বাংলাদেশে একটি মহল অসাম্প্রদায়িকতা
চেতনার আড়ালে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুকৌশলে কাজ করে যাচ্ছে।
এরা রাজনৈতিক আবহ বুঝে এ প্রয়াসকে বেগবান করে। প্রতীয়মান হচ্ছে, এরা ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার চিন্তায় বিভোর। কিন্তু
তাদের সে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার অবকাশ কোথায়? এরা যেসব নেতাকে পূজনীয় বলে মনে
করে তারাই কিন্তু সেই জাতিগত সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে দেশ-ভাগের
আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ কথা তারা বেমালুম ভুলে
যায়।
এই বিশেষ
চেতনার লোকজন ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের কারণে এ দেশে ফেলে যাওয়া পশ্চিম বাংলার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী
প্রয়াত জ্যোতি বসুর ভিটেমাটি পুনরুদ্ধার করে তার পরিবারকে ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে।
এরা কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত বাড়িতে বিশিষ্ট দার্শনিক, আইনবেত্তা, ধর্মতত্ত্ববিদ ও আধ্যাত্মিক পুরুষ ইমাম গাজ্জালির
নামে গড়ে ওঠা বিদ্যানিকেতন ও ট্রাস্টের স্থলে সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা করার
ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বে ইমাম গাজ্জালির যে
অবদান তার সাথে সুচিত্রা সেনের অবদানের কোনো তুলনা চলে না। অথচ ইমাম গাজ্জালির নাম-নিশানা
মুছে ফেলে একজন ভারতীয় নায়িকার নামে কোনো স্থাপনা গড়ে তোলা হবে পাবনাবাসী তথা এ দেশের
মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। দুঃখের বিষয় সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীও এতে উৎসাহ
জোগাচ্ছেন। শুধু এ দেশে জন্মগ্রহণ করার কারণেই ভিনদেশী কোনো সেলিব্রেটির প্রতি আবেগাশ্রয়ী
হয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে দেশভাগের ঐতিহাসিক বাস্তবতা (যার অনিবার্য পরিণতিতে
বাংলাদেশ) ও ঐতিহ্য সম্পর্কে যেন আমরা বিস্মৃত না হই কিংবা অসম্মান প্রদর্শন না করি।
স্বেচ্ছায় দেশ ত্যাগকারী আরো অনেকের ভিটেমাটি ফেরত দেয়ার দাবিও বিশেষ চেতনার লোকজন
করে আসছে। এ কথা সুবিদিত যে, এদের অনেকেই দেশ ত্যাগের সময় স্বেচ্ছায় তৎকালীন
পূর্ব বাংলা ত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন এবং তথায় স্ব স্ব ক্ষেত্রে গৌরবদীপ্ত ভূমিকায়
তারা নিজেদের স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেন। তারা যদি তাদের ভিটেমাটি পরিত্যাগ করে চলে
গিয়ে থাকেন, তা হলে সেগুলো সরকারের সম্পত্তি হওয়ার কথা। আর যদি তারা তা বিক্রি
করে গিয়ে থাকেন, তা হলে ক্রেতারা কিংবা তাদের উত্তরাধিকারীরা ওই সম্পত্তির বৈধ
ও আইনানুগ মালিক। সে ক্ষেত্রে তাদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের এবং তাদের ফেরত দেয়ার অবকাশ
কোথায়? এরা এর আইনগত তাৎপর্য না বুঝেই এসব উদ্দেশ্যমূলক দাবি জানাচ্ছে।
আর এত বছর পর এসব সম্পত্তি ফেরত দেয়ার দাবিই বা উত্থাপিত হচ্ছে কেন, সেটাই তো প্রশ্ন। মীমাংসিত নন-ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে এরা কার এবং কোন দেশের
বা গোষ্ঠীর স্বার্থচরিতার্থ করতে চায়? প্রকৃত প্রস্তাবে এরা অসাম্প্রদায়িকতার
আড়ালে সাম্প্রদায়িকতাকেই উসকে দিচ্ছে এবং সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের পাঁয়তারা
করছে, যা কারো জন্য শুভ হবে না।
এ ছাড়া
এরা স্বেচ্ছায় বিভিন্ন সময়ে ভারতে চলে গেছে এমন কিছু ব্যক্তিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের
হিরো হিসেবে জাহির করে তাদের নামে সড়ক কিংবা বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করার চেষ্টায়
রত। যদিও এদের কেউ কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। এমনকি কারো কারো বিরুদ্ধে মুসলিম
সহকর্মীদের অগ্নি শপথ করানোর অভিযোগ রয়েছে। অথচ এ দেশের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী তথা মনীষীর
নামে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণে তাদের খুব অরুচি, বিশেষ করে তারা যদি মুসলিম হন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, এ দেশের সংখ্যালঘুরা বহির্বিশ্বের কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়ার
শিকার হলে এরা খুব সোচ্চার হয় এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শের ধ্বজাধারী বলে জাহির করার
চেষ্টা করে। কিন্তু বহির্বিশ্বে মুসলমানেরা (যেমন মিয়ানমারের রাখাইনরা, ভারত বিশেষ করে কাশ্মিরের মুসলমানেরা ও ফিলিস্তিনিরা) নির্যাতিত-নিপীড়িত হলে
এরা টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে না। অসাম্প্রদায়িক চেতনার আবরণে এ আরেক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা।
এরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তির ধ্বজাধারী হিসেবে এর নিকুচি করলেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি
কর্তৃক আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণ ও দখলপূর্বক তথায় পুতুল সরকার কায়েম করার বিরুদ্ধে
কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। এরা মিসরের নির্বাচিত সরকার উৎখাতের তথা সামরিক স্বৈরশাসনেরও
নিন্দা জানায়নি।
আর এরা
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে এদের হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সুকৌশলে কাজ করছে। এদের
হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এরা বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলছে। এসব সংগঠনের মধ্যে কোনো
কোনো সংগঠন তাদের পরিচালিত সাংস্কৃতিক কোর্সের সমাপনী অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কপালে
ভিন দেশের সংস্কৃতির অনুকরণ চন্দনের তিলক এবং উত্তরীয় পরিয়ে দেয়। ভিন দেশের সংস্কৃতি
প্রমোট করায় এদের কেউ কেউ ভিনদেশী খেতাবও পেয়ে যায়। সাংস্কৃতিক সংগঠনের আবরণে এরা আসলে
রাজনীতি করছে। এরা শহীদ মিনারকে গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহার করছে। ভাবখানা এমন যে তাদের
বিশেষ আদর্শের প্রতীক হিসেবেই শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল। এরা জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার
বিরুদ্ধে কথা বললেও এরা মূলত ইসলামবিদ্বেষী। জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এবং ইসলামকে
এরা সমর্থক মনে করে। এরা ইসলাম ধর্মের বিশেষ করে এর উত্তরাধিকার আইনের দোষত্রুটি খুঁজে
বেড়ায়। কিন্তু অন্য ধর্মের কিংবা ধর্মগ্রন্থের মধ্যে এরা কোনো খুঁত খুঁজে পায় না। এরা
প্রগতিশীলতা এবং বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার নামে ইসলামি তহজিব তমদ্দুন মুছে ফেলতে চায় এবং
ভিন দেশের সত্তা ও সংস্কৃতিতে লীন হয়ে যেতে চায়। এদের কাছে বাঙালি সংস্কৃতি মানে হলো
শুধু একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের অনুকরণে পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভা যাত্রা বের করা। এরাই
আবার পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণে মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করাকে
বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে নবপ্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চায়। এরা বাঙালি সংস্কৃতির আবরণে
পশ্চিম বাংলার সংস্কৃতি চালু করার চেষ্টায় রত। এরা সন্তানদের বাঙালি নাম রাখতে গিয়ে
সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত নাম রাখছে। যেমন সুকান্ত, সামন্ত, সঞ্জয়, অনিন্দ্য প্রভৃতি। এরা অসাম্প্রদায়িকতার আড়ালে ব্রাহ্মণ্যবাদ
ও আধিপত্যবাদী শক্তির তাঁবেদারি করছে। এ হলো এদের স্বরূপ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন