মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে আসল কাজ ফেলে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। মানবাধিকারের প্রশ্নে কোনো সাফল্য না দেখাতে পারলেও বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তিকর বক্তব্য রাখার মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টির ব্যাপারে এরই মধ্যে তিনি যথেষ্ট ‘সুনাম’ কুড়িয়েছেন। গত মঙ্গলবার ও বুধবারও দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে তিনি এমনকিছু কথা বলেছেন যেগুলো নিয়ে সচেতন সকল মহলে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে তিনি সংবিধান থেকে ‘বিসমিল্ল¬াহ’ বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তার যুক্তি, এটা ১৯৭২-এর সংবিধানে ছিল না। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মকে নাকি কোনোভাবেই ব্যবহার করা উচিত নয়! বুধবার আরেক অনুষ্ঠানে তিনি বলে বসেছেন, বাংলাদেশের মানুষ এখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি বলেই তসলিমা নাসরিনকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কোন অপরাধে তসলিমা নাসরিন দেশে আসতে পারছেন না তাও নাকি বুঝতে পারেন না ড. মিজানুর রহমান! পরের বাক্যেই তার চাতুরি অবশ্য ধরা পড়ে গেছে। কারণ, তথাকথিত ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নারী সমাজের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তিনি।
মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের এসব কথার পিঠে কথা উঠেছে যুক্তিসঙ্গত কিছু কারণে। প্রধান কারণটি হলো, জাতীয় জীবনের এমন এক জটিল সময়ে বেছে বেছে তিনি ‘বিসমিল্ল¬াহ’ বাদ দিতে এবং তসলিমা নাসরিনকে ফিরিয়ে আনতে বলেছেন, ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে যখন সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে ইসলাম এবং মুসলমানবিরোধী প্রচারণা ও অভিযান চালানো হচ্ছে। কথায় কথায় আবিষ্কার করা হচ্ছে কথিত ইসলামী জঙ্গিদেরও। আুমরা তো মনে করি, সাধারণ মানুষও যেখানে স্বঘোষিত ধর্মদ্রোহী তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে জানেন সেখানে ড. মিজানুর রহমানের মতো গোঁফে তা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো একজন মহাপন্ডিতের না জানার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তা সত্ত্বেও একদিকে তিনি যখন জ্ঞানপাপীর অভিনয় করেন এবং অন্যদিকে যখন ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নারীদের প্রতি আহবান জানান তখন তার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন না উঠিয়ে পারা যায় না। শুধুু তাই নয়, মঙ্গলবারের অনুষ্ঠানে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার মাধ্যমে মারাত্মক রাজনৈতিক সংকট তৈরি করার খলনায়ক সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়ার কারণেও ড. মিজানের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তার অভিমত, খায়রুল হক নাকি ‘সাহস’ দেখিয়ে গেছেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা নাকি গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না! তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি ‘ভাড়া করা লোক’ দিয়ে চালানো হয় এবং সে কারণে এটা গণতন্ত্রবিরোধী! প্রশংসার সঙ্গে খায়রুল হকের অন্য একটি রায়ের উলে¬খ করে তিনি বলেছেন, ওই রায়ে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলকে মারাত্মক শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ক্ষমতাসীনদের সুরে তাল মেলালেও ড. মিজান কিন্তু জানাননি, তার চাকরির মালিক বর্তমান সরকারই ওই রায়ের আলোকে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উদাহরণ দেয়ার জন্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সম্পর্কে রায়ের বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে সংবিধান ও প্রচলিত ফৌজদারি আইনের ধারা-উপধারার উল্লেখসহ বলা হয়েছিল, একটি নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান কত গুরুতর এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছিলেন। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ের নির্দেশনার প্রতিও ড. মিজানের চাকরিদাতা সরকার সামান্য সম্মান দেখায়নি। ক্ষমতাসীনরা এরশাদকে বরং আওয়ামী মহাজোটের শরিক বানিয়েছেন। রায় অনুযায়ী অনেক আগেই যার কারাগারে যাওয়ার কথা সে এরশাদ এখন তো প্রধানমমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার স্ত্রী রওশন এরশাদকেও বিরোধী দলের নেত্রী বানানো হয়েছে। কিন্তু এসবের ধারেকাছেও যাননি ড. মিজানুর রহমান। তার চোখে শুধু মুসলমানদের ‘বিসমিল্লাহ’ই পড়েছে, তসলিমা নাসরিনের মতো একজন ধর্মদ্রোহীর জন্যও দরদ উথলে উঠেছে তার!
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্ধারিত এখতিয়ারের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা অবশ্যই বলা দরকার। কারণ, সংবিধান থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ বাদ দেয়া হবে কি হবে না সেটা তার এখতিয়ারে পড়ে না। তসলিমা নাসরিনের জন্যও মায়াকান্নায় চোখ ভেজানোর সুযোগ তার থাকতে পারে না। ড. মিজান বড়জোর গণতন্ত্র সম্পর্কে বলতে পারেন কিন্তু তাই বলে বলতে পারেন না যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিছু ‘ভাড়া করা লোক’ দিয়ে চালানো হয় এবং সেটা গণতন্ত্রবিরোধী। আমরা জানি না, নিজে সরকারের ‘ভাড়া’ খাটছেন বলেই কথাটা বলেছেন কি না, তবে প্রমাণিত সত্য হলো, এ পর্যন্তও তিনি অনুগত কর্মচারীসুলভ অবস্থানের বাইরে আসতে পারেননি, সংবিধান ও আইন নির্ধারিত ভূমিকাও তাকে পালন করতে দেখা যায়নি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-সহ মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য করলেই এ ব্যাপারে ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এমন কোনো উদাহরণ দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, যার মাধ্যমে প্রমাণ করা যাবে, জনগণের মানবাধিকার রক্ষা বা সমুন্নত রাখার স্বার্থে কখনো, কোনো পর্যায়ে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। তার এই সেবাদাসসুলভ ভূমিকায় উৎসাহিত হয়েই সরকার একদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চালাচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর চালাচ্ছে প্রচন্ড দমন-নির্যাতন। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান শুধু গোঁফে তা দিয়েই ঘুরে বেড়ােেচ্ছন। কখনোই তাকে ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। আরো অনেক তথ্যেরই উল্লেখ করা সম্ভব যেগুলো প্রমাণ করবে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ড. মিজানুর রহমান শুধু ব্যর্থই হননি, অযোগ্যতারও নজীর স্থাপন করেছেন। এজন্যই আমরা মনে করি, ‘বিসমিল্লাহ’ এবং তসলিমা নাসরিনের মতো কোনো বিষয় নিয়ে পান্ডিত্য দেখানোর কোনো অধিকারই তার থাকতে পারে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন