বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বর্তমান গণতন্ত্র প্রসঙ্গে


গণতন্ত্র নিয়ে এখন নানা কথা হচ্ছে। তর্ক-বিতর্কও চলছে। গণতন্ত্রের তত্ত্ব আর প্রয়োগের মধ্যে বাস্তব অবস্থাটি নির্ধারণ করা হচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হয় না যে, দেশে বা বিদেশে কেউই তৃপ্ত। সবার মধ্যেই হা-হুতাশ। কেন? কারণ আলোচনা করাটা তাই প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প-িত থেকে সাধারণ মানুষ এখন সে আলোচনায় লিপ্ত। বিশেষত একুশের মাসে এ প্রসঙ্গে আলোচনা জরুরি। কারণ একুশের চেতনার সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। একুশের চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামই গণতান্ত্রিকতার চেতনাদীপ্ত মশালকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। তাই এই একুশে গণতন্ত্রের আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
প্রকৃত অর্থে, ব্যক্তি-মানুষের মতোই গণতন্ত্রও দুই পা দিয়ে চলে। এক পায়ে চলতে পারে না। গণতন্ত্রের এক পা হলো সরকারি দল, আরেক পা বিরোধী দল। একটি পা অতি শক্তিশালী হলে আর অন্য পা দুর্বল হলে গণতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে হাঁটতে-চলতে পারে না। একারণেই সঠিক গণতন্ত্রে সরকারি দলের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলের সরব উপস্থিতিও অপরিহার্য। গণতন্ত্র তাই সরকারি দলের পাশাপাশি শক্তিশালী বিরোধী দলের কথাও বলে। তত্ত্বগতভাবে গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে স্বৈরতান্ত্রিকতা ও একদলীয় চরিত্র হতে রক্ষা করতে যোগ্য এবং কার্যকর বিরোধী দলের দায়িত্বশীল ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং নম নম আনুগত্য কাম্য নয়। সরকারি ও বিরোধী দলের আইনানুগ পারস্পরিক সম্পর্ক এবং আত্মমর্যাদাশীল কার্যক্রমের ভিত্তিতেই গণতন্ত্র সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে কাজ করে। গণতন্ত্রের শিক্ষা এবং নিয়মও এমনই। গণতন্ত্রে যখন যোগ্য বিরোধী দল না থাকে, তখন বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত হন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশেও এমন অবস্থা হয়েছিল এবং তখন প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক চিন্তিত হয়েছিলেন। সে কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে এ বিষয়টি জানতেও চেয়েছিলেন। মনীষী আহমদ ছফা কর্তৃক জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে রচিত গ্রন্থ যদ্যাদি আমার গুরু গ্রন্থের সেই অংশটি এখানে হুবহু উদ্ধৃত করছি ‘কথায়-কথায় আমি জিগাইলাম, আপনের হাতে ত অখন দেশ চালাইবার ভার, আপনে অপজিশানরে কী করবেন? অপজিশান ছাড়া দেশ চালাইবেন কেমনে? জওহারলাল নেহরু ক্ষমতায় বইস্যাই জয়প্রকাশ নারায়ণরে কইলেন, তোমরা অপজিশান পার্টি গইড়্যা তোল। শেখ সাহেব বললেন, আগামী ইলেকশনে অপজিশান পার্টিগুলো ম্যাক্সিমাম পাঁচটার বেশি সিট পাইব না। আমি একটু আহত হইলাম, কইলাম, আপনে অপজিশানরে একশো সিট ছাইড়্যা দেবেন না? শেখ সাহেব হাসলেন। আমি চইল্যা আইলাম। ইতিহাসে শেখ সাহেবরে স্টেটসম্যান অইবার একটা সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না।’
ইতিহাসের সুযোগ কাজে লাগানো সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় সবসময়ই সঠিক কথাটি মুখের ওপর বলতেন। তিনি ছিলেন অতি প্রবীণ এবং শিক্ষকদেরও শিক্ষক। নির্ভীক, অকৃতদার এবং নির্লোভ এই ব্যক্তিত্বের পক্ষে সঠিক কথাটি বলা যত সম্ভব, অন্য কারও পক্ষে ততটুকু সম্ভব নয়। এমন নমস্য-প্রাজ্ঞ-প-িতের কথা শোনা হলে লাভ বৈ ক্ষতি হতো না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রও প্রবল শক্তিশালী সরকারি দল আর অতি দুর্বল বিরোধী দলের সমন্বয়ে খুঁড়িয়ে বা ভারসাম্যহীনভাবে হাঁটতো না। গণতন্ত্রের দুটি পা সবল না হলে যে সেটা খঞ্জ হয়ে যায়, এ সত্য অনুধাবণ করা হলেই গণতন্ত্রের মঙ্গল সুনিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উপলব্ধি এখনও প্রাসঙ্গিক। বিশ্বব্যাপী সবাই যথাযথভাবে জন ও দলীয় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার কথা যখন বলেন, তখন পূর্ণ মেয়াদে কাজ চালানোর অভিলাষ এক পায়ে হাঁটার নামান্তর। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য এক পায়ে হাঁটা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপজ্জনক। এ বিপদ যত তাড়াতাড়ি দূর করা যায়, গণতন্ত্রের জন্য ততই ভালো। এটা দলীয় লাভ-ক্ষতির বিষয় নয়, গণতন্ত্রের সামগ্রিক কল্যাণের বিষয়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাস এবং পথচলা নতুন নয়। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলেও গণতন্ত্র আর জনগণের অধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। বাংলাদেশ আমলেরও অনেকটা সময় গেছে গণতন্ত্রের সংগ্রামে, আত্মত্যাগে, মিছিলে। সেই গণতন্ত্র দল বা ব্যক্তির বিষয়-সম্পত্তি নয়; জনগণের সম্পদ। সেই গণতন্ত্র যখন সমস্যায় আক্রান্ত হয়, তখন পুরো জনতাই সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হয়। এই চিন্তা স্বাভাবিক। কারণ দেশে সুশাসন, উন্নয়ন ইত্যাদি ত্বরান্বিত করতে হলে গণতান্ত্রিক পরিবেশের বিশুদ্ধ চর্চার বিকল্প নেই।
গণতন্ত্র কখনও দলীয় বিষয় নয় এবং আমার জন্য গণতন্ত্র, তোমার জন্য স্বৈরতন্ত্র, এমন দ্বিমুখী বিষয়ও নয়। তত্ত্বগতভাবে গণতন্ত্র সবার জন্য সমান ও ন্যায়সঙ্গত সুযোগের নিশ্চয়তা দেয়। সরকারকে যেমন ক্ষমতা দেয়, বিরোধী দলকেও তেমনি কিছু অধিকার দেয়। সব অধিকার ও সুযোগ কেবল সরকারের বা একক কোনো দলেরÑ এমনটি গণতন্ত্রের কথা নয়। এজন্যই গণতন্ত্রের দুটি পা’কেই শক্তিশালী ও মজবুত রাখতে হয়। একটি পা শক্তিশালী করে অন্য পা’কে দুর্বল করে রাখা তাই গণতান্ত্রিক চেতনার বিরোধী।
বইপত্রে এবং মানুষের প্রত্যাশায় যে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, সেটা সবল গণতন্ত্রেরই কথা। গণতন্ত্রের আদর্শ দেশগুলোতে যে চিত্র দেখা যায়, সেটাও সরকারি ও বিরোধী দলের সমন্বয়ের ভারসাম্যপূর্ণ গণতন্ত্র। এর বাইরের যে চিত্র, সেটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য এবং প্রকৃত, সেটাও বিবেচনার যোগ্য। মানুষ যেমন নিজেকে নিয়ে ভাবে, সমাজ, সংসার, পরিবেশ, পরিস্থিতি নিয়ে ভাবে, তেমনিভাবে রাজনীতি নিয়েও ভাবে। গণতন্ত্রের ভাবনাও মানুষের চিরন্তন। সে ভাবনায় মানুষ ইতিবাচক চিত্রটিকেই দেখতে চায়। নেতিবাচক বা চাপিয়ে দেয়া চিত্রটিকে চায় না। জনগণের ভাবনা ও চিন্তার বিষয়টি একটি স্বাধীন সত্তাকে অনুসরণ করে চলে। চাপিয়ে দিয়ে বা বলপ্রয়োগ করে আর যাই হোক, চিন্তাকে বদলানো বা রূপান্তর করা যায় না।
সাবেক নাস্তিক-কমিউনিস্টরা ৭০ বছর পৃথিবীকে চাপাচাপি করেছে। ঈশ্বরহীন সমাজের কথা বলেছে। মার্ক্স, লেনিনকে অসীম ক্ষমতার আসনে নিয়ে গেছে। কিন্তু ফল হয়েছে, বিশ্বের নানা দেশে এইসব নেতার মূর্তি ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। মানুষ ধর্ম ও বিশ্বাসের কাছে ফিরে এসেছে। অতএব, চাপ দিয়ে নীতি, আদর্শ বা বিশ্বাস বদলানো যায় না। সেটা করতে গেলে বরং হিতে বিপরীতই হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ শতবর্ষ ধরে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে যে গণতান্ত্রিক চেতনা প্রবাহ ধারণ করছে, সেটাকেও এক ফুঁৎকারে নিভিয়ে দেয়া অসম্ভব। একদলীয় পরীক্ষা এখানে সফল হয়েছে বলা যাবে না। অতীতের অভিজ্ঞতাও এক্ষেত্রে ভালো নয়। মানুষ বরং বিশ্বাসের দিক থেকে আস্তিকতা আর আদর্শের দিক থেকে গণতন্ত্রকেই গ্রহণ করেছে। গণতান্ত্রিকভাবে এদেশে রাজনৈতিক ইস্যুতে মানুষ সিদ্ধান্ত জ্ঞাপন করেছে। এই চিরায়ত পথ ও পন্থাই গণতন্ত্রেও গৌরবের পথ। সবল গণতন্ত্রের পরিচয়বাহী। বাংলাদেশের এই পরিচয়ই আসল কথা। ইতিহাস ও ঐতিহ্যও সে কথাই বলে। রাজনীতি যারা করেন, তারাও এই শাশ্বত পথ ও পন্থায় চললে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হবে। নচেৎ ছন্দ পতনের সমূহআশঙ্কা ও ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। আমরা গণতন্ত্রের জন্য কোনো ঝুঁকি দেখতে চাই না; আশাবাদ ও সম্ভাবনাই দেখতে চাই। একুশের মাসে সমগ্র জনতাও গণতান্ত্রিক চেতনা প্রবাহে ধৌত হয়ে সামনের দিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা পোষণ করে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads