শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪
আলকায়েদার অডিও এবং রাজনীতির কায়েদা
Posted on ২:২৪ PM by Abul Bashar Manik
বহুলালোচিত ওসামা বিন লাদেনের
উত্তরসূরি আয়মান আল জাওয়াহিরি। মিসরের এই নাগরিক একসময় সার্জেন বা শল্যচিকিৎসক ছিলেন।
এখন তার বিশ্বাস, সশস্ত্র ‘অপারেশন’ই সাম্রাজ্যবাদ কবলিত বিশ্বের
চিকিৎসার জন্য জরুরি। এ জন্য বোমাবাজি, হত্যা, আত্মঘাতী হামলা তথা সহিংসতাকে বৈধ মনে করেন তারা। শ্মশ্রুমণ্ডিত ও পাগড়ি পরিহিত
জাওয়াহিরি মিসরীয় উচ্চারণে আরবি ভাষায় বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এই রহস্যপুরুষ কারো মতে, বিন লাদেনের মতো ভয়ঙ্কর এক ব্যক্তি। কেউ মনে করেন, তিনি হাল ধরলেও আলকায়েদা এখন একটি ভাঙা নৌকা।
সবাই লক্ষ করেছেন, দূর দেশের আলকায়েদার কথিত বার্তা আমাদের দেশের বেকায়দায় পড়া একটি মহলকে প্রতিপক্ষ
জব্দ করার কিছুটা হলেও কায়দা করে দিয়েছে। এ দিক দিয়ে তারা এই ইস্যুতে রাজনৈতিক বেনিফিশিয়ারি
হতে চেয়েছেন। বাস্তবে এসব বার্তার গুরুত্ব থাক বা না থাক, তাৎক্ষণিক গলাবাজি করে কোণঠাসা বিরোধী দলকে আরো খানিকটা চেপে ধরতে বিলম্ব হবে
কেন? জাওয়াহিরির ‘বার্তা’ জঙ্গিদের স্বরূপ যতটা উন্মোচন
করেছে, এ ইস্যুতে তার চেয়ে আমাদের রাজনীতির কদর্যস্বরূপ কম উন্মোচিত হয়নি।
তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়ার আগেই আলকায়েদার দোষ চাপিয়ে ফায়দা লোটার প্রবণতা এ ক্ষেত্রেও
দেখেছে দেশবাসী।
কথিত অডিও বার্তা ইস্যুর সূচনাতেই
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। যেমন- ক) এটা আদৌ আলকায়েদার কি না। খ)
এ বার্তার কণ্ঠটি আল জাওয়াহিরির কি না। গ) যে সূত্র এটা প্রচার করেছে, তা কতখানি নির্ভরযোগ্য ইত্যাদি। যথাযথ তদন্তেই এ সব কিছুর জবাব পাওয়া যাবে।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে দু’টি বিষয় সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করছে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত। একটি হলো, ‘বার্তা’টি কি নতুন? যদি তা না হয়, তাহলে কেন নতুন করে পুরনো ঘটনা
নিয়ে এত হৈ-হল্লা? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জন্য আসলেই কি জঙ্গিরা এখনো অতোটা বিপজ্জনক, যেমনটি প্রচার করছেন কিছু রাজনীতিক ও মিডিয়াম্যান।
সচেতন নাগরিকেরা বার্তাটি নতুন
করে প্রচারের প্রেক্ষাপটের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন এবং বলছেন, কোনো অঘটনের মোটিভ বা মতলব উপলব্ধির বেলায় এর বেনিফিশিয়ারি কারা, সে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া নিছক আতঙ্ক ও আবেগ কিংবা আগে থেকেই বদ্ধমূল
ধারণা দিয়ে কোনো ঘটনার বিশ্লেষণ মোটেও উচিত নয়। বরং যথাযথ অনুসন্ধান, তথ্য, যুক্তি, সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপরই নির্ভর করে থাকেন বিবেক, কাণ্ডজ্ঞান ও বিবেচনাবোধের অধিকারী মানুষ।
আলকায়েদার বলে কথিত যে অডিও বার্তা
নিয়ে এত বাগি¦তণ্ডা, বিষোদগার, মিডিয়ার হামলে পড়া; এটি প্রায় তিন মাস পুরনো। জানা গেছে, এবার এ বার্তা নিয়ে প্রপাগান্ডা
শুরুর ৮০ দিন আগেই একটি অনলাইন পত্রিকায় অডিওটির ওপর খবর বেরিয়েছিল। তারিখটি ২৯ নভেম্বর
২০১৩। এই বার্তা আলকায়েদার হোক বা না হোক, তবে বেশ কায়দা করে বানানো। আসল
কথা হলো, এত দিন পরে কেন এত তোলপাড়?
সংশ্লিষ্ট সব প্রশ্নের জবাব মিলবে
যদি বাস্তবেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গভীর অনুসন্ধান চালানো সম্ভব হয়। বার্তাটি
নিয়ে প্রচারণার এই বিশেষ সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করাকে অনেকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন।
জিএসপি নিয়ে অব্যাহত উদ্বেগের
মাঝে ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ হয়ে এসেছে আরেক পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্রের
সিনেট পররাষ্ট্র কমিটির দ্বিতীয় শুনানিতে জানিয়ে দেয়া হলো, বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা না হলে যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশে শুধু এমন প্রকল্পের জন্যই সাহায্য দেবে, যেগুলোতে এমপিদের ভূমিকা রাখার
সুযোগ নেই। অর্থাৎ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে মার্কিন প্রশাসন বিষম নাখোশ বাংলাদেশ
সরকারের ওপর। সিনেটের আলোচনায় তাদের ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। এর আগে ঢাকায় প্রচার
করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ৫ জানুয়ারির পর গঠিত সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
কিন্তু ওয়াশিংটন তা অস্বীকার করায় আমাদের সরকার পড়ে যায় বেকায়দায়।
জাওয়াহিরি আসলেই বার্তাটি দিয়েছেন
কি না, সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত নন। কণ্ঠ নকল করা অসম্ভব নয় এবং এর বহু
নজির রয়েছে। নানা উদ্দেশ্যেই এটা করা হয়। সাধারণত অসৎ উদ্দেশ্যেই এভাবে প্রতারণা বা
ব্ল্যাকমেইল করা হয়ে থাকে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র্যাবের
এক পরিচালক বলেছেন, বার্তাটি জাওয়াহিরির কণ্ঠে প্রদত্ত কি না, তারা নিশ্চিত নন। কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো- যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী একজন বাংলাদেশী
অধ্যাপক ডেইলি স্টারে লিখে দাবি করেছেন, তিনি জাওয়াহিরির কণ্ঠস্বর চেনেন।
তবে তিনি বার্তায় জাওয়াহিরির কণ্ঠের বিষয়ে ‘নিশ্চিত’ হলেও পুরোপুরি নন, ‘প্রায় নিশ্চিত’। এই অধ্যাপকের নাম তাজ হাশমি।
পুরো নাম তাজুল ইসলাম। একসময় চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের
শিক্ষক ছিলেন।
জাওয়াহিরির ‘বার্তা’ ছড়ানোর অভিযোগে টাঙ্গাইলের একজন টেক্সটাইল ছাত্র গ্রেফতার হয়েছে
১৮ ফেব্রুয়ারি। তার নাম রাসেল বিন সাত্তার। র্যাব তাকে ধরে ঢাকায় এনে হাতকড়া পরা অবস্থায়
সংবাদ সম্মেলনে দেখিয়েছে। র্যাব এই তরুণ ব্লগার সম্পর্কে বলেছে, সে আলকায়েদার বার্তাটি আইডি ও ব্লগের সাহায্যে প্রচার করেছে। সে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক
নিবন্ধ প্রচার করেছে, যাতে জেহাদি স্লোগান এবং বোমা বানানোর নিয়মের উল্লেখ
আছে। ‘জেহাদি’ স্লোগানের ধরন কেমন, তা জানা যায়নি। র্যাবের মতে, ‘দাওয়াহ ইলাল্লাহ’ ওয়েবসাইটে গত বছর ৩০ নভেম্বর সর্বপ্রথম জাওয়াহিরির বক্তৃতাটি প্রচারিত হয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের পরিচালকের
বক্তব্যের পরে অভিযুক্ত রাসেল সাংবাদিকদের জানায়, সে নিজে ইউটিউবে ভিডিও বার্তাটি
আপলোড করেনি। আর ‘দাওয়াহ ইলাল্লাহ’ কারা চালায়, সে ব্যাপারে তার জানা নেই কোনো কিছু। অপর দিকে আলোচ্য বার্তাটির কণ্ঠ আলকায়েদার
শীর্ষ নেতার কি না, এ প্রশ্নের জবাবে র্যাব পরিচালক উইং কমান্ডার হাবিবুর
রহমান বলেন, র্যাব এ বিষয়ে নিশ্চিত নয়।
কথিত বার্তা নিয়ে সংসদে সেই পুরনো
প্রবণতা লক্ষ করা গেল। গরহাজির নয় শুধু, বিএনপি-জামায়াত এখন সংসদের ধারেকাছেও
নেই নির্বাচনের বাইরে থাকায়। তাদের মুণ্ডুপাত করার বীরত্ব প্রদর্শিত হলো। সরকারি দলের
কয়েকজন এমপি মনে করলেন- তদন্ত ও প্রমাণ পরের কথা, আগে প্রতিপক্ষকে জব্দ করে নিই।
বলা হলো, এই বার্তার সাথে বিরোধী দলের বক্তব্যের মিল আছে। অতএব যত দোষ ওই ‘কেষ্টা ব্যাটা’র। যদি এটাই সমালোচনার ভিত্তি হয়, তাহলে সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা, প্রগতির ধ্বজাধারীরা কী বলবেন? সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনের কথা, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা
আজো অনেকে জোর দিয়ে বলে থাকেন। ভারতের মতো বাংলাদেশেও বামপন্থী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা
সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা। আবার একই স্লোগান দিয়ে গলাকাটায় বিশ্বাসী বাম ‘জঙ্গি’রা হত্যা-সহিংসতার তৎপরতাও কম চালাচ্ছে না। দুই দেশেই তারা আতঙ্কের
কারণ। বক্তব্যে মিল থাকায় কি বলা যাবে, ওই বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকেরাও
রক্তপাত আর খুনোখুনির পথে ক্ষমতায় যেতে চান? যদি তা না হয়, তাহলে কার সাথে কার বক্তব্যের মিল আছে, শুধু সেই অজুহাতে এবং কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ
ছাড়াই আমরা যেন প্রতিপক্ষ ঘায়েল করায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে না উঠি। এতে শুধু নিজেদের হীনতাই
প্রকাশ পায় এবং জনগণের মাঝে কমে যায় বিশ্বাসযোগ্যতা।
বিএনপি-জামায়াতকে পছন্দ করে না, এমন একটি প্রভাবশালী পত্রিকায় জাওয়াহিরির অডিও বার্তা ইস্যুতে আওয়ামী লীগকে
দায়ী করা অনুচিত বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে। তবে একই সাথে বলা হয়েছে, ‘এই বার্তা নিয়ে সরকারের লোকজনের কণ্ঠে যেসব রাজনৈতিক কথাবার্তা উচ্চারিত হচ্ছে, বিশেষত বিএনপি, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে আলকায়েদা বা জঙ্গিবাদের
সাথে জড়িয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তার ফলে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমে যেতে পারে।’
পাশ্চাত্যের অনুকরণে বাংলাদেশ-ভারতসহ
সর্বত্র আলকায়েদা-তালেবান, তথা সহিংস জঙ্গিদের সাথে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে অহিংস
পন্থায় যারা ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েমের সংগ্রাম করতে চান, তাদেরও। এটি করা হয় সুপরিকল্পিতভাবে ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে। দেখা যায়, ইসলামের নামে চরমপন্থার অনুসারী উগ্র সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কর্মকাণ্ডের দায় চাপানো
হয় যারা নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আদর্শ কায়েমে বিশ্বাসী, তাদের ওপর। মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, মধ্যযুগীয় প্রভৃতি লোভনীয় বিশেষণসহযোগে
উগ্রপন্থী, মধ্যপন্থী, সশস্ত্র-নিরস্ত্র, নির্বাচনমুখী ও নির্বাচনে অবিশ্বাসী নির্বিশেষে ‘ইসলামপন্থী’ দল, সংগঠন ও ব্যক্তিকে একাকার করে
প্রপাগান্ডা মেশিন ব্যস্ত রাখা হয়। অনেক সময়ে অজ্ঞতাবশত হলেও, বহু ক্ষেত্রে বিদ্বেষের কারণেই, জেনেশুনে এটি করা হচ্ছে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতে এমন সংগঠনকেও জঙ্গিবাদের দায়ে বারবার বিনা প্রমাণে আসামি
বানানো হচ্ছে, যারা নিজেরাই চরমপন্থী জঙ্গিদের আত্মঘাতী বা ওঁৎ পাতা হামলার শিকার, যাদের নেতারাও হয়েছেন এভাবে হতাহত। কিন্তু তাদের আদর্শিক প্রভাব, সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থনের কারণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের (বিশেষত ক্ষমতাসীন
হলে) কথা একটাই- Give the dog a bad name and kill it. বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘জামায়াত’-এর মতো ‘জঙ্গি’ও হট অ্যান্ড টেস্টি ইস্যু। সেকুলার, বামপন্থী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী মহল মনে করে, এই দু’টি ইস্যু রাজনৈতিক বিপণির লোভনীয় পণ্য। তবে অতি ব্যবহারে এগুলোর আকর্ষণ যেমন
কমছে, তেমনি এসব নিয়ে সরকারের স্ববিরোধিতাও প্রকট হয়ে উঠেছে। যেমন এক
দিকে বলা হয় জামায়াতের প্রতি কোনো জনসমর্থন নেই। বড়জোর ২ শতাংশ ভোটার ওদের সমর্থক।
আবার জামায়াতকে দেখানো হয় ভয়ঙ্কর ও বিরাট প্রতিপক্ষ হিসেবে (ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন
সিংয়ের মতে, বাংলাদেশে ২৫ শতাংশ মানুষই ‘জামায়াতি’)। এক দিকে জঙ্গিদের নির্মূল করার কৃতিত্ব দাবি করে আওয়ামী লীগ, অপর দিকে জঙ্গিবাদকে দেশের সবচেয়ে বড় বিপদগুলোর একটি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
এভাবে একই ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা ঊর্ধ্বতনপর্যায়ে হরদম বলায় নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা
যে হ্রাস পাচ্ছে, সে খেয়াল ক্ষমতাসীনদের নেই।
মিডিয়ার হইচই, বিতর্কিত সংসদে বিষোদগার এবং কোনো কোনো ‘বিশেষজ্ঞ’-এর বিশেষ অজ্ঞতাপ্রসূত গলাবাজির সারবত্তা কতটুকু, তা সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্যে স্পষ্ট। বর্তমান সরকার এ যাবৎ আলকায়েদা-তালেবানসহ
জঙ্গিবাদ ইস্যুকে ব্যবহার করে এসেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় ও হয়রানি করার একটি প্রধান
হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু জাওয়াহিরির কথিত বার্তাটিকে সে সরকারই গুরুত্ব দিচ্ছে না। তবে
ক্ষমতাসীন মহল ‘বার্তা’টিকে লুফে নিয়ে অভ্যাসমাফিক বিএনপি-জামায়াতকে ধোলাই
দিতে এক মুহূর্তও দেরি করেনি।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা
মেজর জেনারেল অব: তারেক আহমেদ সিদ্দিকী মনে করেন না যে আলকায়েদার এই বার্তা বাংলাদেশের
জন্য বিশেষ কোনো আতঙ্কের কারণ। তিনি বলেছেন, যে হুমকি এতে এসেছে, তা নিয়ে আমরা বিচলিত নই। বাংলাদেশে আলকায়েদার যোগাযোগ নতুন নয়। বর্তমান সরকার
সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমনিতেই
খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি পূর্ণমন্ত্রী না থাকায় বর্তমান প্রতিমন্ত্রীর গুরুত্ব বেড়েছে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আলকায়েদার কথিত বার্তা প্রসঙ্গে বলেছেন, আমরা ভীতিকর কোনো তথ্য পাইনি। তদন্তের পর বলা যাবে আসল ব্যাপার কী।
ক্রিকেট এখন আর শুধু খেলা নয়।
এটি বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব অর্জন করছে। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট
টিমের বাংলাদেশ সফর নিয়ে শঙ্কা ছিল সন্ত্রাসের কারণে। সামনেই এ দেশে ক্রিকেটের এশিয়া
কাপ ও টি-২০ বিশ্বকাপ। এগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ওপর দেশের সুনাম ও সরকারের সাফল্য
অনেকখানি নির্ভর করছে। এর মধ্যে আলকায়েদার কথিত বার্তা নিয়ে হইচই।
কিন্তু ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন
শিকদার বলেছেন, এ বার্তা এশিয়া কাপ কিংবা টি-২০ বিশ্বকাপে কোনো প্রভাবই ফেলবে
না। বার্তাটি ভুয়া বলে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
আলকায়েদার ‘বার্তা’টি নতুন না পুরনো, কণ্ঠটি কার, প্রচারের সূত্রটি নির্ভরযোগ্য কি না- এসব বিষয়ের পাশাপাশি এই সংগঠনসহ জঙ্গিরা
এখনো দানব না জুজু, এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
প্রথম আলোয় গত শুক্রবার একটি
নিবন্ধ ছাপা হয়েছে আলকায়েদার ওপর। এতে বাংলাদেশে ‘ইসলামি জঙ্গি ভাবাদর্শ’ নিয়ে তৎপরতার ব্যাপারে আশঙ্কা করে সরকারকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি
কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য রয়েছে জঙ্গিদের বর্তমান শক্তি ও অবস্থান সম্পর্কে। বলা হয়েছে-
০১. সংগঠন হিসেবে আলকায়েদা এখন আর আগের মতো সংগঠিত নয়। ০২. বাংলাদেশে জঙ্গিতৎপরতা দৃশ্যমান
নয় ২০০৭ সালের পর থেকে। বিশেষত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার
পর এখানে জঙ্গিদের প্রভাব ক্রমেই কমেছে। দমনাভিযানে এখন বাংলাদেশে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো
চরম কোণঠাসা। ০৩. আলকায়েদা, তালেবান, লঙ্কর-ই-তৈয়েবা কিংবা ভারতকেন্দ্রিক
জঙ্গিদের সাথে এ দেশের জঙ্গিদের গোপন যোগাযোগ হয়তো এখন আগের মতো নেই। ০৪. জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো
সুসংগঠিত নয় এবং জাওয়াহিরির আহ্বানে সক্রিয় হতে পারে বিচ্ছিন্নভাবে।
ইসলামে চরমপন্থা তথা সন্ত্রাসবাদ
ও সহিংসতার ঠাঁই নেই। মুসলমানদের বলা হয়েছে উম্মাতুল ওয়াসাত বা মধ্যপন্থী জাতি। অকারণ
মানবহত্যা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ, সে মানুষ যে ধর্মেরই হোক না কেন।
বলা হয়েছে, ‘একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে
হত্যার সমতুল্য।’ ইসলামে এভাবেই সন্ত্রাস সহিংসতাকে ঘৃণা এবং মানবতাকে উচ্চকিত করা
হয়েছে। ধর্মের কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে, ইসলাম কিংবা সমাজতন্ত্রের নামে, জিহাদ কিংবা ক্রুসেডের ধুয়া তুলে হত্যা, হিংসা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসের বর্বরোচিত তাণ্ডব কখনো সভ্য মানুষ মেনে নিতে
পারে না।
বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম
মুসলিম রাষ্ট্র এবং এ দেশের মানুষ ধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাসী। তারা এক দিকে যেমন ধর্মান্ধতার
বিরোধী, অপর দিকে ধর্মহীনতা ও ধর্মবিদ্বেষকেও সহ্য করবে না। ইসলামের সুমহান
মানবিক ও শান্তিকামী আদর্শে জনগণ উদ্বুদ্ধ বলেই তারা অসাম্প্রদায়িক এবং এ দেশে উগ্রবাদী
বাম বা ডানপন্থী জনমনে ঠাঁই পায়নি। এ জন্য এখানে জঙ্গিবাদ তত বড় হুমকি নয় যতটা দেখানো
হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থে। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর পূর্বোক্ত নিবন্ধে উপসংহার টানা হয়েছে
‘এ দেশে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো সামাজিক সমর্থন ইসলামি জঙ্গিরা
পায় না। তাদের পালিয়ে থাকতে হয় শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকেই নয়, সমাজের কাছ থেকেও। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো মহল তাদের ব্যবহার করতে না চাইলে
এবং রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থার মধ্যকার কোনো অংশ গোপনে তাদের মদদ না দিলে এ দেশে জঙ্গিদের
পক্ষে বড় ধরনের কিছু করা অত্যন্ত কঠিন।’
আলকায়েদা ও জাওয়াহিরি ইস্যুর
ডামাডোলে তার কথিত বার্তায় এ দেশের পরিস্থিতির যে উল্লেখ রয়েছে, তা আড়ালে চলে যাচ্ছে। জাওয়াহিরি আসলেই এই বার্তা দিন বা না দিন, বাংলাদেশের কেমন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ইস্যুটি
তৈরি হতে পারল, তাও গুরুত্বপূর্ণ। অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে অনেকেই সুযোগ নিতে
চাইবে এবং সঙ্গত-অসঙ্গত নানা প্রতিক্রিয়া হবে- এটিই স্বাভাবিক। আমরা জাওয়াহিরি মার্কা
জঙ্গিদের নিয়ে মেতে উঠে যেন বাংলাদেশের চরম রাজনৈতিক সঙ্কট, মানবাধিকার হরণ, দমনপীড়ন, সহিংস রাজনীতি, জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি বিস্মৃত না হই।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন