিজ্ঞান অনেক উৎকর্ষ লাভ করেছে। এখানে বিজ্ঞানীদের কখনো বিরক্ত করা হয়নি। মুসলিমদের হাতে বিজ্ঞান উৎকর্ষ লাভ করেছে। মুসলিম ইতিহাসে বিজ্ঞানীদের ওপর কোনো অত্যাচার হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। খ্রিস্টবাদের মধ্য যুগে যেটা হয়েছে, তাকে জেনারেলাইজ করা মোটেও ঠিক হবে না। কে বলতে পারবে যে কোনো আন্দোলন, সেটা কমিউনিস্ট হোক, গণতান্ত্রিক হোক তার মধ্যে কোনো ত্রুটি হয়নি? খ্রিস্টবাদকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেয়া তাদের অতি প্রতিক্রিয়া। তারা শুধু বলতে পারত, ‘এটা ঠিক না; এটা দেয়া যাবে না। বিজ্ঞানকে নিজের পথে চলতে দিতে হবে।’
এখানে উল্লেখ করতে চাই ইসমাইল আল রাজীর বই তওহীদে উল্লিখিত মন্তব্যের কথা। তিনি বলেছেন, God is not against science, god is the condition of science, not an enemy of science. আল্লাহ আছেন বলেই তিনি একটা শৃঙ্খলা স্থাপন করেছেন। এটা আছে বলেই বিজ্ঞানের সূত্র বের করা সম্ভব হয়েছে। আল্লাহ না থাকলে কোনো শৃঙ্খলা থাকত না, কোনো বিজ্ঞানও সৃষ্টি হতো না। বিজ্ঞানের কারণে যে উন্নয়ন হয়েছে, কোনো ধর্ম তাতে হস্তক্ষেপ করেনি। খ্রিস্টিয়ান ইউরোপে যে দুই-একটা উদাহরণ পাওয়া যায়, সেটাকে তাদের ভুল বলে গণ্য করতে পারি। কিন্তু খ্রিস্টান নেতৃত্ব বা পোপরা কেউই বিজ্ঞানের বিরোধী নন। আমরা বুঝতে পারি যে, মানবজাতি ছিল মূলত ধার্মিক, সেটাকে সেকুলাররা সেকুলারমনা করে দেয়। তাদের আবার ধার্মিকমনা করতে হবে। ইসলামীমনা করতে হবে। ধার্মিকমন ও সেকুলারমনের মধ্যে পার্থক্য কী? ইসলামী মন হচ্ছে, সেই মন যে কোনো সমস্যা হলে যার এ সমাধান খোঁজে কুরআন ও সুন্নাহতে। তারপর অন্যান্য দিকে। অন্যদিকে সেকুলার মন চিন্তা করে না আল্লাহর কিতাবে কী আছে, সেভাবে আমাদের যুক্তিবাদী প-িতরা কী বলেছেন; রাজনৈতিক প-িতরা কী বলেছেন বা রাশিয়া, চীন, আমেরিকা, কানাডা কী করেছে। তারা দুনিয়াকে ধার্মিকমন থেকে সেকুলারমনে নিয়ে গেল। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সারা দুনিয়াকে একটা নৈতিক ছকে নিয়ে আসা; ধার্মিকমনকে ফিরিয়ে আনা। ‘সেকুলার’ শব্দটির ব্যবহার হয়েছে মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের পরে, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে। মুক্তবুদ্ধির ধারণা গ্রহণ করে পুরো শিক্ষিতসমাজ মোটামুটি সেকুলার হয়ে গেছে। আমাদের অসংখ্য লোক নামাজী, আবার সেকুলার। তারা সমস্যার সমাধান ইসলামে খোঁজেন না। এসব সেকুলারমনকে ইসলামি মনে পরিবর্তন করতে হবে। এজন্য তাদের কিছু মৌলিক বই পড়াতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। আশা করি যথাযোগ্য চেষ্টা করলে আমরা সাফল্য লাভ করব, ইনশাআল্লাহ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads