মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ব্যর্থতা আড়াল করার অপকৌশল এবং জঙ্গিতত্ত্বের ট্যাবলেট


নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার এবং অন্তরালের আসল ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য সরকারের নেয়া অপকৌশল দেশব্যাপী আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। গত রোববার সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জেএমবির তিনজন দ-িত জঙ্গিকে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আনার পথে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। হামলায় একজন পুলিশ সদস্য মারা গেছে। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে নিরাপত্তার বিষয়টি। সাধারণ মানুষও মনে করেন, যথোচিত নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না বলেই প্রিজন ভ্যান থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে এভাবে আসামী ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে সরকার এগিয়েছে বাঁকা পথে। সে কারণে আবারও কথিত বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু ঘটেছে একজনের। তার নাম রাকিব, সে ছিল মৃত্যুদ-ে দ-িত একজন আসামী। ছিনিয়ে নেয়ার পর তাকে আবার গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। টাঙ্গাইল জেলাধীন মির্জাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আসামী রাকিবকে নিয়ে গভীর রাতে তারা নাকি বেলতুলি এলাকায় অভিযান চালাতে গিয়েছিলেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে জেএমবির জঙ্গিরা নাকি গোলাগুলী শুরু করে এবং এতেই মারা যায় দ-িত রাকিব। এদিকে পুলিশের মাধ্যমে সরকার ঘটনার এরকম বর্ণনা দিলেও দেশের সচেতন সকল মহল পুরো বিষয়টিকে নিতান্ত কেচ্ছা-কাহিনী হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার আসল ঘটনা ‘ধামাচাপা’ দেয়ার উদ্দেশ্যেই বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়েছে। অন্য সব মহলের পক্ষ থেকেও সংশয় প্রকাশ করে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে এর কারণ সৃষ্টি করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, তিন আসামী ছিনতাই হওয়ার পর এ বিষয়ে সরকারি কোনো বিবৃতি আসার আগেই সিলেটে অর্থমন্ত্রী বলে বসেছেন, ঘটনার সঙ্গে জামায়াত জড়িত! কোনোরকম তদন্ত না হতেই জামায়াতকে জড়িয়ে অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের অভিযোগ সাধারণ মানুষকেও স্তম্ভিত করেছে। ক্ষমতাসীনদের অন্য কয়েকজনও জামায়াতকে জড়ানোর চেষ্টা করেছেন, কেউ কেউ এমনকি বিএনপির দিকেও আঙুল তুলেছেন। সব মিলিয়েই তারা বোঝাতে চেয়েছেন, আসামী ছিনতাইয়ের সঙ্গে তো বটেই, দেশজুড়ে জঙ্গি কর্মকা-ের সঙ্গেও বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী জড়িত। শুধু তা-ই নয়, ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে আল-কায়েদাকেও জড়িত করার চেষ্টা চালিয়েছেন তারা। এ ব্যাপারে আল-কায়েদা প্রধান জাওয়াহিরির বলে বর্ণিত প্রশ্নসাপেক্ষ একটি বিবৃতিকেও টেনে আনা হয়েছে। আওয়ামী  লীগ ও ভারতপন্থী সব দল ও গোষ্ঠীও শোরগোল শুরু করেছে। তবে আশার কথা হলো, পরিকল্পনা সুচিন্তিত হলেও ক্ষমতাসীনরা জনগণকে তাদের জঙ্গিতত্ত্বের ট্যাবলেট গেলাতে পারেননি। জনগণ বরং প্রিজন ভ্যানের নিরাপত্তা থেকে বন্দুকযুদ্ধে একজন দ-িতের মৃত্যু এবং ঠিক তার পর মুহূর্তে জামায়াতকে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের তৎপরতার উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। পুরো বিষয়টিকেও তারা রহস্যজনক মনে না করে পারছে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা আলমগীর আসল ঘটনা ‘ধামাচাপা’ দেয়ার যে অভিযোগ তুলেছেন তা নিয়েও জোর আলোচনা চলছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বলা হচ্ছে, কারো ওপর দোষ চাপানোর আগে সরকারের উচিত দুটি প্রশ্নের জবাব দেয়াÑ  প্রিজন ভ্যানের নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা হয়নি? কেন যেখানে-সেখানে যার-তার পক্ষে হামলা চালানো এবং আসামী ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে?
অন্য একটি বিশেষ কারণেও জামায়াতকে জড়িত করার চেষ্টা মাঠে মারা গেছে। সে কারণটি জেএমবির অতীত কর্মকা- এবং তার বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর কঠোর ভূমিকা। জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়নি যে, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই একযোগে ৬৩টি জেলায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর মাধ্যমে জেএমবি প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে এসেছিল। জেএমবির প্রধান দ্ইু নেতা শায়খ আবদুর ররহমান ও বাংলা ভাইকে জোট সরকারই গ্রেফতার ও বিচার করে মৃত্যুদ-ে দ-িত করেছিল। সুতরাং জেএমবির সঙ্গে অন্তত জামায়াত বা বিএনপির সংশ্লিষ্টতা আবিষ্কারের কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। অন্যদিকে আসামী ছিনতাইয়ের পর নিজেদের ব্যর্থতা আড়ালের উদ্দেশ্যে সরকার সে চেষ্টাই চালিয়েছে। একই কারণে সরকারের নৌকা হালে পানি পায়নি। অন্য একটি বিশেষ কারণেও ক্ষমতাসীনরা তাদের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না। সে কারণটি দ্রুত বেড়ে চলা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-। কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি বিগত কয়েক মাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের মাধ্যমে বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের হত্যা করে চলেছেন। হত্যার এই ভয়ংকর অভিযানে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও যুবদল এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ দল দুটির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাও হত্যাকা-ে মারা যাচ্ছেন। এসবের নাম দেয়া হচ্ছে ক্রসফায়ার এবং এনকাউ্টার। ইদানীং আবার ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নামের আড়ালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে।  প্রতিটি হত্যাকা-ের পরই সরকারের পক্ষ থেকে একই ভাষায় জানানো হচ্ছে, সন্ত্রাসে জড়িত অন্য আসামীদের গ্রেফতার করার জন্য নিহত নেতা বা কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালাতে গিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল বলেই র‌্যাব ও পুলিশ  নাকি ‘বাধ্য হয়ে’ গুলী ছুঁড়েছে এবং এতেই মৃত্যু ঘটেছে ওই নেতা-কর্মীদের! মির্জাপুরের বন্দুকযুদ্ধে নিহত রাকিবের বেলায়ও একই কেচ্ছা বানানো হয়েছে বলে মানুষ সন্দেহ করছে। ছিনতাই হয়ে যাওয়া আসামীকে কেন সেদিনই গভীর রাতের অভিযানে নিয়ে যাওয়া হলোÑ সে প্রশ্নও উঠেছে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে বন্দী থাকা কারো পক্ষে অন্য জঙ্গিদের অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানার কথা নয়। এজন্যই বলা হচ্ছে, বন্দুকযুদ্ধের আড়ালে তাকে আসলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার বানানো হয়েছে। এর উদ্দেশ্যও রহস্যজনকÑ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের ভাষায় আসল ঘটনা ‘ধামাচাপা’ দেয়া। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও একথা বলা আমরা জাতীয় দায়িত্ব মনে করি যে, জনগণের মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়ার অপকৌশল ক্ষমতাসীনরা নিতেই পারেন কিন্তু এর মাধ্যমে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন এবং প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি এবং বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী অসাধারণ সাফল্যকে আড়াল করা সম্ভব হবে না। জামায়াত-শিবিরকেও রাতারাতি জঙ্গি-সন্ত্রাসী বানিয়ে ফেলা যাবে না। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, সন্ত্রাস দিয়ে কখনো সন্ত্রাস দমন বা নির্মূল করা যায় না। হত্যা ও গুমের মতো ভয়ংকর পন্থায় সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করা কিংবা জনগণের আন্দোলন প্রতিহত করাও সম্ভব নয়। জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দমনের ব্যাপারে সত্যি সদিচ্ছা থাকলে সরকারের উচিত অবিলম্বে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা এবং যত বড় জঙ্গি-সন্ত্রাসী বা খুনি-অপরাধীই হোক তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করা। আইনানুযায়ী বিচারের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads